
রইসউদ্দিন আরিফ। ফাইল ছবি
এক সময় সমাজে সিম্পল লিভিং ও হাই থিংকিংকে জীবনের সঠিক আদর্শ বলে মনে করা হতো। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এককালে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের উঁচু চিন্তার মানুষরা খুবই সাধারণ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। যেমন- রজার বেকন, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, কার্ল মার্কস, আইনস্টাইন ও স্টিফেন হকিং প্রমুখ। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন কখনো কখনো এক পোশাক পরে কয়েক সপ্তাহ কাটিয়ে দিতেন। একবার তাকে এক লোক প্রশ্ন করে, ‘আপনি এক পোশাক পরে এতদিন থাকেন কী করে?’ জবাবে ফ্রাঙ্কলিন বলেছিলেন, ‘দিন-রাত চিন্তা করেই কূল পাই না, ঘন ঘন পোশাক পাল্টাবার সময় কোথায়?’ এই আধুনিক যুগেও বিশ্বখ্যাত আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ভেরা রুবিন, প্রায় সারা জীবন বেশিরভাগ সময় সকালে এক টুকরো রুটি মুখে দিয়ে, অতি সাধারণ পোশাক পরে ল্যাবরেটরিতে বসে কাজের মধ্যে এমন গভীরভাবে ডুবে থাকতেন যে, দুপুর এবং রাতের খাবারের কথা ভুলে যেতেন। সন্ধ্যাবেলা ছাদে বসে টেলিস্কোপ সামনে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সারারাত কাটিয়ে দিতেন খাওয়া-পরা ভুলে। আইনস্টাইন তো অনেক সময়েই ইস্তিরিবিহীন কুঁচকানো প্যান্ট-শার্ট গায়ে চাপিয়ে, এক পায়ে জুতা, আরেক পায়ে স্যান্ডেল পরে ডায়াসে বক্তৃতা দিতে উঠতেন। এবার চিন্তা করুন, হাই থিংকিংয়ের লোকদের হাই লিভিংয়ের সময় কোথায়?
অথচ আজ পৃথিবীর সর্বত্র শহরকেন্দ্রিক নাগরিক সমাজ হলো, অগভীর চিন্তা ও বিলাসী জীবন-যাপনের। বিশেষ করে আমাদের মতো ‘অন্ধ উন্নয়ন-পাগল’ অনুন্নত দেশে, হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বিলাসী মানুষদের ভিড়ের মধ্যে দু-চারজন সহজ জীবন-যাপন ও গভীর চিন্তার লোক যারা আছেন, তারা বলতে গেলে অঘোষিতভাবে একরকমের সমাজচ্যুত, অবহেলিত মানুষ।
একটুখানি রূঢ় বাস্তবতার কথা বলি। গভীর চিন্তা তো আর দিন-রাত ঘরে বসে থেকে করা যায় না। একটু ভিন্ন পরিবেশে হাঁটাহাঁটি ও চিন্তা করার জন্য আপনার একটু নিরিবিলি জায়গার দরকার হবে। কিন্তু আপনার আশেপাশে সেই রকম জায়গা কোথায় পাবেন আপনি? অগত্যা আপনার একমাত্র ভরসা ফুটপাত। কিন্তু সেখানেও খানিকটা আনমনে চিন্তা করতে করতে নিরিবিলি হাঁটার জো নেই। অগুনতি ব্যস্ত মানুষের ভিড় সেখানে।
আপনি যদি বয়সের ভারে কাবু অথবা রোগা-পটকা লোক হন, তাহলে ফুটপাতের ভিড়ের মধ্যে কোনোকিছু বুঝে ওঠা বা সতর্ক হওয়ার আগেই হঠাৎ মালুম করবেন, বেহুঁশ হয়ে ছুটে চলা ওই হাই লিভিং পাগল লোকদের মধ্যে মস্তান গোছের কারও না কারও জোর ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়েছেন ব্যস্ত সড়কের প্রায় মাঝখানে, যেখানে সাঁই সাঁই করে ছুটে চলছে অগনিত যন্ত্রদানব (গাড়ি, বাস, ট্রাক)। কপাল একেবারে মন্দ হলে, আপনার হাই থিংকিংয়ের চিরকবর হবে ওখানেই। আপনার থ্যাঁতলানো লাশের চারপাশে জড়ো হওয়া লোকজন বলতে থাকবে, আহা রে!
আমাদের ঢাকার নগর জীবনের এই যে এক চিত্র তুলে ধরা হলো, এটাকে নিছক কষ্টকল্পিত গল্প মনে করার কোনো কারণ নেই। এটি আমার নিজের এক বাস্তব মর্মবিদারক অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ত বিবরণ। তা ছাড়া এরকম মর্মান্তিক ঘটনা তো নগরীর সড়ক পথে প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা।
দুই.
এবারে অন্য আরেক দৃশ্যপটে আসি। এটাও আমার শঙ্কিত অনুমানের কথা; তবে প্রেক্ষাপটটি বাস্তব। একটু আগের বর্ণনায় নগরীর ব্যস্ত সড়কে গাড়ির চাকার নিচে থ্যাঁতলানো এক হাই থিংকিংয়ের দার্শনিকের ওপর, পথচারীদের দ্বারা বেখেয়ালিপনার যে অপবাদ দেওয়া হলো, সেই বেখেয়ালিপনা কিন্তু কোনো তুচ্ছ ব্যাপার নয়।
ধরুন আপনি কোনো কবি-দার্শনিক না হয়ে, অফিস-আদালতের নিম্ন অথবা মাঝারি বেতনভোগী মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক হতে পারেন। বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পথে ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, পেঁয়াজের কেজি, হঠাৎ লাফ দিয়ে ২০০ টাকা হওয়ার ব্যাপারটি নিয়ে নিজের দুর্ভোগের কথা ভাবতে গিয়ে, নগরীর দেড় কোটি মানুষের দুর্ভোগের কথাও ভাবতে পারেন আপনি। ভাবতে পারেন দেশের শতকরা ৯০ ভাগ সাধারণ মানুষের বেহাল অর্থনীতির কথা। এমনকি ঢাক-ঢোল পেটানো ‘উন্নয়নের’ উচ্চকিত আওয়াজ কর্ণকুহরে ঢুকে আপনার মগজে হাতুড়ি পেটাতে পারে। আর তখন আপনি যদি বেখেয়াল হয়ে পড়ে মর্মান্তিক পরিণতির শিকার হন এবং পথচারীদের দ্বারা বেখেয়ালিপনার অভিযোগে অভিযুক্ত হন, তখন আপনার এই বেখেয়ালিপনাও কিন্তু তুচ্ছ ব্যাপার নয়। কারণ যে বিষয় নিয়ে থিংকিং করতে করতে আপনি বেখেয়াল হয়ে পড়লেন, সেই বেখেয়ালের কারণও কিন্তু দেশের সাড়ে সতেরো কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে হাই থিংকিং।
তিন.
এদিকে আমাদের রাজধানী নগরীর নাগরিকদের হাই লিভিং ও সিম্পল থিংকিংয়ের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে একজন বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী লেখক একটি জাতীয় পত্রিকায় কলাম লিখে সাধারণ মানুষের নাগরিক জীবনের এক ভয়াল চিত্র তুলে ধরেছেন। লেখকের পুরো বক্তব্যের মধ্যে সাধারণ মানুষের চলাচলে নগরীর বেশির ভাগ সড়কগুলোর যে ভয়াবহ অব্যবস্থার কথা বর্ণিত হয়েছে, তাতে আমাদের ‘ঘুণেধরা’ ডিজিটাল রাষ্ট্রব্যবস্থার বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে স্বেচ্ছাচারী পরিকল্পনায় নগরীর যে সড়কব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তাতে নগরীর ১০ ভাগ হাই লিভিংয়ের লোকদের জন্য নিরাপদ ও আরামদায়ক হলেও, পাবলিক তথা সাধারণ মানুষের সদা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে, এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয়। তাতে মনে হয়, রাষ্ট্র তথা রাষ্ট্রের সরকার দেশের সড়ক চলাচলসহ সকল ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলেছে জনগণের সুবিধা, নিরাপত্তা ও স্বার্থের বিপরীতে। নজিরবিহীন দুর্নীতিগ্রস্ত উন্নয়নের সুবিধাভোগকারী মাত্র ১০ ভাগ মানুষের উন্নয়নের জন্য কি দেশের মানুষ বুকের রক্ত দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে?
এখন জীবনের আদর্শ হয়ে উঠেছে হাই লিভিং ও সিম্পল থিংকিং। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, হাই লিভিং এবং সিম্পল থিংকিং যারা করে, তারাই হচ্ছে এখন সমাজের কর্ণধার এবং সবখানেই। কবি জীবনানন্দের ভাষায়- যারা অন্ধ, তারাই আজ চোখে দেখে বেশি।