
প্রণব চক্রবর্তী
আগামী ৩০ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন আহ্বান করেছেন রাষ্ট্রপতি। গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ইতোমধ্যে সরকার গঠন করেছে। বিএনপি ও সমমনা কয়েকটি দল নির্বাচন বর্জন করেছে। তবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দেশের রাষ্ট্র/ সরকারপ্রধান তথা রাষ্ট্রদূত নতুন সরকারকে অভিনন্দিত করেছেন। আমেরিকার পক্ষ থেকে নির্বাচন নিয়ে তাদের ভিন্নরূপ পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করা হলেও বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
এবারের নির্বাচনে এ যাবৎ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা ২২৩। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ৬২ জন। জাতীয় পার্টির নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা ১১ এবং বাকি ৩টি দল থেকে ৩ জন নির্বাচিত হয়েছেন।
আলোচনা হচ্ছে বিরোধী দলে কারা থাকছেন তা নিয়ে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে ‘বিরোধী দলের নেতা’ বলতে স্পিকারের বিবেচনামতে যে সংসদ সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত ক্ষেত্রমত দল বা অধিসঙ্গের নেতা তাকে বোঝাবে।
পুরনো উদাহরণ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মূলত তাদের মূল দলে ফিরে যান। সেটাই স্বাভাবিক। তবে এবারে যেহেতু বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত প্রার্থীর সংখ্যা অত্যন্ত কম সে ক্ষেত্রে এই ভাবনায় পরিবর্তন আসা বিচিত্র নয়। স্বতন্ত্র নির্বাচিত দুয়েক জন এ ব্যাপারে তাদের আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। সে ক্ষেত্রে স্বতন্ত্ররা একটি ফোরাম হিসেবে পৃথক অস্তিত্ব নিয়ে থাকতে চাইলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বরং একটি দলের মনোনয়ন না পেয়ে যারা জিতে এসেছেন তারা কার্যত ভোটারদের বিশেষ বিবেচনা পেয়েছেন। অতএব এই আলাদা অস্তিত্ব ভোটার অপছন্দ নাও করতে পারেন। তবে এ সবকিছুর দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়াও বিবেচনা করা আবশ্যক।
সেই হিসেবে ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য যদি নিজেদের সমন্বয়ে অধিসঙ্গ গঠন করেন তবে বিরোধী দল হিসেবে এই অধিসঙ্গের স্বীকৃতি হয়তো মিলবে, কিন্তু তার সঠিক চরিত্র কী হবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকে যাবে। কারণ এই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ক্ষমতাসীন দলের পদ পদবিধারী। নির্বাচনে স্বভাবতই তাদের পক্ষে কাজ করাদের বড় অংশ ছিল আওয়ামী লীগের সমর্থকরাই। ফলে বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে তাদের অনাগ্রহ থাকতে পারে। বিশেষত তারা যখন নিজ দল ও সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে চলতে চাইবেন। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ মনোনীত পরাজিত প্রার্থীর পক্ষ থেকেও তারা বিরোধিতার সম্মুখীন হতে পারেন যা মাঠ পর্যায়ে স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করতে পারে।
সে ক্ষেত্রে অপবাদ থাকলেও জাতীয় পার্টির ১১ জন ও অন্য ৩টি দলের ৩ জনসহ মোট ১৪ জন বিরোধীদলীয় সদস্য হিসেবে আপাতদৃষ্টে গ্রহণযোগ্য ভূমিকা পালনে তৎপর হতে পারেন। তবে এই অধিসঙ্গ ও সমমনাদের শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজনে মহিলা সংসদ সদস্য বাছাইয়ে উপযুক্ত প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া যেতে পারে। অন্তত ২০ জনের একটি কার্যকর বিরোধী দল গণতন্ত্রকে সংহতকরণে সংসদে কার্যকর ভূমিকা পালনে দক্ষতা দেখাতে পারে।
জাতীয় সংসদ জবাবদিহিতার স্থান। সরকার সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে মানুষের কাছে জবাবদিহি করে থাকে এই সংসদে। সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদের স্থায়ী কমিটির কার্যাবলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৭৬ অনুচ্ছেদ নিম্নরূপ-
৭৬। (১) ১[* * *] সংসদ-সদস্যদের মধ্য হইতে সদস্য লইয়া সংসদ নিম্নলিখিত স্থায়ী কমিটিসমূহ নিয়োগ করিবেন:
(ক) সরকারি হিসাব কমিটি;
(খ) বিশেষ-অধিকার কমিটি; এবং
(গ) সংসদের কার্যপ্রণালি-বিধিতে নির্দিষ্ট অন্যান্য স্থায়ী কমিটি।
(২) সংসদ এই অনুচ্ছেদের (১) দফায় উল্লিখিত কমিটিসমূহের অতিরিক্ত অন্যান্য স্থায়ী কমিটি নিয়োগ করিবেন এবং অনুরূপভাবে নিযুক্ত কোনো কমিটি এই সংবিধান ও অন্য কোনো আইন-সাপেক্ষে
(ক) খসড়া বিল ও অন্যান্য আইনগত প্রস্তাব পরীক্ষা করিতে পারিবেন;
(খ) আইনের বলবৎকরণ পর্যালোচনা এবং অনুরূপ বলবৎকরণের জন্য ব্যবস্থাদি গ্রহণের প্রস্তাব করিতে পারিবেন;
(গ) জনগুরুত্বসম্পন্ন বলিয়া সংসদ কোনো বিষয় সম্পর্কে কমিটিকে অবহিত করিলে সেই বিষয়ে কোনো মন্ত্রণালয়ের কার্য বা প্রশাসন সম্বন্ধে অনুসন্ধান বা তদন্ত করিতে পারিবেন এবং কোনো মন্ত্রণালয়ের নিকট হইতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি সংগ্রহের এবং প্রশ্নাদির মৌখিক বা লিখিত উত্তরলাভের ব্যবস্থা করিতে পারিবেন;
(ঘ) সংসদ কর্তৃক অর্পিত যে কোনো দায়িত্ব পালন করিতে পারিবেন।
(৩) সংসদ আইনের দ্বারা এই অনুচ্ছেদের অধীন নিযুক্ত কমিটিসমূহকে
(ক) সাক্ষীদের হাজিরা বলবৎ করিবার এবং শপথ, ঘোষণা বা অন্য কোনো উপায়ের অধীন করিয়া তাহাদের সাক্ষ্যগ্রহণের,
(খ) দলিলপত্র দাখিল করিতে বাধ্য করিবার ক্ষমতা প্রদান করিতে পারিবেন।
সংসদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব আইন প্রণয়ন করা। আইন প্রণয়নে নির্বাহী বিভাগের আনীত বিল চুলচেরা বিশ্লেষণের সুযোগ থাকে এই কমিটিতে। এই কারণে দক্ষ ও যোগ্য সদস্যরা এইসব কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। সরকারি হিসাব কমিটির মতো কমিটিতে অনেক দেশেই বিরোধীদলীয় নেতা বা বিশিষ্টজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর ফলে প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের চেহারা উজ্জ্বল ও কার্যকর হয়ে থাকে।
নির্বাচিত স্বতন্ত্র সদস্যদের স্থায়ী কমিটিসমূহে নিয়োগ করে সংসদীয় কমিটি ব্যবস্থাকে কার্যকর করার পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এর ফলে একটি বড় দল সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলেও সংসদীয় কার্যক্রমের দৃশ্যমান গতি উপলব্ধি করা যেতে পারে।
সরকার জনতার প্রত্যাশার অংশ। সংসদকে কার্যকর করে সরকার এই প্রত্যাশা পূরণে এগিয়ে আসতে পারে। সংসদের বিরোধী দল কীভাবে ভূমিকা পালন করছে তার উপর এই প্রত্যাশা পূরণের বিষয়টি নির্ভর করে।