
প্রতীকী ছবি।
বর্তমান যুগে মেয়েদের মধ্যে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর তাই চাকরি ছাড়াও অন্য পেশা হিসেবে নিজের একটি ব্যবসা শুরু করার মাধ্যমে অনেক নারীই হয়ে উঠছেন উদ্যোক্তা। অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নারীর অংশগ্রহণ মূলত সভ্যতার শুরু থেকেই। ‘কৃষি’ নারী ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য আলোকিত অধ্যায়। পুরুষ যখন ছুটে চলেছে বন্য প্রাণী শিকারের পেছনে, নারী তখন নীরবে বপন করেছে শস্য দানা; যা পরবর্তীকালে গোটা সমাজ ব্যবস্থা পাল্টে দিয়ে সভ্যতার সূচনা করেছিল। একদিন যখন পুরুষ আবিষ্কার করল তাদের বসতির আশপাশ ছেয়ে গেছে সবুজ বৃক্ষরাজিতে আর তখন থেকেই সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করল স্থায়ী জীবনের।
কৃষিভিত্তিক সমাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ এখনো প্রায় সমান হলেও নারীর কাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি হয়নি সেভাবে। ক্ষেতের ফসলের পরিচর্যায় কৃষকের সঙ্গে একজন কৃষাণীর সক্রিয় উপস্থিতি আমাদের অজানা নয়। কৃষাণী তার নিপুণ দক্ষতায় ফসলকে দেয় মূল্যবান সম্পদের রূপ। যে সম্পদে ভর করে শুধু কৃষকই বাঁচার স্বপ্ন দেখে না, নির্ভর করে আমাদের অর্থনৈতিক ভিত্তিও। তাই নারীর কাজের ক্ষেত্র হিসেবে একটা বড় জায়গা এখনো দখল করে আছে কৃষি।
তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করেও নারী যে কর্মপন্থা অবলম্বন করছে তার বড় অংশ এদেশে কৃষিভিত্তিক। প্রত্যন্ত অঞ্চল জুড়ে তাদের বিস্তৃতি। যারা অনেকেই হয়তো সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে। আবার অনেকেই পিছিয়ে পড়ছেন বা পড়তে বাধ্য হচ্ছেন নানা প্রতিকূলতায়। যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর হয়ে দেখা দিয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট। জলবায়ু সংকট যদিও সবার জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ, তবে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু সংকটের অবনতির সঙ্গে সঙ্গে এটি পুরুষের তুলনায় নারীদের ওপর বেশি প্রভাব ফেলে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিবেচনায় পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কষ্ট ও জীবনসংগ্রামের বিষয়ে আমরা সবাই অবগত। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ‘জলবায়ু সংকটের কারণে স্থানচ্যুত মানুষের ৮০ শতাংশই নারী। সংঘাত ও সংকট যেমন কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরে বা পানির অভাব ও ফসলহানির প্রভাবে গণ-অভিবাসনের সময় অভিবাসনের যাত্রাপথ ও শরণার্থী শিবিরসহ বিভিন্ন জায়গায় নারী ও মেয়েরা জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতার মুখোমুখি হওয়ার বৃহত্তর ঝুঁকিতে থাকেন।’ গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বেশি ঝুঁকিতে থাকা ভৌগোলিক অঞ্চলে মেয়েদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার দেশের অন্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি থাকে। জলবায়ু ও পরিবেশের পরিবর্তন শিক্ষার জন্য ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি তৈরি করছে; যা নারীর বিকাশে প্রতিবন্ধক।
মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পারলে যে সুবিধা পাওয়া যায়, তা থেকে যায় এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মেয়েদের শিক্ষায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়ছে। অবকাঠামোর ক্ষতি, শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট, বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন ইত্যাদি সমস্যা ছাড়াও শিক্ষার্থীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি, স্থানান্তরিত হওয়ার ঝুঁকি, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সমস্যা দেখা দেয়। জলবায়ু পরিবর্তন ও ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে মেয়েশিক্ষার্থীরা অপুষ্টির শিকার হতে পারে, গৃহস্থালি কাজে নিয়োজিত হয়ে পড়তে পারে এবং তারা বাল্যবিবাহের শিকার হতে পারে। অপরদিকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের নারী শ্রমিকদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় নদীর পানি লবণাক্ত হয়ে যায়, নদী শুকিয়ে যায়, দুই-একটি নলকূপে, যেখানে মিষ্টি পানি ওঠে সেখানেও পানির জন্য হাহাকার। তাই পানি সংগ্রহের জন্য দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়া। জ্বালানির জন্য কাঠ সংগ্রহ করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বনের ভেতরে যাওয়া। কারণ লোকালয়ে গাছ নেই, লবণাক্ত মাটিতে বহুদিন কোনো গাছ জন্মায় না নানা উপকূলীয় অঞ্চলে। শুধু খাওয়ার পানিই নয়, সংসারে সবকিছুর জন্য যে পানি সেই পানি সংগ্রহ করার দায়িত্বও নারীর। তাই সেই বিপর্যয় মোকাবিলায় নারীকে সামনে দাঁড়াতে হয়। লবণাক্ততার কারণে ফসল হয় না। মাছ উৎপাদন ও রপ্তানিকে কেন্দ্র করে যে শিল্প গড়ে উঠেছিল তাও হুমকির মুখে। তাই কাজের খোঁজে প্রান্তিক পুরুষকে ঘর ছাড়তে হয়। মেয়েরা রয়ে যায় সন্তান, বয়স্কদের দেখে রাখার দায়িত্বে। এ ছাড়া লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দেয়। চুল ও ত্বকের ক্ষতি হয়। দ্রুত বার্ধক্য চলে আসে। এ ছাড়া গর্ভপাত ও প্রজনন স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এমন অবস্থায় দেশের মোট জনগোষ্ঠীর এক বড় অংশের নারীরা অর্থনৈতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণে ব্যর্থ হয়; যা নারী তো বটেই দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে।
তবে আশার কথা হলো, গবেষকরা মনে করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি হ্রাস ও নারীদের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এসব অঞ্চলেও নারী নেতৃত্ব ও নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা সম্ভবপর। তবে এ জন্য প্রয়োজন জলবায়ুসহিষ্ণু ফসলের যেসব নতুন জাত উদ্ভাবন হচ্ছে তার সুফল নারীর কাছে পৌঁছে দেওয়া। উৎপাদিত পণ্যের বাজার নিশ্চিত করা ও সংরক্ষণে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ বাড়ানো। কারণ বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে নারীর আয়ের নিরাপত্তা থাকে না। গতানুগতিক পেশা যেমন কৃষিকাজ, মাছ চাষ ইত্যাদির বাইরে অপ্রচলিত পেশায় নারীকে দক্ষ করে তোলা। নারী কৃষককে শস্যবীমার আওতায় নিয়ে আসা। জলবায়ু তহবিলের স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা।
- কথাসাহিত্যিক