
শেখর দত্ত। ফাইল ছবি
একাত্তরের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শুরু হয় দেশকে স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার ঘোষণা যেমন হঠাৎ করে ঘোষিত হয়নি, তেমনি মুক্তিযুদ্ধও আকস্মিকভাবে শুরু হয়নি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সুদীর্ঘ ২৪ বছর শাসন-শোষণ, নির্যাতন-নিপীড়নের ফলে দেশবাসীর গণতন্ত্র ও স্বাধিকারের রক্তক্ষয়ী লড়াই-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতার জন্য জনগণ মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে। ইতিহাসের এক মাহেন্দ্রক্ষণে নেতা-জনতার অভূতপূর্ব ঐক্য ও সশস্ত্র লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
দেখতে দেখতে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার করছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে যে, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বিশ্বব্যবস্থা কিংবা আমরা যে অবস্থায় ছিলাম, তা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে এবং এর গতি ক্রমে বাড়ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আমেরিকার নেতৃত্বে ধনতান্ত্রিক ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের যে ঠান্ডাযুদ্ধের যুগ শুরু হয়, তাতে ঔপনিবেশিক যুগের সমাপ্তির ভেতর দিয়ে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো স্বাধীনতা অর্জন করতে থাকে।
স্বাধীন স্বদেশ প্রতিষ্ঠার পর আমরা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক মুক্তির ‘গণতন্ত্রের পথে সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার পথ গ্রহণ করি। পাকিস্তান আমলে গণতন্ত্র ও জাতীয় অধিকারের জন্য সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জন্য এই পথ নির্ধারণ করে দেয়। আমরা জাতীয় চারনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করি। কিন্তু হত্যা-ক্যু, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসন ওই পথে আমাদের থাকতে দেয়নি।
ইতোমধ্যে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটতে থাকে। সংঘটিত হয় চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। ধনতন্ত্র-সমাজতন্ত্র ঠান্ডাযুদ্ধ যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। আমেরিকার নেতৃত্বে এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে ওঠে এবং তা স্থায়ী রূপ নেবে বলেই মনে হতে থাকে। ওই ব্যবস্থাও স্থায়ী হতে পারে না। আগে ছিল দুই দেশ মুখোমুখি, আর এখন অনেক দেশ অনেক রকমভাবে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ বর্তমানে ক্ষমতায়। এ অবস্থায় স্বাধীনতার মর্মবাণী তথা লক্ষ লক্ষ শহীদের স্বপ্নসাধ ধারণ করে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে যারা ধৈর্য ধরে মুক্তিযুদ্ধ নির্ধারিত লক্ষ্যাভিমুখী পথে অগ্রসর হতে চান, তারা আজ নিরাশ হচ্ছেন। আর যারা আমূল পরিবর্তন মেনে নিয়ে খাপ খেতে পারছেন না, তাদের মধ্যে অতি ডান-বাম প্রবণতা লক্ষণীয় হয়ে উঠছে।
এই অবস্থায় দেশি-বিদেশি যড়যন্ত্র-চক্রান্ত যে প্রবল হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিগত নির্বাচনের আগে আমরা এই বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেছি। এটা ঠিক, আমরা সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষায় ভোট সম্পন্ন করতে পেরেছি। নতুন সরকারও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এটা তো জনগণের অজানাই থেকে যাচ্ছে, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত এখন কোন পর্যায়ে, কীভাবে, কোন ধরনের গভীরতা ও বিস্তৃতি নিয়ে চলছে। বাংলাদেশের জনগণ ঠান্ডাযুদ্ধ যুগের ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের ভয়াবহ রূপ প্রত্যক্ষ করেছে, কিন্তু বর্তমান যুগে কতটা কী রূপ নিতে পারে তা আমাদের অজানা।
নির্বাচনী অঙ্গীকারে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বলেছে : রাষ্ট্রপরিচালনার সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সুশাসন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা সুপ্রতিষ্ঠিত করা; আইনের শাসন ও মানবাধিকার সুরক্ষা করা এবং শিক্ষিত, চৌকস ও দুর্নীতিমুক্ত মানুষদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণে আগ্রহী করে তোলা হবে। এই ওয়াদা কতটুকু বাস্তবায়ন করে সরকার ও সরকারি দল, তা জনগণ আগামী দিনগুলোতে গভীরভাবে বিবেচনায় নেবে।
তবে অর্থনীতির ক্ষেত্রে সরকারি দল আশু সম্পন্ন করার যেসব অঙ্গীকার করেছে, তা নিয়ে কিন্তু বিন্দুমাত্র বসে থাকার সময় নেই। সরকারের অঙ্গীকার হচ্ছে, ‘দ্রব্যমূল্য ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।’ প্রচেষ্টার কিছু লক্ষণ রয়েছে ঠিক। কিন্তু জনগণের প্রধান মাথাব্যথা সিন্ডেকেট। সম্প্রতি আওয়ামী সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সিন্ডিকেটের সঙ্গে বিএনপির যোগাসাজশ খতিয়ে’ দেখা হচ্ছে। নিঃসন্দেহে সিন্ডিকেট কাদের নিয়ে গঠিত, তা খতিয়ে দেখার অধিকার রয়েছে।
তবে সরকারি তৎপরতা থেকে জনগণের কাছে আদৌ সুস্পষ্ট নয়, সিন্ডিকেটের আসল জায়গায় সরকার হাত দিচ্ছে কি না? বঙ্গবন্ধুর আমলে অসাধু ব্যবসায়ী-আমলা-রাজনৈতিক গণশত্রু নেক্সাস গড়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু তাদের বলতেন ‘চাটার দল’। অতীতের ওই বিয়োগান্তক ও মর্মান্তিক ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে সরকার জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনুকএটাই বর্তমানে সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ। স্বাধীনতার মাসে রোজার মধ্যে ঈদ সামনে রেখে জনগণ চায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকুক এবং স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা ও আইনের শাসন সুরক্ষায় চুনোপুঁটি নয়, সিন্ডিকেট চিহ্নিত হোক। গণশত্রুরা আইনের আওতায় আসুক।
- কলাম লেখক, রাজনীতিক