Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

মোদির রাজত্বকালে গণতন্ত্র প্রহসনে পরিণত হয়েছে

Icon

সৌমিত্র দস্তিদার

প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:২৫

মোদির রাজত্বকালে গণতন্ত্র প্রহসনে পরিণত হয়েছে

সৌমিত্র দস্তিদার

এতো তাড়াতাড়ি নির্বাচন সম্পর্কে কোন প্রেডিকশন করা অতি বড় পণ্ডিতের পক্ষেও কঠিন কাজ। আমি তো সামান্য কলমচি মাত্র।

বিশেষ করে ভারতের মতো একটা বিশাল দেশ, যেখানে ভোটের ফলাফল নির্ধারিত হয় একাধিক কারণে। ভোটারদের প্রলোভন দেওয়া, টাকা পয়সা লেনদেন, কম্বল বিতরণ ইত্যাদি হাজারো বিষয় তো আছেই। পাশাপাশি এদেশের ভোটে জাতপাতের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এখনো পর্যন্ত যে দুই দফায় ভোট হয়েছে, সেখানে ইতিমধ্যেই বিজেপি ঈষৎ কোণঠাসা। তার কারণ সেই জাতপাতের জটিলতা। রাজস্থানে বিজেপির চিরাচরিত ভোট ব্যাঙ্ক ক্ষত্রিয়দের বড় অংশ নানা কারণে বিজেপির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

পশ্চিম উত্তর প্রদেশেও জাঠদের যেকোনো কারণেই হোক, এবার বিজেপি পছন্দের তালিকায় জায়গা পায়নি। ঠিক একইভাবে কর্নাটকের লিঙ্গায়েত ভোটের বড় অংশ বেশ অনেক দিন ধরেই বিজেপি বিমুখ। ফলে যেভাবে বাইরে থেকে অনেকের মনে হচ্ছে নরেন্দ্র মোদী সরকারের তৃতীয়বার ক্ষমতা আসা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।

তবে দুই দফা ভোটের পর বিজেপিকে অতটা আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে না। বিজেপি দলের মূল শক্তি, সবাই জানেন যে গো-বলয়। বিহার, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানাকেও বিজেপির ঘাঁটি বলে চিহ্নিত করা হয়। দীর্ঘ কৃষক আন্দোলনের পর থেকেই জাঠ, শিখ কৃষকরা ভারতীয় জনতা পার্টির ওপর যথেষ্ট ক্ষুব্ধ। তার প্রতিফলন ব্যালট বাক্সে প্রতিফলিত হলে অবাক হব না।

দক্ষিণ ভারতে তো চিরকালই বিজেপি কমজোরি। দক্ষিণে ব্রাহ্মণবাদী রাজনীতি বনাম দলিত রাজনীতির লড়াই বহু যুগের। এছাড়াও জাতপাতের সমীকরণ তো আছেই। ভারতে আর্য আগমনের সময় থেকেই বিন্ধ্য পর্বত অতিক্রম করে আর্যদের দক্ষিণ ভারত জয় মোটেও সহজ ছিল না। এদেশের যে প্রচলিত চিত্রকল্প, রাক্ষস-ভগবান লড়াই-দ্বন্দ্ব, বলা হয়ে থাকে তা মূলত আর্য অনার্য বিবাদ অবলম্বনে। ফলে আর্যাবর্তে রামচন্দ্রের মহিমা যত প্রচলিত, তার সিকিভাগ জনপ্রিয়তা দক্ষিণ ভারতে রামচন্দ্রের নেই। বরং সেখানে আজও রাবনের প্রতি একধরনের দুর্বলতা জনমনে স্পষ্ট।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বনাম তৃৃণমূল কংগ্রেসের যে বাইনারি তা হয়তো এবার কিছুটা ভাঙ্গবে। গতবারের চেয়ে বাম‐কংগ্রেস জোটের ফল এবার ভালো হবে নিশ্চিত। তৃণমূল কংগ্রেসের বড় ভরসা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। কিন্তু গত পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকেই ছবিটা পাল্টাচ্ছে। বাঙালি মুসলমানের বড় অংশ বাম-কংগ্রেস জোটের পক্ষে ফের ফিরছেন। এই অংশ অতীতে বামেদের অনুরাগী থাকলেও ২০১১ সালে চৌত্রিশ বছরের বাম শাসন হঠাতে তাদের বিরাট ভূমিকা ছিল। আসলে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচারের রিপোর্টে মুসলিম সমাজের যে করুণ ছবি তুলে ধরা হয়েছিল তা সর্বস্তরের মুসলিমদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। তারা দলে দলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকে ভোট দিয়েছিলেন।

কিন্তু এবার পরিস্থিতি অন্যরকম। গত পঞ্চায়েতের হিসেব দেখলেই বোঝা যায় যে, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গ্রামীণ এলাকাগুলোয় বাম-কংগ্রেস জোটের ভোট অনেক বেড়েছে। তার থেকেও উল্লেখযোগ্য যে বাম কর্মী সমর্থকদের শরীরী ভাষা অনেক চনমনে। পশ্চিমবঙ্গের ভোটে বাহুবলীদের ভূমিকা বিরাট। ২০১৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটে ব্যাপক সন্ত্রাস আজও মানুষের মনে আছে।

হালে ছবি অনেক পাল্টেছে। অন্য এক সম্ভাবনাও তাতে দেখা যাচ্ছে। বেশ কিছু কেন্দ্রে বাম-কংগ্রেস জোটের সঙ্গে ভাগাভাগিতে তৃণমূলের পরিবর্তে বিজেপি জিততে পারে।

যদিও পশ্চিম বঙ্গের ভোটের প্যাটার্ন সাধারণভাবে ভোটাররা একটি দলকেই ভোট দেয়। সেক্ষেত্রে খুব বেশি ভোট কাটাকুটি হবার সম্ভাবনা কম। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে মহিলা ভোটের বড় অংশ এখনো রয়েছে এটা মানতে হবে। বিজেপির ভরসা একমাত্র ধর্মীয় বিভাজন। বামেরা সেখানে শ্লোগান তুলেছে 'হক, রুটি-রুজি, জনতাই পুঁজি'। ভোটে জনতাই জনার্দন।

কিন্তু কথাটা সার্থক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রযোজ্য। নরেন্দ্র মোদির রাজত্বকালে গণতন্ত্র শব্দটি প্রহসনে পরিণত হয়েছে। বহুত্ববাদী সংবিধান লাঞ্ছিত হয়ে চলেছে প্রতিদিন।

কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন 'ইন্ডিয়া' জোট ইতিমধ্যেই জোর গলায় বলতে শুরু করেছে যে ফের ক্ষমতা পেলে নরেন্দ্র মোদির সরকার সংবিধান পাল্টে দেবে। দেখা যাচ্ছে জনগণের বড় অংশ কংগ্রেসের কথা শুনছেন এবং বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছেন। মুখে না বললেও বিজেপিও এটা বুঝেছে। তাই ঠাকুর ঘরে কে আমিতো কলা খাইনি স্টাইলে নিজে থেকেই বলতে লেগেছে যে আমরা কখনো সংবিধান বদলের কথা বলিনি। মজা হচ্ছে বিজেপির আসল চালিকাশক্তি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের যে নিজস্ব ক্যালেন্ডার সেখানে খোদ স্বাধীনতা দিবসের উল্লেখ নেই। ১৫ ই আগস্ট হিন্দুত্ববাদী আর এস এস, বিজেপির কাছে নিছক ঋষি অরবিন্দের জন্মদিন হিসেবে পালিত হয়। অবশ্য বিপ্লবী অরবিন্দ নন। বিজেপির কাছে আরাধ্য পন্ডিচেরী আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ঋষি অরবিন্দ।

এবারের নির্বাচনে বিজেপি দলটাই গৌণ হয়ে গেছে নরেন্দ্র মোদী নির্ভরশীল হতে গিয়ে। দলের ইস্তাহার থেকে টিভি ক্যাম্পেন, সর্বত্রই শুধু মোদির জয়ধ্বনি। মোদিই 'আচ্ছে দিনে'র একমাত্র গ্যারান্টি।

অথচ এর আগে নরেন্দ্র মোদী যা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার কটা তিনি রাখতে পেরেছেন তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে জনমনে। ভারতের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো নয়। বিমানবন্দর থেকে ডিফেন্স সব কিছু বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনী তহবিল, ইলকটোরাল বন্ড দুর্নীতি তো পৃথিবীর অন্যতম আর্থিক কেলেঙ্কারি। খোদ গুজরাটে নরেন্দ্র মোদী আপাতত স্বস্তিতে নেই। সবমিলিয়ে নরেন্দ্র মোদীর সরকার চাপে পড়েছে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। এখন দেখার চাপ মুক্তির কোনও উপায় নরেন্দ্র মোদী বের করতে পারেন কিনা! অথবা তার প্রাণের বন্ধু ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ভোটের মঞ্চে ধরাশায়ী হবেন কি-না, এর উত্তর পেতে আমাদের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫