
শেখর দত্ত। ফাইল ছবি
রাজনীতিতে তাৎক্ষণিক সুবিধা বা লাভের জন্য কিছু করাটা আপাত সুবিধা মনে হলেও তা কখনোবা বিপদের কারণ হতে পারে। ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বয়কট করলে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের নির্বাচন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তাতে ৩শ আসনের মধ্যে বিদ্রোহী প্রার্থীদের ৬২ জন বিজয়ী হন। সংখ্যাটা নেহাত কম নয়।
এ থেকে দলের ভেতরের পাল্টাপাল্টি অবস্থা আঁচ করা যায়। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ হয়েও তারা দলের সিদ্ধান্ত মোতাবেক আলাদা গ্রুপ করে রয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করার জন্য স্বতন্ত্র সদস্যদের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বাড়ি একটা, ঘর হয়েছে দুটো। দুই হাতই আমার।
এই দিক বিবেচনায় এখন পর্যন্ত সুবিধার মধ্যেই রয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু উপজেলা নির্বাচন ঘিরে তৃণমূলে যে পাল্টাপাল্টি দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে অনুধাবন করা যাচ্ছে, সংসদ নির্বাচনের পর দলাদলি চরমে পৌঁছেছে। অতীত থেকেই ব্যতিক্রম বাদে সম্মেলন ও নির্বাচন এলে বিভক্তি-পাল্টাপাল্টি কোথাও কোথাও তীব্র ও প্রকাশ্য রূপ নেয়। এমনও দেখা গেছে যে, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিদ্রোহী হয়ে জিতে কিছুদিন শোকজ কিংবা বহিষ্কারের টানাপড়েনের পর আবার সব ঠিক হয়ে যায়। এ বিষয়ে কথা উঠলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বলতে শোনা যায়, বড় দলে গ্রুপদ্বন্দ্ব-পাল্টাপাল্টি থাকবেই। ওপরে নেত্রী আর নিচে গণসমর্থন-এটাই হচ্ছে আওয়ামী লীগ। যতটুকু মনে হচ্ছে, সাম্প্রতিক অতীতে ১/১১-এর জরুরি আইনের সরকারের সময় ‘মাইনাস টু’ কার্যকর করতে যাওয়ার সময় ছাড়া কেন্দ্রীয় কার্যকর কমিটিতে এবারের মতো আর ভিন্নমত বা বিদ্রোহের প্রকাশ্য বহিঃপ্রকাশ এর আগে তেমনভাবে হয়নি।
কিন্তু আসন্ন উপজেলা নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগে গ্রুপ দ্বন্দ্ব-পাল্টাপাল্টি এমন চরমে উঠেছে, যাতে কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটিকেও স্পর্শ করেছে। উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ। বাস্তবে দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন পদ্ধতি চালুর আগে স্থানীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বহু প্রার্থী থাকতই। তাই স্থানীয় নির্বাচনে বহু প্রার্থী এবং প্রার্থীদের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে পাল্টাপাল্টি নতুন বিষয় নয়।
কিন্তু বাদ সাধে যখন দলীয় মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়-স্বজনই প্রার্থী হয়ে যায়। অতীতেও এমন হয়েছে এবং তাতে এমপি-মন্ত্রী-নেতারাই এলাকা সম্পূর্ণভাবে নিজেদের করায়ত্ত করে নিয়েছেন। এবারেও বেশ কতক এলাকায় আর্থিক সিন্ডেকেটের মতোই আত্মীয়-স্বজন নিয়ে রাজনৈতিক সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। তাতে আওয়ামী লীগ আত্মীয়-স্বজন প্রার্থীদের পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়। কিন্তু তা কার্যকর সম্ভব হয় না। নাটোরে অপহরণ-মারধরের মতো ঘটনা ঘটে। অনভিপ্রেত ঘটনার পর প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের শ্যালক নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর সংকটের অবসান হয়েছে।
কিন্তু গোল বাধে মাদারীপুরে। দলীয় নির্দেশ উপেক্ষা করে শাজাহান খানের ছেলে চেয়ারম্যান পদে দাঁড়িয়ে যান। এ নিয়ে বিগত ২৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে প্রকাশ্যে বিতর্কে জড়ান সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান। সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ সামনে এনে সাধারণ সম্পাদক কথা বললেও বিতর্ক থামে না। সম্পাদকের সঙ্গে প্রকাশ্য বিতর্ক আওয়ামী লীগে বিরল ঘটনা বৈ কি!
প্রসঙ্গত বিগত ২৭ এপ্রিল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে প্রশাসনের আলোচনার সময় ডিসি ও এসপিরা মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব ও হস্তক্ষেপ নিয়ে গভীর শংকা প্রকাশ করেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার যে কোনো মূল্যে নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হবে বলে বক্তব্য দেন। এদিকে এমপি-মন্ত্রীর স্বজনদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারে কঠোর নির্দেশ এবং দল থেকে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি দিলেও কাজ না হওয়ায় ৩০ এপ্রিল কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভা আহ্বান করা হয়েছে। সভায় উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে বলে জানা গেছে।
এদিকে জানা গেল সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান প্রশ্ন তুলেছেন, ‘স্বজন রাজনীতি করলে ভোটে কেন নয়?’ ব্যবসার মতো দলীয় রাজনীতিতে পারিবারিক সিন্ডিকেট, কোটারি বা একচেটিয়াত্ব অবস্থা সৃষ্টি হোক, তা গণতান্ত্রিক মতের মানুষ কেউই চাইতে পারেন না। ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগে তো নয়ই। তবে কর্মজীবনের প্রথম থেকে রাজনৈতিক দল করার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, আত্মীয়-স্বজন দল করলে দলীয় পদ বা সুযোগ লাভ তারা করতে পারবেন না কেন-এই প্রশ্ন বড় দলে যেমন উঠেছে, তেমনি ছোট দলেও থাকে। ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’ ও ‘নাগরিক অধিকার’, ছেলে ও বাবা ‘দুই ব্যক্তি’ প্রভৃতির পক্ষে যেমন যুক্তি আছে, তেমনি দল করলে দলীয় সিদ্ধান্ত মানার বিষয়টিও একেবারেই উপেক্ষা করার মতো নয়।
অতীত থেকে আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী প্রার্থী বিজয়ী এবং এমনকি পরাজিত হলেও শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য কোনো শাস্তি দেয়নি। দলীয় মন্ত্রী-এমপি-নেতা কারও মৃত্যু হলে দল না করলেও বা দলে সক্রিয় না থাকলেও স্ত্রী-পুত্র-আত্মীয়দের নির্বাচনে প্রার্থী করেছে। জেলাসহ তৃণমূলের কমিটিগুলো যখন নেতা-মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়-স্বজন দিয়ে করা হয়েছে, তখনো কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। ফলে দেশের বৃহত্তম ও ঐতিহ্যবাহী গণআস্থাসম্পন্ন দল, যে দল মুসলিম লীগের জমিদার-মহাজন তথা উচ্চবংশীদের কোটারি ভাঙতে না পেরে আলাদাভাবে গণতান্ত্রিক পার্টি হিসেবে জন্ম নিয়েছে, সেই দল আওয়ামী লীগে তৃণমূলে আজ কোটারি হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু দলে গণতন্ত্র ও গঠনতন্ত্র সুরক্ষার স্বার্থে ১৯৫৭ সালে মন্ত্রীপদ ছেড়ে দিয়েছিলেন। ১৯৫৭ সালের কাউন্সিলে পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে ভোট হয়। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী পান ৫শ আর সভাপতি মওলানা ভাসানী ৩৫ ভোট। ভোটেই আওয়ামী লীগের ভাগ্য নির্ধারিত হতো। স্বাধীনতার পর বাকশাল গঠনের আগে দলীয় গণতন্ত্রকে অবারিত করার জন্য ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু সভাপতির পদ ছেড়ে দেন। আওয়ামী লীগ দলের রয়েছে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য। বর্তমানে দলীয় পাল্টাপাল্টির যা অবস্থা, তাতে আদেশ-নির্দেশ কাজ দিলে ভালো। তবে অভিজ্ঞতা বলে, রাজনৈতিক দলে ‘কমান্ড মেথড’ তাৎক্ষণিক ফল দিলেও ভবিষ্যতে ক্ষতির কারণ হয়। রাজনৈতিক দলে কমান্ড রাখতে হয়, গণতন্ত্রকে সংকুচিত করার জন্য নয়, ক্রমে প্রসারিত করার জন্য।
বর্তমানে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি রয়েছে লেজেগোবরে অবস্থায়। পত্রপত্রিকার খবরে জানা যাচ্ছে, দায়িত্বশীল নেতাদের অকার্যকর ভূমিকা, কর্মীদের পাশে না দাঁড়ানো ও সমন্বয়হীনতা এবং সর্বোপরি লন্ডন থেকে ‘ডিসিশন’ আসার কারণে বিএনপি রয়েছে তালগোল পাকানো অবস্থায়। দলীয় সিদ্ধান্ত ভেঙে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় সর্বশেষ ৭৩ জন নেতাকে বিএনপি বহিষ্কার করেছে। বয়কট-বর্জনের ভেতর দিয়ে দলটি রয়েছে জনগণ ও কর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায়। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল বিএনপির এই অবস্থা আওয়ামী লীগকে দিচ্ছে ফাঁকা মাঠ। আওয়ামী লীগ পাচ্ছে সময়ও।
এই সুযোগ ও সময়প্রাপ্তির মধ্যে আওয়ামী লীগ যদি দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা ও সংস্কৃতি সম্প্রসারণ করতে পারে, তবে কেবল দল নয় , দেশের গণতন্ত্রের জন্যও তা ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে বলে মনে করার যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বঙ্গবন্ধুর সময় দেশের রাজনীতি ছিল এগিয়ে আর অর্থনীতি ছিল পিছিয়ে। আর এখন অর্থনীতি গেছে অনেক এগিয়ে, রাজনীতি আছে পিছিয়ে।
রাজনীতি-অর্থনীতির অসামঞ্জস্যতা থেকেই অস্থিরতা-অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয় এবং বিয়োগান্তক সব ঘটনা ঘটে।
বর্তমানে সৃষ্ট অসামঞ্জস্যতা দূর করা ভিন্ন বিকল্প আর কিছু নেই। সময়ের দাবি এটাই। প্রয়াত আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের একটি কথা এ ক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য : আওয়ামী লীগ পাল্টালে দেশ পাল্টাবে। দেশ রাজনীতি-অর্থনীতি দুদিক থেকেই এগিয়ে যাক, এটাই আজকের দিনের একান্ত কামনা।
শেখর দত্ত
কলাম লেখক, রাজনীতিক