
হাসান হামিদ। ফাইল ছবি
টানা কিছুদিন দাবদাহের পর মের ২ তারিখে বৃষ্টি হয়েছে ঢাকায়। অবশ্য এপ্রিলে দেশের অন্তত তিন বিভাগে কোনো বৃষ্টিই হয়নি। লম্বা বিরতির পর বৃষ্টিতে অনেকেই স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এর মাঝে মনে এক আতঙ্ক উঁকি মারছে। সেটি হলো ডেঙ্গু। বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে এর প্রকোপ সমানে বাড়তে থাকবে।
আমরা গত বছরের কথা ভুলিনি। ২০২৩ সালে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। সারা দেশে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। এর বাইরে নিশ্চয়ই আরও কয়েক লাখ লোক ভুগেছেন, কারণ সবাই জ্বর হলে হাসপাতালে যান না। আর শুধু গত বছরই ডেঙ্গুতে ১ হাজার ৭০৫ জন মানুষ মারা গেছেন। দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে এটাই এক বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যু। এবার বছরের শুরু থেকে বিশেষজ্ঞরা অবস্থা আরও খারাপের দিকে ইঙ্গিত করছেন। কিন্তু এ নিয়ে দায়িত্বশীল কারও কার্যক্রম আমরা দেখছি না। অন্য কোনো অসুখ নয়, মশার কামড় খেয়ে দেড় হাজারের বেশি মানুষ মারা গেল, এ নিয়ে কারও যেন মাথাব্যথা নেই। আমলারা তাদের সন্তানদের জন্য আলাদা ইউনিভার্সিটি চান, তাদের বেশিরভাগের লক্ষ্যও এখন অবৈধ অর্থ কামানো। নইলে মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের ট্র্যাক ছেড়ে কেন প্রশাসক হতে চায়? সরকারি দলের নেতারা কীভাবে জনগণের টাকা আরও মেরে বিত্তশালী হওয়া যায় সেই চিন্তায়। সাধারণ মানুষদের নিয়ে ভাববে কে?
দুই সিটি করপোরেশন গতানুগতিক ও দায়সারা কাজ করছে। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা আমরা দেখছি না। ঢাকায় অনেক নির্মাণাধীন ভবন আছে। এসব জায়গায় এডিস মশার লার্ভা বেশি থাকে। সিটি করপোরেশন এসব জায়গায় যায়, জরিমানা করে। শুধু জরিমানা করে কোনোভাবেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। পত্রিকায় পড়ে জেনেছি, গত ২ বছরের তুলনায় এ বছর এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব বেশি পাওয়া গেছে। বিষয়টি সিটি করপোরেশনকে জানালেও তাদের কোনো ব্যবস্থাই নিতে দেখা যায়নি। অথচ এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সারা বছর কাজ করলে এর ফলাফল পাওয়া যেত।
খবরে প্রকাশ, দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছর ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। মারা যাওয়া এই ব্যক্তিদের ১৪ জন নারী ও ১৩ জন পুরুষ। আর এ বছর দেশে ডেঙ্গু নিয়ে এখন পর্যন্ত ২ হাজার ২৪৮ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। জানা কথা, আমাদের এখানে প্রতিবছর বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকে। ডেঙ্গু আগের চেয়ে বাড়ছে সেটা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক রিপোর্ট অনুযায়ী গত বিশ বছরে পৃথিবীতে ডেঙ্গুর সংক্রমণ আটগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর পৃথিবীর অন্তত ১২৯টি দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞানীরা ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য চেষ্টা শুরু করেন ১৯২০ সালে। স্বাস্থ্য বিষয়ক এক ম্যাগাজিনে পড়লাম, কেন ১৯২০ সালে শুরু হলেও এর ভ্যাকসিন বাজারে আসতে অনেক দেরি হয়েছে। ডেঙ্গুর চারটি উপধরন আছে। এগুলো হচ্ছে ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪। অবশ্য আফ্রিকার একটি মাত্র স্থানে ডেন-৫ ধরনের ভাইরাস পাওয়া গিয়েছে। তবে এর ব্যাপ্তি ঐ নির্দিষ্ট স্থানের বাইরে ছড়ায়নি বলে ডেন-৫কে সাধারণ আলোচনার বাইরে রাখা হয়। ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের বৈশিষ্ট্য হতে হবে একটি ভ্যাকসিন দিয়ে চার উপধরনের ভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষাশক্তি তৈরি করা। এই সমস্যার সমাধান করতে না পারার জন্যই ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা যাচ্ছিল না।
ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে সফল ভ্যাকসিন তৈরির প্রথম ঘোষণা আসে ২০১৫ সালে। যৌথভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সানোফি ও লুই পাস্তুর ইনকরপোরেশন এই ভ্যাকসিন তৈরি করে। তাদের ভ্যাকসিনের নাম রাখা হয় ‘ডেঙ্গভ্যাকসিয়া’। শুরুতে দাবি করা হয়েছিল, তাদের এই ভ্যাকসিন ডেঙ্গুর সবগুলো উপধরনের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে পারবে। কিন্তু পরে দেখা গেল যারা আগে ডেঙ্গুর কোনো একটা উপধরন দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে কেবল তাদের শরীরে এই ভ্যাকসিন প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে। যারা আগে সংক্রমিত হয়নি এমন কাউকে ডেঙ্গভ্যাকসিয়া প্রয়োগ করা হলে তাদের দেহে ডেঙ্গুর তীব্র সংক্রমণের মতো লক্ষণ ও উপসর্গ হতে পারে। এসব কারণে এই ভ্যাকসিনকে গণটিকা দান কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
এরপর ২০২২ সালের শেষ নাগাদ জাপানের টাকেদা ফার্মাসিউটিক্যালস একটি ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ঘোষণা দেয়। সেটার নাম ‘TAK-003 (Tetravalent Dengue Vaccine Candidate)’ আর এর বাণিজ্যিক নাম হচ্ছে ‘কিউডেঙ্গা’। এই ভ্যাকসিন ডেঙ্গু ভাইরাসের সবগুলো উপধরনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে সক্ষম। তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালেও এই ভ্যাকসিন কার্যকর ও নিরাপদ প্রমাণ হয়েছে। কিউডেঙ্গা ৬ বছর ও তার বেশি বয়সের সবাইকে দেওয়া যায়। দুটি ডোজ দিতে হয়। প্রথম ডোজ দেওয়ার তিন মাস পর দ্বিতীয় ডোজ দিতে হয়। এতে শরীরে জীবনব্যাপী প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। এটি ইনজেকশনের সাহায্যে চামড়ার নিচে দিতে হয়। কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন ডেঙ্গুর লক্ষণ ও উপসর্গ প্রতিরোধ করে ৮০.২০ শতাংশ এবং হাসপাতালে ভর্তি কমায় ৯০.৪০ শতাংশ। কিউডেঙ্গার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অতিসাধারণ ও খুব কম। ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইউকে, আইসল্যান্ড, জার্মানি, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডসহ অনেকগুলো দেশ কিউডেঙ্গা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। ডেঙ্গু সংক্রমণে জর্জরিত দেশ ইন্দোনেশিয়া ৬ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের জন্য কিউডেঙ্গার গণটিকা দেওয়া শুরু করেছে।
ডেঙ্গুর ভ্যাকসিনের বিষয়ে আমরা কী ভাবছি? ২০২৩ এ ডেঙ্গুতে দেড় হাজার মানুষ মারা গেল, তারপরও কি ভ্যাকসিনের ব্যাপারে চিন্তা করবে না কর্তৃপক্ষ? দেশজুড়ে এত উন্নয়নের গল্প, মানুষ যদি না বাঁচে সেই উন্নয়ন কার জন্য? আমাদের বুঝতে হবে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় আমরা কত দুর্বল এখনো। এবার যদি সমগ্র বাংলাদেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে যায়, তবে এর জন্য যে পরিমাণ সম্পদ ও প্রশিক্ষিত জনবল স্বাস্থ্য খাতে থাকা দরকার, এর কিছুই আমাদের নেই। এজন্য সামগ্রিক বিবেচনায় আমাদের ডেঙ্গু ভ্যাকসিন প্রয়োগের কথা ভাবা দরকার।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট