Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

বই টাকা বউ চুরি ও মহৎ কাজসমূহ

Icon

আফসান চৌধুরী

প্রকাশ: ১৩ মে ২০২৪, ১৯:১২

বই টাকা বউ চুরি ও মহৎ কাজসমূহ

আফসান চৌধুরী। ফাইল ছবি

শ্রাবণ প্রকাশনীর প্রধান দারওয়ান রবিন আহসানের দুনিয়া বই নিয়ে গঠিত। সে মানিকগঞ্জে এক বইবাড়ি বানাচ্ছে, যার ফোকাস হবে বাচ্চা ও শিশু পাঠকবৃন্দ। রবিনের ব্যবসায়িক বুদ্ধি কম, এমনকি ২৫ বছর আগেও আমার বই ছাপিয়েছে, যার মানে হয় না। ও বলে তখন সব বই বিক্রি হয়ে যেত, আমার মতো স্বল্প চেনা লেখকেরও।

কিন্তু আজকের রবিনের বইয়ের দুনিয়া কঠিন। কিন্তু বইয়ের প্রতি তার ভালোবাসা কমেনি। আর তার প্রতি কমেনি আমার স্নেহ। তাই আমি ওকে আর বই দেই না। জানি লোকসান খাবে, কিন্তু বলবে না আমাকেও। তাই বোঝাটা একটু কমাই আর কি। তবে সে তার চলার পথ ঠিক করে নিয়েছে। পড়ুক, মরুক, ওই পথে যাবেই। গালি গালাজ সব জোটে তার জীবনে, তাও যাবে। এই রকম পাগল, তবে পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না।

দুই

এবার তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছে কীভাবে তিনটি বাচ্চা পাঠক অভিনব কায়দায় বই চুরি করে পালাচ্ছে। রবিন দেখে ফেলে কিন্তু কিছু বলেনি। বইই তো নিয়েছে, পড়বে, ভালোই। আমাদের চোখেও এই বয়সে বই, ফল ‘চুরি’ করাটা ‘পাপ’ না। নজরুলের লিচু চোর কবিতা সাক্ষী। আমি নিজেও একবার বই চুরি করি, কমিক, করাচিতে। তবে কিনা এমনি বাজে লাগে যে দোকানে গিয়ে চুপিসারে ফেরত দিয়ে আসি। বই চুরিতে নাকি সমাজে জ্ঞানবিদ্যার সার্কুলেশন হয়। কিন্তু এটাও ঠিক যে চুরি করার ইচ্ছাটা সহজাত। ‘আমার চাই’ থেকে এর যাত্রা শুরু। 

তিন

‘দুর্নীতি’ বিষয়ক গবেষণায় আগে আগ্রহ ছিল, কিন্তু এখন বোরিং লাগে, বিষয়টা এত ডালভাত যে টানে না। কয় বছর আগে এক জরিপ করি দুর্নীতির অভিজ্ঞতা নিয়ে। প্রশ্নটা ছিল, সরকারি কাজ করতে গিয়ে আপনাকে ঘুষ দিতে হয়েছে কিনা। আমাদের রেজাল্ট আসে ৮৯%। অর্থাৎ প্রায় সবাই। আমার একটু খটকা লাগে, তাই গবেষণা কর্মীদের ওই ১১% মানুষের কাছে আবার পাঠাই। তারা ফিরে এসে বলে, সেই ‘এগারোজন’ বলেছে, “ওটা কি ঘুষ ছিল নাকি? ওটা তো কাজের অংশ। ঘুষ তো হলো যা প্রাপ্য নয় সেটা করিয়ে নেওয়ার জন্য যে টাকা খরচ করতে হয় সেটা।” অতএব ঘুষেরও নানা মানে, শ্রেণি আছে। নজরানা, গিফট তো ঘুষ নয়। আরও কত কিছু চুরি নয়!

চার

বই চুরি যদি কিছু নাও হয় তবে বউ চুরি এখনো বড় চুরি। তবে এটা আজকাল অহরহ ঘটছে। দ্বিতীয় স্ত্রী আর স্বামী সমান পপুলার। লালনের ভাষায়, “তোমার সাথে বসত করে কয়জনা?” পরকীয়া এখন নিউ নরমাল। যে ঘুষ খাবার ক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি, সেও বউ/স্বামী চুরি করে। চাহিদা পাল্টায় সমাজ পাল্টানোর সঙ্গেও। সোশ্যাল মিডিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় বিষয়, নাটক থেকে ডকুমেন্টারি সব পাবেন এর ওপর। এটা আধুনিক জীবনের অভিশাপ, সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র ইত্যাদি? না ভাই, এটা সারা দুনিয়ার চিত্র। এটাই সত্য, এটাই বাস্তব।

পাঁচ

মানুষের অর্থনীতি আগে ছিল একমাত্রিক, এখন বহু। আগেও চুরির প্রবণতা ছিল, কিন্তু পণ্য ছিল কম, তাই অন্য সংকট ছিল। অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সামাজিক পরিবর্তন হতে বাধ্য। আগে সংসার না টিকলে জীবন চলত না নারী পুরুষ, কারও। এখন টাকা রোজগার থেকে কাজের বুয়া দুটোই অনলাইনে পাওয়া যায়। এটা তো নতুন বাস্তবতা, তাই নতুন সমাজ হবেই। সমাজ নৈতিকতার নয়, সুখের সন্ধানী। ধর্ম সব ক্ষেত্রে এটা করার চেষ্টা করে, কিন্তু আমাদের দেশে মানুষ ধর্ম চর্চা ও ঘুষ, পরকীয়া চর্চা দুটোই করে। একটা পরকাল, অন্যটা ইহকালের জন্য। আগে জীবন ভালো ছিল না, ক্ষুধা দারিদ্র্য ছিল অনেক। এখন তা নেই, তার বদলে এসেছে-নতুন কিছু বিষয়। এটাই মানব ইতিহাসের নিয়ম। 

ছয়

সমাজে আগে টিকতে হলে অন্যদের দরকার ছিল, আজ তেমন নয়। আজ মানুষ নিজে চলতে পারে, তাই গোষ্ঠীগত ভালো মন্দের বিচার-বিবেচনা কম, প্রয়োজন আরও কম। এই দেশের আইনে নিয়ম ভাঙলেও চলে লাইন থাকলে। অতএব বাকিগুলোর তো ভাঙার শাস্তিও নেই। ধরা পড়লেও ব্যবস্থা হয়। তাই রবিন যেমন অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে চুরি দেখে, আগামীর কল্যাণ ভেবে, অন্যরা তাকিয়ে থাকে অন্য দিকে নিজের কল্যাণর আশায়। যার যেটা। 

বই চুরি করলেই সে পড়ে ভালো মানুষ হবে তা নয়। আজ বই, কাল টাকা পরশু দিন বউ চুরি করতে পারে। তবে বইপ্রেমী রবিন কী করবে সেটা জানা, প্রমাণিত। এক সত্য সবার জন্য নয়, সবাই এক সত্যের জন্য নয়, এটাই বাস্তবতা।


লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫