Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

দেশপ্রেমী নজরুল

Icon

গাজী তানজিয়া

প্রকাশ: ২০ মে ২০২৪, ১৭:১১

দেশপ্রেমী নজরুল

গাজী তানজিয়া। ফাইল ছবি

১৯ শতকে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে স্বাধীনতার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত এক কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সমকালীন ও পূর্ববর্তী কবিদের তুলনায় তার রাজনীতি-মনস্কতা অনেকটাই বেশি। কিশোর বয়সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিতে চলে যাওয়া তার একটি প্রমাণ। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে পৃথিবীব্যাপী হতাশা, মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পরিবেশে বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম এক ধূমকেতুর নাম। ১৯১৯ সালে ‘ব্যথার দান’ গল্পে যে দেশপ্রেম ফুটে উঠেছিল এজন্য কলকাতার একটি প্রেস গল্পটি ছাপতে রাজি হয়নি। শুধু দেশপ্রেম নয়, নজরুলের এই গল্পের আন্তর্জাতিকতা বাংলা সাহিত্যের জন্য একটি নতুন দিক বলতে হবে। গল্পের দুই প্রধান চরিত্র যোগ দিয়েছিল ‘লাল ফৌজে’। এ ‘লাল ফৌজ’ মূলত রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লবকে বাঁচানোর জন্য রুশ দেশের ভিতরে মজুর শ্রেণির পার্টি ও সোভিয়েত রাষ্ট্রের নেতৃত্বে জনগণ যে সৈন্যদল গঠন করেছিল তার নাম। সেই সময়ে ব্রিটিশ-ভারতের গভর্নমেন্ট চারদিক থেকে আটঘাট বেঁধে ফেলেছিল যেন অক্টোবর বিপ্লবের ছোঁয়া কোনোভাবেই ভারতে প্রবেশ করতে না পারে। সেই লাল ফৌজে ব্রিটিশ ভারতের লোকেরা যোগ দেবে, সেটা যদি গল্পের ভিতরেও হয়, পুলিশের পক্ষে তা হজম করা কঠিন। তাই কমরেড মোজাফ্ফর আহমদ গল্পটি পত্রিকায় প্রকাশ করার সময় ‘লাল ফৌজ. কেটে ‘মুক্তি সৈন্যদের দল’ বসিয়ে দিয়েছিলেন। 

ব্রিটিশ আমলে বাঙালিদের ফৌজে ভর্তি করা হতো না। বাঙালিদেরকে ব্যবহার করা হতো ব্রিটিশ সরকারের কেরানি হিসেবে। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অনেক লেখালেখি হতে লাগল যে বাঙালিদেরও সৈন্যদলে ভর্তি করা হোক। শেষ পর্যন্ত ১৯১৭ সালে ভারতের ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট একটি বেঙ্গলি ডবল কোম্পানি গঠন করতে রাজি হলো। নজরুল যুদ্ধবিদ্যা শিখেছিলেন। ভারতবর্ষে এক বিরাট সৈন্যবাহিনী গঠন করে, দেশ থেকে ইংরেজদের তাড়াবেন, এই ছিল তার বাসনা। পল্টন থেকে ফিরে এসে সৈন্য বাহিনী গঠন করে দেশ স্বাধীন করতে না পারলেও তিনি তার কলমটি অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ‘নবযুগ’ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে তিনি গরম গরম সব প্রবন্ধ লিখতে শুরু করলেন। যে কারণে পরপর তিনবার সরকার পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশককে সতর্ক করেছিল। অসত্য অমঙ্গল অকল্যাণের গ্রাস থেকে তিনি মুক্ত করতে চেয়েছেন স্বদেশের মাটি আর মানুষকে। যুদ্ধোত্তর বিরুদ্ধ প্রতিবেশে দাঁড়িয়েও গেয়েছেন জীবনের জয়গান, উচ্চারণ করেছেন ঔপনিবেশিক শক্তির শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য বিদ্রোহের বাণী। কমরেড মুজফ্ফর আহমদের মতে, নজরুলই প্রথম ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানান। 

১৯২০ সালের ৬ জানুয়ারি বিজলী পত্রিকায় প্রথম কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশ হয়। কমরেড মুজফ্ফর আহমদের মতে, সেদিন কমপক্ষে দুই লাখ মানুষ ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটা পড়েছিল। কবিতাটিতে দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা এবং অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালি মানসে ‘চির উন্নত মম শির’ হিসেবে বিরাজমান। 

নজরুলের রাজনৈতিক ভাবনায় যথেষ্ট অস্থিরতা ছিল। কারণ ১৯২০ থেকে ১৯৪০ এই দুই দশক অখণ্ড ভারতের রাজনীতিতে ছিল বহু ভাষার আবর্ত। অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদে আকৃষ্ট হয়ে পড়তেন। কংগ্রেসের রাজনীতি, সাম্যবাদের আদর্শ, সশস্ত্র বিপ্লববাদের লক্ষ্য এই তিনের প্রতিই বিভিন্ন সময়ে আকর্ষণ দেখা গেছে নজরুলের। সে সময়ে মুসলিম লীগও ছিল। কিন্তু নজরুল সেখানে যোগ দেননি। চিত্তরঞ্জন দাস ও সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে পরিচয় ছিল তার। কংগ্রেস থেকে উদ্ভূত লেবার স্বরাজ পার্টির সদস্য ছিলেন তিনি। আবার কংগ্রেসের সঙ্গেও ছিলেন। পরে মুজফ্ফর আহমদের সান্নিধ্যে পৌঁছে সাম্যবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, যদিও পার্টি সদস্য ছিলেন না। তবে পার্টির জন্য বিশ্ব ইতিহাসের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজনৈতিক কবিতার বঙ্গানুবাদ করেছিলেন নজরুল। কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক গণসংগীত লিখেছিলেন ফরাসি শ্রমিক ইউজিন পাতিয়ের। গানটির ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন অপটন সিনক্লেয়ার। সেটাকে ‘অন্তর ন্যাশনাল সংগীত’ নাম দিয়ে বঙ্গানুবাদ করেন নজরুল। ‘নব ভিত্তি পরে নব নবীন জগৎ হবে উত্থিত রে। শোন অত্যাচারী! শোন রে সঞ্চয়ী-ছিনু সর্বহারা-হব সর্বজয়ী।’ (গণবাণী, ২১ এপ্রিল, ১৯২৭)। 

‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ১৯২২-এর ২২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ লেখার জন্য কারারুদ্ধ হন নজরুল। লিখেছিলেন, ‘দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি পূজা/দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্তমাগে দশভুজা।’ ‘বিষের বাঁশী’তে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি উচ্চারণ করেছেন। বাজেয়াপ্ত হয়েছিল ‘বিষের বাঁশী’ (১৯২৪)। তা ছাড়া নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত হয়েছিল তার ‘ভাঙার গান’ (১৯২৪), প্রলয় শিখা (১৯৩১), চন্দ্রবিন্দু (১৯৩১)। প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘যুগবাণী’ (১৯২২), আর ‘দুর্দিনের যাত্রী’ (১৯২৬) বাজেয়াপ্ত হয়। কারারুদ্ধ হয়ে বিচারের সময় আদালতে দাঁড়িয়ে নির্ভয়ে যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন নজরুল, তাও এক জ্বলন্ত রাজনৈতিক কবিতা। শান্তিকামী মানুষের মাথার ওপরে ইংরেজ-শাসকদের দুঃশাসন, লুটপাট ও এ দেশেরই পদলেহী দালালরা অশান্তি ও রক্তের প্লাবন নামিয়ে দিয়েছিল যখন, সেই সময়ে ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বনকারী কবির কবিতায় উচ্চারিত হয়, ‘জাগো অনশন বন্দী ওঠ রে যত, জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত জাগো’। 

সর্বপ্রথম ‘ধূমকেতু’ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। সেখানে তিনি লেখেন, “স্বরাজ টরাজ বুঝি না। কেননা এ কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশ বিদেশির অধীনে থাকবে না। প্রার্থনা বা আবেদন-নিবেদন করলে তারা শুনবে না, আমাদের এই প্রার্থনা করার ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে। এ কথা পরিষ্কার যে, শুধু স্বাধীনতা নয়, দরকার ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’। আর আবেদন-নিবেদনে এই পূর্ণ স্বাধীনতা মোটেই সম্ভব নয়।” নজরুল একেবারে খাঁটি সত্যটা চাঁছাছোলা ভাষায় ঘোষণা করেছেন এখানে। 

‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতাটি তারই একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গান্ধী বলেছিলেন ‘এক বছরের মধ্যে এ দেশে স্বায়ত্তশাসন ও স্বরাজ এসে যাবে’। এই বলে দেশের মানুষকে আশা দিয়েছিলেন এবং আন্দোলন বন্ধ রেখেছিলেন। ফলে বিরূপ হয়েছিল দেশবাসী।

নজরুলের কবিতায় শোষকের বিরুদ্ধে, জুলুমের প্রতিবাদে বন্দি, কারারুদ্ধ মজলুমের বা বিপ্লবীর শেকল ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়ার এক দুর্দান্ত আহ্বান ছিল সেই উত্তাল সময়টায়। যা শাসককে করেছে শঙ্কিত। আর তিনি হয়ে উঠেছেন দ্রোহের কবি। যার মতো দ্রোহী, মুক্তিকামী কবি সারা বিশ্বে আর একজনকেও খুঁজে পাওয়া যায় না।


লেখক: কথাসাহিত্যিক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫