
প্রণব চক্রবর্তী। ফাইল ছবি
সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস আয়কর ও ভ্যাট। বাজেট এলেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তাই হামলে পড়ে আয়কর ও ভ্যাটের নতুন ক্ষেত্রের খোঁজে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসে আমাদের ভর্তুকি দিতে হয়। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ সব ধরনের ভর্তুকির বিপক্ষে। কিন্তু তা সত্বেও কিছু কিছু ভর্তুকি ও প্রণোদনা বন্ধ করার সুযোগ নেই। ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভর্তুকি কমালেও অনেক ক্ষেত্রে এই ভর্তুকি ও প্রণোদনা অব্যাহত রাখতে হয় সরকারকে।
গণপরিবহন হিসেবে রেল খাতে কিংবা বিআরটিসির জন্য সরকার লাভের চিন্তা না করে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে থাকে। মেট্রোরেল এর ব্যতিক্রম নয়। সম্প্রতি মেট্রোরেলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। এটি রীতিমতো আতঙ্ক তৈরি করেছে। বিশ্বব্যাপী তেল, গ্যাসসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা বাংলাদেশেও এসে পড়েছে। ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হারের অবনমন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। নিম্ন ও নির্ধারিত আয়ের মানুষকে দিনাতিপাত করার জন্য কঠোর সংগ্রাম করতে হচ্ছে। এই অবস্থায় মেট্রোরেলের ভাড়াবৃদ্ধি তাদের জন্য নতুন সমস্যার সৃষ্টি করবে।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মেট্রোরেলের ভাড়ায় ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানোর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছেন মর্মে এক অনুষ্ঠানে উল্লেখ করেছেন। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, পৃথিবীর কোন দেশে মেট্রোরেলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে? তার বক্তব্য গুরুত্ব বহন করে নিঃসন্দেহে। এই প্রশ্ন জনতারও বটে।
অন্যদিকে এনবিআরের মত হচ্ছে-উপায় নেই। রাজস্ব খাতে টাকা জোগাড় করতে হবে। উৎস পেলে তা ছেড়ে দিলে চলবে না। কিন্তু পরিস্থিতি সামাল দিতে বেসামাল ব্যবস্থাপনা জনজীবন দুর্বিষহ করে তুলতে পারে সে কথা ভুললে চলবে না।
কোভিডপরবর্তী সময়ে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় অন্যতম সংযোজন মেট্রোরেল। সরকারি সড়ক পরিবহন সংস্থা বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ সত্ত্বেও গত ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি।
এমন পরিস্থিতিতে মেট্রোরেল স্বল্পমাত্রায় হলেও ভ্রমণসময় হ্রাস ও ব্যয়ে কিছুটা হলেও স্বাচ্ছন্দ্য যোগ করেছে। এই ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ না করাটাই এখন উচিত মর্মে অনুমিত হয়। পিক আওয়ারে প্রচণ্ড ভিড় সত্ত্বেও যাত্রীদের স্বস্তি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, দ্রুত যেতে পেরে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থ সাশ্রয়ে তারা ভিড় মেনে নিচ্ছেন হাসি মুখে।
মেট্রোরেল বিদ্যুৎ পরিবাহিত বিধায় কার্বন নিঃসরণ কমাতেও ভূমিকা রাখছে। আমরা যোগাযোগমন্ত্রীর তুলনা অনুযায়ী ভারতের মেট্রোরেলের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই ১৫টি ভারতীয় শহরে মেট্রোরেল চলাচল করে। কলকাতা মেট্রোর সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ টাকা ও সর্বোচ্চ ভাড়া ২৫ টাকা। এটি প্রতিদিন প্রায় ৭ লাখ যাত্রী পরিবহন করে। মেট্রো পরিচালনার দায়িত্বে আছে দুটি কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে দিল্লি মেট্রো প্রতিদিন ৪০ লাখ যাত্রী পরিবহন করে। ৩৪৮ কিমি এলাকাজুড়ে এর বিস্তৃতি। ভাড়া সর্বনিম্ন ১০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১০০ টাকা। চেন্নাই, বেঙ্গালুরু বা মুম্বাইতে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা আর সর্বোচ্চ ভাড়া ৫০ টাকা বা এর কম।
এই বিবেচনায় আমাদের দেশে ধার্য ভাড়াও প্রায় সম পর্যায়ের। লক্ষ করলে দেখা যাবে, মেট্রোরেল যোগাযোগে শ্রমঘণ্টা অপচয় রোধ করে। ফলে নগরবাসী কেন্দ্রের পরিবর্তে পরিধিমুখী বসবাসে আগ্রহ দেখান। ব্যক্তিমালিকানাধীন গণপরিবহনও অযাচিত যাত্রীর দেখা পেয়ে আইনকানুন ভুলে ইচ্ছেমাফিক চলাচলের আগ্রহ সংযত করতে বাধ্য হয়। তাই মেট্রোরেল ব্যবহারে যাত্রীদের উৎসাহিত করার আবশ্যকতাও কম নয়।
মেট্রোরেল বিশ্বজুড়ে গণপরিবহনে নির্ভরযোগ্য বিধায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে আসছে। এ অবস্থায় বিশেষ বিবেচনায় অন্তর্ভুক্ত করে ভ্যাট আরোপের দায় থেকে একে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য যোগাযোগমন্ত্রীর প্রকাশ্য উচ্চারণকে গুরুত্ব দেওয়া হলে সামগ্রিক কল্যাণ আসতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস।
লেখক: কথাসাহিত্যিক