
রাজেকুজ্জামান রতন। ফাইল ছবি
পত্রিকায় প্রধান খবর এখন প্রাক্তনদের দুর্নীতি। যাদের ওপর আইন-শৃঙ্খলা ও দেশ রক্ষার দায়িত্ব ছিল, তাদের সম্পদ ও দাপটের কথা প্রকাশ হচ্ছে অবসরের পর। এই দেশ ক্ষমতাসীনদের অনেকের জন্য সম্পদের খনি তা বুঝতে ব্যাখ্যা করতে হয় না।
দেশের রিজার্ভ কমেছে দ্রুতগতিতে, আমদানি কমিয়েও সামাল দেয়া যায়নি। টাকার অবমূল্যায়ন এক জটিল পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। গার্মেন্টস আর প্রবাসী আয়ের ওপর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নির্ভরশীল হলেও গার্মেন্টসের রপ্তানি আয় পুরোটা দেশে আসে না, আর প্রবাসী আয়ের একটা বড় অংশ হুন্ডিতে লেনদেন হয়। ব্যাংক খাতে তীব্র তারল্য সংকট। চাহিদা অনুযায়ী টাকার জোগান দিতে পারছে না তারা। ডলার সংকটের পাশাপাশি টাকার সংকট বাড়ছে। ফলে উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো।
কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা না। চলতি অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার কথা ছিল ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। কিন্তু গত জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঋণ নিয়েছে ২৪ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার ৫ ভাগের এক ভাগ মাত্র। একই সময়ে নন ব্যাংক খাত যেমন সঞ্চয়পত্র, ট্রেজারি বিল ও ট্রেজারি বন্ড বিক্রি থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিয়েছে ১১ হাজার ২০৭ কোটি টাকা; যা লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক। আর বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ কিন্তু অর্জিত হয়েছে ৫ দশমিক ১১ শতাংশ। সরকারি ও বেসরকারি খাতে লক্ষ্যমাত্রার চাইতে ঋণ কম নিলেও ব্যাংক খাত তারল্য সংকটে ভুগছে কেন?
এ ধরনের সংকট ও সংশয়ের মধ্যে সরকার ‘ক্রলিং পেগ’ চালু করে ১১৭ টাকা মধ্যবর্তী দর নির্ধারণ করেছে। ফলে সরকারিভাবেই এখন প্রতি ডলারে পাঁচ টাকা বেড়েছে। আর আমদানিকারকদের কিনতে হচ্ছে ১১৯ থেকে ১২০ টাকায়। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে পণ্যমূল্যে। বাজার তদারকিতে দুর্বলতা কারণে পণ্যমূল্য যতটুকু বাড়ার কথা, তার চেয়ে বেশি বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সাধারণ মানুষ তাই কোনোমতে টিকে থাকার সংগ্রাম করছেন।
দেশের অর্থনীতির প্রধান সমস্যা দেশ থেকে টাকা পাচার। কিন্তু এসব ছাড়িয়ে গেছে হুন্ডি। প্রবাসীদের কাছ থেকে বিদেশেই এজেন্টরা বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় করে বিদেশে রেখে দেন, তাই এই মুদ্রা দেশে আসে না। এ রকম চললে ডলার পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। ব্যাংকিং ব্যবস্থা সংস্কার করে শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতি ৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছে, আর আমাদের মূল্যস্ফীতি বাড়ছেই।
অর্থনীতি সংক্রান্ত যে কোনো আলোচনা এলেই করোনা এবং রুশ ইউক্রেন যুদ্ধের কথা আসে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্য দেশগুলোর পদক্ষেপ কি নজরে আনা উচিত নয়? ২০২০ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করেও খেলাপিমুক্ত থাকার সুযোগ, ২০২১ সালে মাত্র ১৫ শতাংশ এবং পরের দুই বছর অর্ধেক দিলে তিনি আর খেলাপি বিবেচিত হবেন না আর সর্বশেষ ২০২২ সালে ঋণ পুনঃতফসিলের নীতিমালা ব্যাপকভাবে শিথিল করা হয়েছে। যে কারণে ঋণ আদায় হচ্ছে না বরং গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ গত ১১ এপ্রিল ব্যাংকের বাইরে কী পরিমাণ টাকা আছে, তার হিসাব প্রকাশ করেছে। সেই হিসাবে দেখা যাচ্ছে, বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ দ্রুত বেড়ে গত ১১ এপ্রিল ৩ লাখ ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকায় ঠেকেছে। গত মার্চ শেষে যা ২ লাখ ৮৮ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা ছিল। গত ডিসেম্বর শেষে যা ছিল ২ লাখ ৭৭ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা। গত ঈদের পর টাকা তোলার প্রবণতা আরও বেড়েছে। শুধু বেসিক ব্যাংক থেকেই আমানতকারীরা আড়াই হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। নির্বাচনকে টাকার খেলা বানিয়ে ফেলায় সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতেও টাকা ঘুরছে কিছু মানুষের হাতে।
এইসব সংকটের সাঙ্গে যুক্ত হয়েছে আইএমএফের পরামর্শের চাপ। বাড়ানো হয়েছে ডলারের দর, সুদহারও। নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে আমদানি। ভর্তুকি কমানোর জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে এবং আরও বাড়ানো হবে। কিন্তু মানুষের আয় বাড়ানো ও কর্মসংস্থানের উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কারণে এখন আর কাউকে দরিদ্র বলার উপায় নেই। ২৭৮৪ ডলার মাথাপিছু আয় মানে প্রত্যেকের বছরে আয় গড়ে সোয়া ৩ লাখ টাকা। জিডিপি বৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির গরমে সরকারি নেতারা বলছেন দেশে নাকি দরিদ্র নেই। যারা আছে তাদেরকে নিম্ন আয়, স্বল্প আয়, সীমিত আয়ের মানুষ যাই বলা হোক না কেন, মূল্যস্ফীতির আঘাতে এই মানুষদের টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়বে।
লেখক: সহ-সাধারণ সম্পাদক, বাসদ