
মাওলানা লিয়াকত আলী। ফাইল ছবি
বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও আল্লাহর রাহে নিজের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করার অনন্য বার্তা নিয়ে আগমন করে জিলহজ মাস। এ মাসের ৯ম দিবসে আদায় করা হয় পবিত্র হজের সবচেয়ে দৃশ্যমান রোকন উকুফে আরাফা বা আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের বিধান। পরের দিন ১০ জিলহজ পালিত হয় ঈদুল আজহা। মুমিনের জীবনে মহান আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও অনুরাগের চরম অভিব্যক্তি ঘটে হজের মাধ্যমে।
পৃথিবীর প্রত্যন্ত এলাকা থেকে মুমিন বান্দারা মক্কা মুকাররমায় উপস্থিত হয়ে আল্লাহর বিশেষ ঘর কাবা শরিফ প্রদক্ষিণ করার সময় যখন লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তোলেন, তখন সৃষ্টিকুলের সবাই একযোগে রাব্বুল আলামীনের প্রতি অনুরাগ ও আত্মনিবেদনের চরম পরাকাষ্ঠার প্রমাণ দেয়।
হজ আল্লাহ প্রেমে ব্যাকুল বান্দাদের আকুল অভিব্যক্তির ইবাদত। নওয়াব-নফর, বাদশাহ-ফকির নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করে একই সাদাসিধে পোশাক পরে আল্লাহর ঘরের চারপাশে অস্থিরভাবে পরিভ্রমণ করে। সাম্য ও মৈত্রীর যে নমুনা তারা পেশ করে, পৃথিবীর অন্য কোনো সমাবেশের সঙ্গে তার তুলনা হতে পারে না। এ জন্য বায়তুল্লাহর হজ একদিকে যেমন ইবাদত ও আধ্যাত্মিক সাধনার উচ্চ মাকাম, তেমনি বিশ্ব মানবতার সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত।
বিদায় হজে আরাফাতের ময়দানেই মহানবীর (সা.) পবিত্র জবানে উচ্চারিত হয়েছিল মানবাধিকারের প্রথম ঘোষণা। মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্মান পবিত্র বলে ঘোষণা করা হয়। ইসলামের নবী মরুভূমির এক খোলা ময়দানে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানবাধিকার ঘোষণা করে গিয়েছেন আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে। মহানবী (সা.) বিদায় হজের সময়ে জগৎবাসীকে শান্তি ও কল্যাণের যে অমিয় বাণী শুনিয়ে গিয়েছিলেন, তার অনুসরণে যত দিন সবাই সচেষ্ট না হবে, তত দিন কোনো মতবাদ, দর্শন কিংবা ব্যবস্থাই ফলপ্রসূ কিংবা কার্যকর হবে না।
জিলহজ মাসের দশম তারিখে দুই রাকায়াত ঈদুল আজহা নামাজ আদায়ের পর পশু কোরবানির হুকুম পালন করতে হয় সামর্থ্যবান মুসলমানদের। কোরবানির তাৎপর্য প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, এটি তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহীম আলায়হিস সালামের সুন্নত। প্রতিদান সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি। ভেড়ার পশমের কথা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ভেড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি নেকি দেওয়া হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও ইরশাদ করেন, কোরবানির দিনে আল্লাহ তায়ালার নিকট কোরবানির চেয়ে বেশি প্রিয় নেক কাজ নেই। কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর নিকট কবুল হয়ে যায়। কেয়ামতের দিন উক্ত পশু তার খুর, পশম সবকিছু নিয়ে উপস্থিত হবে। সুতরাং তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে কোরবানি করবে।
মুসলিম মিল্লাতের রুহানি পিতা হজরত ইবরাহীম (আ.) যেসব কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, তার একটি ছিল প্রিয়তম সন্তান হজরত ইসমাঈলকে আল্লাহর উদ্দেশে কোরবানি করা। তিনি তাতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়েছিলেন এবং আল্লাহর নির্দেশ পালনের সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহ পাক চাইছিলেন হজরত ইবরাহীম (আ.)-এর আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার পরীক্ষা নিতে। তিনি তাতে সফল হলেন। বাস্তবিক পুত্র কোরবনি তাকে করতে হলো না। আসমান থেকে ঘোষণা করা হলো-আপনি স্বপ্ন বাস্তবায়িত করেছেন। (সুরা সাফফাত আয়াত ১০৫)
হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর আদর্শ চিরস্মরণীয় করে রাখার ব্যবস্থা করেছেন আল্লাহ তায়ালা। উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য পালনীয় সাব্যস্ত করা হয়েছে পশু কোরবানি। কিন্তু নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা কামনা করা হয়েছে হজরত ইবরাহীম আলায়হিস সালামের মতোই। কোরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে-‘এসবের (পশু) গোশত কিংবা রক্ত আল্লাহর নিকট পৌঁছে না। বরং তার নিকট পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।’
(সুরা হজ, আয়াত ৩৭)
নিছক প্রথা হিসেবে প্রতিবছর ঈদুল আজহার সময়ে একটি পশু কোরবানি করা যথেষ্ট নয়। বরং প্রথমেই বিসর্জন দিতে হবে নিজের মনের পাশবিকতা ও নশ্বর পৃথিবীর মোহ। কোরবানির প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ও পর্যায়ে নিজের প্রাপ্য, বক্তব্য, অভিমত ও প্রস্তাবের প্রাধান্য ও অগ্রগতির দাবি পরিহার করলেই হজরত ইবরাহীম আ.-এর প্রকৃত অনুসরণ হয়। মহানবী (সা.) উম্মতকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন নিখুঁত পশু কোরবানি করতে। বাহ্যিকভাবে তা যেমন ত্রুটিমুক্ত হতে হয়, তেমনি অন্তরেও পোষণ করতে হয় একাগ্রতা ও আল্লাহ প্রেমের ব্যাকুলতা। পার্থিব জীবনের সহায়ক উপকরণাদির প্রতি মোহ ও আকাঙ্ক্ষা যেন বদ্ধমূল না থাকে বরং তা যেন আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্পিত আমানত হিসেবে বিবেচনা করে মালিকের ইচ্ছা ও আদেশ মোতাবেক প্রত্যর্পণের আগ্রহ পোষণ করা হয়, ঈদুল আজহা সে আহ্বান নিয়ে আগমন করে।
লেখক: ইসলামি চিন্তাবিদ