
মুহাম্মদ তানিম নওশাদ। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল
বহুদিন ধরেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিজ্ঞজনেরা একটি কথা আওড়ে যাচ্ছেন, আর তা হলো একমেরুকেন্দ্রিক পৃথিবী আর নেই। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে যে এককেন্দ্রিক দুনিয়ার সূচনা ঘটেছিল, চীন ও ভারতের উত্থান এবং রুশদেশের পুনরুত্থানে তা আর বেশি দিন স্থায়ী হয়নি বলেই তাদের অনেকের অভিমত। সামরিক শক্তিতে যে মার্কিন আধিপত্য এতকাল ছিল, তা এখন তারা শুধু দুর্বল মুসলিম দুনিয়াতেই ফলাতে পারে। আর অন্যসব মুসলিম রাষ্ট্রের মতোই বাংলাদেশও বহুমেরুত্বের বহুমাত্রিকতাকে সেভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। কোনো কোনো মুসলিম দেশ যেটুকু পেরেছে, বাংলাদেশ তাও পারেনি। সেটা করতে পারলে বাংলাদেশের জন্যই ভালো হতো।
বলা হয় বাংলাদেশিদের জ্ঞান তৃষ্ণা কম। তবে তা বাংলাভাষীদের ক্ষেত্রে বলা যাবে না। বাংলাভাষী বললে পশ্চিমবঙ্গও চলে আসবে, যেখানে সিরিয়াস জ্ঞানচর্চা আগের তুলনায় কমলেও, একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। আর বিদেশের মাটিতে সেখানকার অনেকেই জ্ঞান জগতে ভালো ভূমিকা রাখছেন। বাংলাদেশের অবস্থা যে পশ্চিমে একেবারে বন্ধ্যা তা নয়। কিন্তু মৌলিক চিন্তা ও তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা প্রকট; যা এখন পশ্চিমবঙ্গেও দেখা দিচ্ছে। উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক। বাংলাদেশের একজন ছাত্র বা শিক্ষক হয়তো পশ্চিমের কোনো খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফলাফল করল, কিংবা একটি পিএইচডি ডিগ্রিও নিল, কিংবা কোনো একটি মৌলিক বইও লিখল, কিন্তু তাতে এমন কিছু নেই, যাতে যুগান্তকারী কিছু আছে। বাংলাদেশের এখন যে হাল, তাতে বিশ্বের দু-চারটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-চারজন ভালো ছাত্র দিয়ে আমাদের কী হবে? আমি বলছি না যে, আপনারা পড়াশোনা ছেড়ে দিন। বরং এমন কিছু করুন, যাতে আমাদের মানুষের জ্ঞান জগৎ ও চিন্তার জগতে বড় কোনো বিপ্লব সাধিত হয়। আর তার প্রভাব যেন আমাদের অর্থনীতিতেও পড়ে। কিন্তু সে রকম কিছু আমরা করতে পারিনি।
বাংলাদেশের নাম আসলে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম আসে। কিন্তু আমি বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, তার ক্ষুদ্র ঋণদান প্রকল্পেও তেমন মৌলিক কিছু নেই, এবং বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি দারিদ্র্য বিমোচনে সেটি তেমন কোনো ভূমিকা রাখেনি। প্রথমত, মাইক্রো ফিনান্সের ইতিহাস নতুন নয় একেবারেই। সপ্তদশ শতাব্দীতে খ্যাতনামা লেখক জোনাথন সুইফট আইরিশ লোন ফান্ড নামে একটি ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন, যেটি ছিল একটি ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প। মার্কিন মানবতাবাদী আইনজ্ঞ, রাজনৈতিক দার্শনিক ও কৃষ্ণাঙ্গ দাসত্বের অবসানকামী বা অ্যাবোলিশিউনিস্ট লিজান্ডার স্পুনার অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধেই এ বিষয়ে লিখেছেন। এবার আসি তাত্ত্বিক বিচারে। ২০১০ সালে এমআইটি প্রেস ‘দ্য ইকোনমিক্স অব মাইক্রোফিন্যান্স’ নামে একটি বই প্রকাশ করে। লেখক দুজন-বিয়াট্রিস আরমেনদারিস ও জোনাথন মোর্ডাখ। এটি ইউনূস সাহেবের কাজের স্বীকৃতির ওপর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বই। এই বইটি আমি এক সময়ে আগাগোড়া ভালোমতো পড়েছিলাম। এই বইটিও আমাকে খুব একটা আকৃষ্ট করতে পারেনি। কিছু লঙ্গিটিউডিনাল ডাটা ও কিছু গাণিতিক প্রয়োগ দেখানোর ছলে, একটি সাধারণ বিষয়কে ভারী করার চেষ্টা করা হয়েছে। ফিন্যান্সিং প্রক্রিয়ার চেয়ে কোনো কোনো জায়গায় কাকে ঋণ দিলে তা ফেরত পাওয়া যাবে, সেটাই মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে। এটি সার্বিক দারিদ্র্য দূরীকরণের মডেল নয় বলেই আমার অভিমত। তারপরও আমি তাকে খাটো করতে চাই না। কেউ কেউ বলেন যে, সরকার তাকে অযথা হয়রানি করছে। সেটি যদি সত্যি হয়, আমি তারও পক্ষে নই।
এবার আসি বহুমেরুত্বের দুনিয়ায় বহুত্বের ধারণার যে খর্বিত রূপ বাংলাদেশে বিরাজ করছে তার ওপরে। বহুমেরুত্ব মানেই বিবিধ সংস্কৃতি ও বহু ভাষা। কিন্তু আমরা শুধু ইংরেজি ও আরবি নিয়ে পড়ে আছি। সে দুটো নিয়েও যে আমরা খুব প্রতিযোগিতা করতে পারছি তাও নয়। ইংরেজি দুনিয়ায় প্রতিযোগিতা সহজ নয়। এখানে প্রতিযোগী অনেক। মাদ্রাসাগুলোতে আরবি শুধু ধর্মীয় শিক্ষার বাহন। কিন্তু সেই সঙ্গে এটি দিয়ে যে আমরা মধ্যপ্রাচ্য ও জাতিসংঘের বিভিন্ন মিশনে থেকে উচ্চ পদে কাজ করে ভালো অর্থের জোগান দিতে পারি, সেটুকু ভাবার গরজ তাদের নেই, আর এখন হয়তোবা সামর্থ্যও আর নেই। অন্য ভাষা চর্চার ক্ষেত্রেও এই স্থবিরতা আছে। আমরা তাই এই দুইয়ের বাইরেও কোনো ভাষা শিখলে, তাও শুধু যোগাযোগের সক্ষমতা পর্যন্ত অর্জন করেই ছেড়ে দেই। কিন্তু এটি দিয়ে আরও কিছু করার কথা ভাবি না। অথচ আমাদের জনভার লাঘব করতে ইংরেজি বা আরবি দুনিয়ার বাইরেও যে লোক পাঠানো দরকার সেই বুদ্ধি সংশ্লিষ্টদের আজও হলো না। যেমন বিশ্বে স্প্যানিশ ভাষা দাপ্তরিক ভাষা হিসেবেই আছে ২১টি দেশে। ফরাসি ভাষা আরও বেশি দেশে-এই সংখ্যা ২৯টি। অথচ এই ভাষাগুলো যারা আমাদের দেশে পড়ান, তাদেরও টার্গেট শুধু ল্যাঙ্গুয়েজ বইগুলো পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। ফলে বহুত্বের দুনিয়ায় টিকে থাকার জন্য দরিদ্র দেশগুলোর যে কালচারাল ডাইভার্সিটিতে অভ্যস্ত এবং নানা দেশের অর্থনীতিতে সক্রিয় হওয়া উচিত, তা এখানে সম্ভব হচ্ছে না।
অনেক দেশ আছে, যারা বড় কোনো উৎপাদক না হলেও ছোট ছোট কাজ করে উপরে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একটি। আমি প্রোগ্রাম বা সফ্টওয়্যার ডিজাইনের কথা বলছি না। এর ভালো অপারেটররাও বৈশ্বিক মার্কেটে ভালো ভূমিকা রাখছে। এখানে সেই বাজারও তৈরি হচ্ছে না। যে কারণে আমরা অন্তর্জালকেন্দ্রিক বাণিজ্যেও ক্রিকেটের মতোই প্রবল আগ্রহ নিয়ে নেমে এখন মুখ থুবড়ে পড়েছি। আমাদের দেশের প্রধান সমস্যা, এখানে কাজের প্রতি আগ্রহ না দেখিয়েই লোকে আগে টাকার প্রতি প্রবল আগ্রহী হয়ে ওঠে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে সে কাজ ও টাকা দুটিই হারায়। বাকি থাকে দেশ। ফলে এখানেই লুটেপুটে খাও। ফলে খ্যান্তি বিড়ালের গল্পটা এখানে বলা ভালো। আগে আমরা যে বাসায় থাকতাম, সেখানে আমরা বিড়াল পালতাম ছয়টি। ফ্ল্যাট বাড়িতে আর বিড়াল কয়টা পালা যায়? পাশের বাড়ির কার্নিশে থাকত এক মাদী বিড়াল। তার খাবার জোটে কি জোটে না। কিন্তু কয় দিন পর পর বাচ্চা দিতে দিতে তার অবস্থা কাহিল। বাচ্চা যাতে আর না হয়, আমার মা তার নাম দিলেন খ্যান্তি। বাংলাদেশের অবস্থাও তাই। লুটপাটে দেশ জর্জরিত, জাতির মধ্যে কোনো সামগ্রিক অর্থনৈতিক সচেতনতা নেই, কোনো আগ্রহও নেই। অথচ অন্যের দোষ দেওয়ার ক্ষেত্রে ষোলো আনা। যদি ধরেই নেওয়া হয়, এই ক্ষেত্রে সব সরকারই ব্যর্থ, তাহলে-
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে,
তবে একলা চলো রে।
সে ক্ষেত্রে কী করার? সেটাই এতক্ষণ বোঝানোর চেষ্টা করলাম।
লেখক: গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক