Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

সিক স্যার, সালাম

Icon

আফসান চৌধুরী

প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৪, ২১:২১

সিক স্যার, সালাম

আফসান চৌধুরী। ফাইল ছবি

আমরা যখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ছাত্র তখন যে কজন শিক্ষক গুরুর পর্যায়ে ছিলেন, তার মধ্যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (SIC) স্যার অন্যতম। ওই যুগে উনাদের মতো মানুষ আরও ছিলেন, কিন্তু তিনি মূলধারার প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যায়তনের নাগরিক, তাই তার প্রভাব ছিল বড়। স্যারের ভূমিকা তখন যা ছিল, এখনো অনেকটা তা-ই। তিনি একজন সমাজ সমালোচক। পঞ্চাশ বছর আগেও যে কথা বলেছেন, এখনো কমবেশি একই কথা বলছেন। আজ তিনি তার রাজনৈতিক চিন্তাধারার জয় পরাজয়ের ঊর্ধ্বে। বস্তুতপক্ষে এটাই স্যারের শ্রেষ্ঠ অর্জন। তিনি ব্যক্তি থেকে একটি বরেণ্য প্রতীকে রূপান্তর হয়েছেন। তবে একই সঙ্গে তিনি এক ধরনের জীবন্ত নস্টালজিয়া। কারণ সেই দুনিয়া আর নাই আমাদের চারদিকে আজ। 

দুই

এটাও কি একটা প্রাজন্মিক বিষয়? সিরাজ স্যারদের কালে নৈতিক অবস্থান অনেকেই নিতেন, লোভ লালসা থেকে অনেকেই দূরে থাকতেন। আবার মনে হয় এত কিছু হাতের কাছে এত সহজে কখনো ছিল কি? মানুষকে আর কত দোষ দেওয়া যায়। যে দামে একটি ছাগল কেনা যায়, বাজার থেকে তার চেয়ে কম দামে একজন মানুষ খরিদ করা যায় আজকাল। কাদের দোষ ধরব?

তিন 

সেই দিক থেকে আমরা চাঁদ কপালি। কারণ এমন এমন মানুষজনের সঙ্গে দেখা হয়েছে এত নিকট থেকে যে তাদের এখন আমরা কিংবদন্তির ইজ্জত দেই। উনি আমাদের স্যার, এর হয়তো একটু বেশি কারণ উনি সামাজিক প্রতিবাদ প্রক্রিয়া পরিসরে সক্রিয়। অতএব যোগাযোগটা একটু বেশি ছিল কিন্তু তারপরও তিনি স্যার। তিনি আমাদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন যেহেতু উনাদের নেতৃত্বে আমরা বাংলাদেশ লেখক শিবির নামক সংগঠনের কর্মী ছিলাম। আমাদের প্রধান কাণ্ডারি বোধ হয় হয় শরীফ স্যারই। তারপর কারও নাম আসলে হবে সিরাজ স্যারের নাম।

চার

সত্তর দশকের তোলপাড় উত্থান-পতন আমাদের চোখের সামনে ঘটেছে। কিন্তু স্যার আজকেও মার্ক্সবাদী, এটা বড় বিষয়। এটা সঠিক বা ভ্রান্ত সেটা নয়, এটা এখন নৈতিকতার বিষয়। স্যার যে কালের মানুষ তাকে এটা মানায়, নিবিষ্ট মনে সেবা করছেন তার বিশ্বাসের, আদর্শের। এটা তার কালের স্বাক্ষর, তিনি একা নন। তবে কিনা উনাদের সংখ্যা কম, এটাই বাস্তবতা।

পাঁচ

১৯৭২-৭৫ ছিল নানা কারণে কঠিন সময়। সেটি কেবল যুদ্ধপরবর্তী দেশের সংকট বা অবস্থা নয়, নানা ধরনের রাজনৈতিক সংকটও বটে। তার মধ্যে বাকশাল ছিল একটা। এটা সহজ বিষয় নয়, এই চাপটা সামলাতে কেউ পেরেছিলেন, কেউ পারেননি। এর সঙ্গে কিন্তু জড়িত ছিল অনিশ্চয়তা... তারপর কী হবে? এবং তারপর যেটা ঘটল, সেটা ছিল আরও প্রচণ্ড। ১৫ আগস্ট কেবল হত্যাকাণ্ড নয়, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন নয় বা সেনাবাহিনীর সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতার সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন নয়, এটা পাল্টে দেয় সমীকরণ নির্মাণ পদ্ধতি, শত্রু-মিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়াও। এ জন্য ১৯৭৫ নানা কারণে ক্রান্তিকাল। আমরা সব কিছু রাজনৈতিক দলীয়করণ করে ভুলে গেছি, এটা আমাদের মনোজগতের ঠিকানা নির্মাণের একটা জংশনও বটে। 

ছয়

ওই সময় অনেকে সক্রিয় হয়ে ওঠেন, বিশেষ করে যারা প্রাক্তন সরকার বিরোধী ছিলেন। স্যার আগে থেকেই ছিলেন। অনেকেই নয়া দল ও গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মেলান। সময়টা বোঝার জন্য একটি মিটিংয়ের উদাহরণ দেই। আমরা একটি মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন করতাম-‘কমিটি ফর সিভিল লিবার্টিস অ্যান্ড লিগাল এইড’। আমরা খুব পরিষ্কার থাকতে চেয়েছিলাম, তাই কোনো বিদেশি দাতার টাকা নেইনি, পাবলিকের চাঁদায় চলতাম। কিন্তু আগস্টের পর সংকট দেখা দিল। আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটির অর্ধেক সদস্য সামরিক শাসনের সঙ্গে যুক্ত হলেন। কী আর করা, সবাইকে বাদ দেওয়া হলো, কিন্তু সংগঠন আর টেকেনি। যারা যারা নিজেদের অবস্থানে ছিলেন তাদের মধ্যে শরীফ স্যার, সিরাজ স্যার, আহমেদ কামাল স্যার অন্যতম। আগের পরিবেশ ও পরের পরিবেশ বৈরী থেকেই যায়। ঠিক তেমনি উনারাও একই পরিসরে থেকে যান, পা সরিয়ে যাননি কোথাও। এটাই উনাদের বড় অর্জন। ক্রমে সব কিছুই ধূসর হয়ে মিলিয়ে গেছে। এই ইতিহাসে যা মানায় সেই রকমই দেখতে হয়েছে মানুষ। তবে কিছু মানুষ পাল্টায়নি, ইতিহাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। এক অনুষ্ঠানে স্যারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মনে হলো, আমাদের সেই পঞ্চাশ বছর আগের স্যারের সঙ্গে কথা বলছি। আপনাকে শুভেচ্ছা স্যার।

লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫