Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

চলমান বাস্তবতা ও রাজনীতি

Icon

শেখর দত্ত

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১২:৩৬

চলমান বাস্তবতা ও রাজনীতি

শেখর দত্ত। ফাইল ছবি

দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের ভিত্তিতে সরকারের প্রজ্ঞাপন জারির শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুটা স্বস্তির মধ্যে থেকে কলামটা লিখছি। তবে প্রজ্ঞাপন জারি এবং কোটা আন্দোলনকারী ছাত্রদের ৮ দফা দাবিনামা সরকার সাধারণভাবে মেনে নিলেও, কোটাবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কারী ও ছাত্রদের প্রতিক্রিয়া কী হয় এবং নানা ঘাতপ্রতিঘাতে পরিস্থিতি কোনদিকে গড়ায় তা এখনো সুস্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। কোটাবিরোধী আন্দোলন এক পর্যায়ে জ্বালাও- পোড়াও তথা আগুন সন্ত্রাসের দিকে মোড় নেয়। সমন্বয়কারীরা ‘দেশজুড়ে সংঘটিত ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমাদের আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই’ কথাটা বললে আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষ দাঁড়িয়ে যায়। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ঘাপটি মেরে থাকা মরণ কামড় দিতে নামা তৃতীয় পক্ষ ঘটনা প্রবাহে কখন কী অবস্থান নেয় এবং কোন সুযোগ নিয়ে আবারও অগ্নিসন্ত্রাস করতে নামে তা নিয়েও চলমান দিনগুলোতে অনিশ্চয়তা থেকে যাবে। 

২১ জুলাই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন নেতাকে আটক করে তাদের দিয়ে জোর করে সাজানো বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে।’ কথাটা অসত্য। তিনি আন্দোলন তথা আগুন সন্ত্রাসকে ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ বলে দায় এড়াতে চাইছেন। প্রথম ও দ্বিতীয় পক্ষ যেখানে ধ্বংসাত্মক কাজের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, সেখানে ‘ধ্বংসাত্মক’ শব্দটি তিনি উচ্চারণও করেননি। এ ব্যাপারে নীরবতাই প্রমাণ করে দেশের জন্য চরম স্বার্থহানিকর কোনো কাজ করতে আগামী দিনগুলোতেও তারা পিছপা হবে না। 

তিনি বিবৃতিতে তার দলের কেউ নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেননি। কোটা আন্দোলনকারী এবং পুলিশসহ সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় পক্ষসহ নিরীহ মানুষ নিহত হলো ঠিকই, কিন্তু আগুন সন্ত্রাসের হোতাদের কিছুই হলো না। জামায়াত রয়েছে চুপটি করে। এদিকে দেশের ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়ে বিদেশে এই অপশক্তি মিথ্যাপ্রচার করে দেশের ভাবমূর্তি নষ্টের খেলায় মেতে উঠেছে। এই গোষ্ঠী আসলে ভুলে গেছে আগুন নিয়ে খেলার পরিণাম হয় ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের মতোই ভয়াবহ। 

নির্বাচন ও নতুন সরকারের কার্যকাল শুরুর ৬ মাসের মাথায় এই ধরনের মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞ দুর্ভাগ্যজনক ও অনভিপ্রেত। এখন প্রধান কাজ হচ্ছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে জনজীবনে স্বস্তি, শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, তা সুনিশ্চিত করা এবং ধ্বংসাত্মক কাজে যুক্ত দোষীদের বিচার ও শাস্তি দেওয়া।

এবারের জুলাই মাসটা শুরুই হয় সর্বজনীন পেনশন প্রত্যয় কর্মসূচির প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের দাবিতে ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লাগাতার ধর্মঘট দিয়ে। প্রসঙ্গত, বিগত ৫ জুন হাইকোর্র্ট সরকারের ‘কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে’। তারপর থেকেই ‘কোটা বাতিলের সরকারি পরিপত্র পুনর্বহালের’ দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত আন্দোলন শুরু করে। একই দিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বয়ের মাধ্যমে আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। অর্থাৎ জুলাইয়ের প্রথম দিনেই এক আন্দোলন অপর আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করে এবং বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। 

কোটা আন্দোলনের সমস্যার মধ্যেই প্রত্যয় স্কিম চালু হয়। শিক্ষক নেতৃত্বের সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কোনো আলোচনা করেছিল কি? বড় কিছু পরিবর্তন করতে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের মানুষদের সম্পৃক্ত করা জরুরি। এটা ঐতিহ্যবাহী ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের চাইতে ভালো কেউ জানে না। ২ জুলাই অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বললেন, শিক্ষক আন্দোলনের ‘যৌক্তিকতা’ নেই। এর পরেও দিনের পর দিন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও শিক্ষামন্ত্রী নওফেলের সঙ্গে শিক্ষকদের আলোচনা হলো না। এমন খবরও দেশবাসীর পড়তে হলো, শিক্ষকদের বিষয়ে সরকার ‘চিন্তিত নয়’, তবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে ‘সতর্ক’। এই সংবাদ যদি সত্য হয়, তবে প্রশ্ন জাগে, ওই পরিস্থিতিতে দুই আন্দোলনকে কি পৃথক করে দেখার সুযোগ ছিল?

প্রসঙ্গত বিগত ৫ জুন হাইকোর্ট কোটা বাতিলের পরিপত্র বাতিল করে রায় দেয়। সাথে সাথেই হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করে, যা ৯ জুন চেম্বার আদালতে ওঠে। সেদিন চেম্বার আদালত আবেদনটি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য ৪ জুলাই নির্ধারণ করে। সাধারণ বিবেচনা থেকে বলা যায়, সরকার ও আদালত বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নেয়। তাই যে প্রচার রয়েছে, সরকারই হাইকোর্টকে প্রভাবিত করে পরিপত্র বাতিলের রায় বের করেছে কিংবা আন্দোলনের চাপে সরকার রায় স্থগিতের আবেদন করেছে, তা মিথ্যে। 

৪ জুলাই বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনউদ্দিন ‘হাইকোর্টের রায় স্থগিতের’ আবেদন জানান, যা ছিল ছাত্রদের দাবির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তখন প্রধান বিচারপতি ওবায়েদুল হাসান বলেন, ‘নট টু ডে’। তিনি ‘সিপি (লিভ টু আপিল) ফাইল’ করতে বলেন। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, হাইকোর্টের রায় এখনো পাইনি। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘পাবেন’। সরকারের ইচ্ছা ও ছাত্রসমাজের চাওয়া স্থগিতাদেশ আইনি প্রক্রিয়ায় এই পর্যায়ে আটকে যায়। 

৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া উচিত’ মন্তব্য করে বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে এভাবে আন্দোলন করা সাবজুডিস। আমরা সরকারে থেকে কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে পারি না।’ ওই দিনই কোর্টের অবস্থান বিবেচনায় না এনে ছাত্র সমাজ কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে ‘বাংলা ব্লকেড’ ও ক্লাস-পরীক্ষা বাদ দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছাত্র ধর্মঘটে চলে যায়। ৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রী যখন চীন সফরে, সেদিন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের চার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। 

সভায় সিদ্ধান্ত হয়, আদালতের প্রক্রিয়া ‘দ্রুত করার সুযোগ থাকলে, সে উদ্যোগও নেবে সরকার।’ এই প্রেক্ষাপটে ১০ জুলাই দুই ছাত্রের হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ কোটা বিষয়ে ৪ সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা দেন এবং ৭ আগস্ট শুনানির দিন ধার্য করেন। পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এক. ‘সব প্রতিবাদী কোমলমতি ছাত্রদের’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরে গিয়ে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে; দুই. সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রক্টর এবং সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের ‘নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের ফিরিয়ে নিয়ে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে; তিন. শিক্ষার্থীরা আইনজীবীর মাধ্যমে ‘তাদের বক্তব্য আদালতে তুলে’ ধরা এবং ‘বিষয়টি নিষ্পত্তির সময় তাদের বক্তব্য বিবেচনা করা হবে’ বলে মতামত দেন। 

কিন্তু আদালতের কথা না শুনে ছাত্ররা মহাসড়ক, রেলপথ অবরোধে যায়। ওই দিনই পত্রিকা পাঠে জানা যায় ‘প্রয়োজনে সরকার কঠোর’ হওয়ার কথা ভাবছে। ১৩ জুলাই রাজধানীর শাহবাগে পুলিশকে মারধর ও গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত করা ও এ নিয়ে মামলা প্রদানের খবর জনগণ জানতে পারে। ১৪ জুলাই ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে আন্দোলনকারীরা রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি দেয়। এদিকে সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে কথা বলার পর শিক্ষকরা ওই দিনই সিদ্ধান্ত নেন, দাবি পূরণ হয়নি, কর্মবিরতি চলবে।’ একই দিন চীন সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যকে বিকৃত করে গভীর রাতে ছাত্ররা হলের তালা ভেঙে রাস্তায় নামে এবং ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান দেয়। সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি যায় সম্পূর্ণ পাল্টে। এর পরের ঘটনা সবার জানা। 

এখন প্রশ্ন হলো : ছাত্ররা আইনি বিষয় ও দেশের সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশ না মেনে বিশেষত সরকারের পরিপত্র বিষয়ক রায় যখন স্থগিত তখন এতটা অনড়-অধৈর্য অবস্থানে গেল কেন? পাকিস্তানি আমলে ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে বলি তখন কোর্টে কোনো বিষয় গেলে সঙ্গত কারণেই ছাত্ররা কোর্টের রায়ের জন্য অপেক্ষা করত। তখন তো আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ ছিল দেশ ও দেশের মানুষের জন্য। আর এখন নিজেদের চাকরির জন্য, নিজেদের জন্য বলেই কি এতটা অস্থির? 

উল্লেখিত ঘটনাপ্রবাহ থেকে সুস্পষ্ট, সরকার ১৫ জুলাই অর্থাৎ প্রথম পর্যায় পর্যন্ত পদ্ধতিগতভাবে সঠিক ছিল। আন্দোলনকারীরা ছিল অস্থিরতার মধ্যে। তবে সরকার হচ্ছে আওয়ামী লীগের, যে দলের চাইতে বেশি আন্দোলনের অভিজ্ঞতা আর কোনো দলের নেই। অতীতের কোটা আন্দোলন ও সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলনের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে রাজনৈতিক সরকার রাজনৈতিকভাবে বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়েছিল কি? প্রকাশ্যভাবে ছাত্রদের আলোচনার আহ্বান জানালো না কেন? যদি ভেতরে ভেতরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয় এবং আন্দোলনকারীরা বসতে অস্বীকার করে, তবুও বলতে হয়, স্মারকলিপি দেওয়ার সময় রাষ্ট্রপতি দেশের অভিভাবক হিসেবে ছাত্রদের সঙ্গে কথা বললেন না কেন? 

আরও একটি প্রশ্ন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও ছাত্র- এই দুটো আন্দোলন একসঙ্গে চলতে দেওয়ার কি কোনো দরকার ছিল। সংশ্লিষ্ট বিষয় সমাধানের জন্য পাঁচ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী যখন বসলেন তখন তারা কী করলেন? সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, যিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সুরক্ষা ও দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির একমাত্র ভরসা, তাকে যখন তখন সব বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে কেন? মন্ত্রীদেরই তো সামনে থেকে সমন্বয়ের মাধ্যমে যার যার মন্ত্রণালয় বিষয়ে রাজনীতি বিবেচনায় নিয়ে কথা বলা এবং সমাধানের পথ বের করা প্রয়োজন। নতুন প্রজন্মের কথা ভেবে চরম দুঃখ ও চিন্তা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে অনেক কথা বুকে রেখে আজ এখানেই কলামটা শেষ করলাম। 

শেখর দত্ত
কলাম লেখক, রাজনীতিক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫