
সলিমুল্লাহ খান
আমাদের এখানে এখন যে কোটা ব্যবস্থা আছে, এটার একটা ইতিহাস আছে। এ দেশে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর যখন ইংরেজি শিক্ষা চালু হলো, এখানে মনে রাখতে হবে ইংরেজি শিক্ষা চালু হলো কখন, আমরা বলি ১৮৩৫ সালে ম্যাকলের প্রবর্তিত শিক্ষানীতি। সেটাই ইংরেজি শিক্ষার শুরু নয় আমরা মনে করলেও, তার ৮০ বছর আগে ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তিত হয়েছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যেদিন সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করেছে তখন থেকেই ইংরেজি শিক্ষা চালু হয়েছে। সরকারি চাকরিতে তখন ফার্সি, আরবি, সংস্কৃত জানা লোকদের বাধ্য হয়ে নিয়োগ করতে হয়েছে। পলাশির বিজয়ের ৮০ বছর পর ১৮৩৫-এর দিকে ইংরেজরা সিদ্ধান্ত নিল, এখন থেকে সরকারি চাকরি যারা করবেন তাদের ইংরেজি জানতেই হবে। অতএব ইংরেজি না জানা লোকদের আর সরকারি চাকরি হবে না। এই যে কোটা ব্যবস্থা চালু হলো, কী কোটা এটা? ইংরেজি জানাদের কোটা। ১৮৪৪ সালে লর্ড হার্ডিঞ্জের সময় সরকারি চাকরিতে ঢোকার জন্য ইংরেজি বাধ্যতামূলক করা হলো।
প্রথম কোটা শুরু হয় ১৯০৯ সালে, ভারত তখন শাসন করত একজন গভর্নর জেনারেল বা ভাইসরয়। তার একটি প্রশাসন পরিষদ ছিল, ১৫ জন মন্ত্রী নিয়ে। এটার নাম ছিল এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল বা প্রশাসনিক পরিষদ। আইন প্রণয়নের জন্য এই মন্ত্রিসভাই লেজিসলেটিভ কাউন্সিল বা আইন সভা হয়ে যেত। ১৮৬১ পর থেকে লাটের লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে দুই-একজন ভারতীয় সদস্য রাখা হতো। ১৯০৯ পর্যন্ত দেখা গেল কোনো ভারতীয় মুসলমান এই পরিষদে জায়গা পায়নি। তখন আগাখানের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের নেতারা শিমলাতে বড়লাটের গ্রীষ্মকালীন আবাসে গেলেন একটা দরখাস্ত নিয়ে, সেই দরখাস্তের সারমর্ম হলো ‘আমাদেরকে রক্ষা করুন’। ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি মাথায় রেখে বড় লাট বললেন, ‘ঠিকাছে এখন থেকে বড়লাটের পরিষদে আপনাদের দুজন প্রতিনিধি রাখা হবে নমিনেশনের ভিত্তিতে। এই হলো প্রথম কোটা, অর্থাৎ মুসলমানরা পায় না কিন্তু কোটা ভিত্তিতে দুই-একজন প্রতিনিধি রাখল। এটার নামই হচ্ছে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা। এটা কংগ্রেস মেনে নিল না। তখন এটার জন্য মূল্য দিতে হয়েছিল।
এখন যেমন ছাত্ররা দিল ৯৩%-এ আসার জন্য। মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেছে, সুপ্রিম কোর্ট যে সর্বশেষ রায় দিয়েছে তাতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৫% রাখা হয়েছে। এটা প্রযোজ্য হলো, মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের সন্তানের জন্য। গত কয়েক বছর শোনা যাচ্ছিল ছয়-সাত ভাগের বেশি পাওয়া যাচ্ছিল না মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। গোটা জিনিসটার মধ্যে একটা দুর্নীতি ভর করেছিল। ছাত্ররা যে সংস্কারের জন্য আন্দোলন করেছিল বাতিল করার জন্য সেটা শুধু যৌক্তিক নয়, ইংরেজিতে বলে ওভারডিউ। এ আন্দোলন তো অনেক আগে হওয়া উচিত ছিল। এ আন্দোলন অন্ততপক্ষে ২০ বছর আগে হওয়া উচিত ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের যে ৩০% কোটা ছিল অতিরিক্ত বেশি। বাংলাদেশের কত লোক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, এক অর্থে সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। যারা করেনি তাদের হয় ফাঁসি হয়েছে, জেলে পাঠানো হয়েছে, না হয় দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। সোজা কথা হচ্ছে বাদ যদি কাউকে দিতে হয়, তাহলে কোলাবরেটরদের দিয়ে বাকি সকলের জন্য ওপেন করতে হবে, কারণ সবাই তো মুক্তিযোদ্ধা। এনায়েতুল্লাহ খানের স্মৃতিকথায় একটা কথা পড়েছিলাম, যতটুকু মনে পড়ে উনি বলেছেন যে, ‘মুক্তিযুদ্ধে যারা যায়নি তারা সবাই কোলাবরেটর হতে পারে না। বরঞ্চ আপনাকে বলতে হবে যারা প্রত্যক্ষ কোলাবরেটর, প্রমাণ আছে, তারা বাদে সকলেই মুক্তিযোদ্ধা।’ সুতরাং ৩০% রিজার্ভেশন রাখাটা বুদ্ধির পরিচয় ছিল না।
যা-ই হোক সে কথা তো ইতিহাসের কথা, আমি এখন সে কথা বলতে চাই না। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখারই কোনো দরকার নেই। এই যে ৫% এটাকেও আমি অতিরিক্ত মনে করি। যারা অবাঙালি জাতিসত্তা তাদের জন্য ১% কোটা উপকারে আসবে না। তাদের জন্য আরও বেশি রাখা দরকার ছিল। এই ডামাডোলের মধ্যে যে ক্ষতিটা হলো, যারা অবাঙালি জাতি তাদের কোটা কমিয়ে দিল, ৫% থেকে ১% হয়ে গেল। এটার ভবিষ্যৎ ফল ভালো নয়, তা আজকে বোঝা যাবে না। আর তৃতীয় লিঙ্গ ও প্রতিবন্ধীদের কোটা ১% করা হলো সেটা নিয়ে আন্দোলন করার কেউ নেই। আমাদের দেশে নারী-পুরুষ সাম্যের যে প্রশ্নটা আছে, সে ক্ষেত্রে মেয়েরা যে সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে সে জন্য নারী কোটা রাখা রাখা উচিত ছিল। ‘সমাজের অনগ্রসর জনগণ কোটা সুবিধা পাবেন’ এটাই যদি মূল নীতি হয় তাহলে মুক্তিযোদ্ধারা সুবিধাবঞ্চিত নয়।