Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

হাসিনা সরকারের পতন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আগমন এবং তারপর

Icon

মুহাম্মদ তানিম নওশাদ

প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২৪, ২০:১৬

হাসিনা সরকারের পতন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আগমন এবং তারপর

মুহাম্মদ তানিম নওশাদ। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

৫ আগস্ট ছাত্র ও জনতার বিপুল জনগোষ্ঠীর সামনে নতি স্বীকার করলো শেখ হাসিনা ও তার সরকার। বলা হচ্ছে ২০০৮ সালে যে ম্যান্ডেট নিয়ে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন, পরে তিনি বা তার সরকার তার প্রতি সুবিচার করেননি। পুরো প্রশাসনিক কাঠামোতে তিনি নজিরবিহীন দলীয়করণ করেছেন। পরবর্তী সময় জাতীয় নির্বাচনগুলোতে তার দল ক্ষমতায় এলেও সেগুলোতে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ এনেছে বিরোধী দল ও দেশি-বিদেশি সংবাদ মিডিয়াসহ অন্যান্য সামাজিক ও গণমাধ্যম। এগুলো অবশ্য তদন্তের অপেক্ষায় আছে। শেষ মুহূর্তে তিনি তার বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে ভারতের উদ্দেশে পাড়ি জমান। শেখ হাসিনা ও তার দলের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন অর্থলোপাট ও টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগও উত্থাপিত হয়েছে। ফলে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের অন্যতম পুরনো রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগও অস্তিত্বের সংকটে পড়ল। 

এরই মধ্যে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়েছে। এই সরকারে ঘটেছে নানা পেশার ও মতাদর্শের লোকের সমাহার। একদিক দিয়ে সেটিই হওয়া উচিত ছিল। কারণ এক অর্থে দল-মত নির্বিশেষে সাধারণ জনতা সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিল। কিন্তু মূল বিজয়টা ছিনিয়ে এনেছে ছাত্রসমাজ, যেখানে মেয়েদের ভূমিকাও ছিল অতুলনীয়। ফলে তাদের প্রতি আমার সশ্রদ্ধ ভালোবাসা ও সালাম। কিন্তু সেই সঙ্গে এও স্মর্তব্য যে, এই সরকারের কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা দলের স্বার্থে কাজ করার অবকাশ নেই। অনেকে এই বিজয়কে কোনো দলের স্বার্থে টানার চেষ্টা করবেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন, গত পনেরো বছর তো তারা মাঠেই ছিলেন, তখন কেন তারা বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারেননি? ফলে এটির মূল নায়ক যে ছাত্রসমাজ তা সন্দেহাতীত। এখানে যেটি আরও উল্লেখযোগ্য, এবার আমরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থী ও সেই সঙ্গে তাদের অভিভাবকদের যে ভূমিকায় দেখেছি, তাতে তাদের প্রতি জনমনে ব্যাপক ভালোবাসার উদয় হয়েছে। গণ-আন্দোলনগুলোতে যে শুধু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই নেতৃত্ব দেবে, এই ধারণারও এবার যবনিকাপাত ঘটল। রাষ্ট্রের ও জাতির প্রতি কর্তব্য সবার-এই ধারণাও এবার প্রতিষ্ঠিত হলো। 

এবার সরকার পতন যে ক্লাইমেক্সের মধ্য দিয়ে হয়েছে, তাতে বিশেষজ্ঞরা এর নানামুখী ভূরাজনৈতিক ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। এর ফলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত জায়গায় ব্যাপক রদবদল হয়েছে এবং হচ্ছে বলে তাদের অভিমত। এ রকম সময়ে রাষ্ট্রের হাল ধরার জন্য এমন একজনের দরকার ছিল, যার রয়েছে বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা এবং যিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের স্বার্থকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন। বলা বাহুল্য, সেই বিচারে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিকল্প কেউ নেই। জনগণের প্রত্যাশাও তাই তার কাছে ব্যাপক। উপদেষ্টা পরিষদের বাকি ১৬ সদস্য সম্পর্কে  জনমানসে নানামুখী মন্তব্য ও মতামত রয়েছে। তারপরও তাদের যে মোটামুটি একটি গ্রহণযোগ্যতা সর্বসাধারণের কাছে রয়েছে, এ বিষয়ে সবাই একমত। কারণ বেশি খুঁজতে গেলে, ‘ঠক বাছতে গা উজাড়’ কিংবা ‘লোম বাছতে কম্বল উজাড়’-এই প্রবাদ বাক্যগুলোই এই ক্ষেত্রে সঠিক হয়ে দেখা দেবে। অবশ্য প্রশাসনিক কর্মতৎপরতার কালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেও কিছু রদবদল পরে ঘটতে পারে। আশা করা যায়, বাংলাদেশের স্বার্থ ও জনগণের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধিতে তারা প্রশংসনীয় ভূমিকাই রাখবেন। একটি বিষয় স্মর্তব্য, বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আগেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এ রকম জনসমাদৃত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগে কখনো গঠিত হয়নি। ফলে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সম্মান ও মর্যাদার উচ্চতা অনেক। আশা করি সেই বিষয়ে উপদেষ্টারা মনোযোগী হবেন। 

এই সরকারের যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে সেই আলোচনায় এবার আশা যাক। এই চ্যালেঞ্জ মূলত ত্রিমুখী; ক) অভ্যন্তরীণ খ) আঞ্চলিক ও গ) আন্তর্জাতিক। প্রথমে বলে রাখা ভালো, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কেউই পেশাদার রাজনীতিবিদ নন। অবশ্য বলা বাহুল্য যে, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা তাদের আছে। উপদেষ্টা পরিষদে দুজন ছাত্রকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে তাদের লালিত মতাদর্শগুলোও বিভিন্নমুখী। ফলে বিদ্যমান বাস্তবতায় নিজ আদর্শ এবং ব্যক্তি ও গোষ্ঠেীগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে শুধু দেশ ও জনগণের স্বার্থে কাজ করার মানসিকতা বজায় রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখাটা তাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। 

ইতোমধ্যে কয়েক দিন সরকার না থাকাতেই দেশে চুরি-ডাকাতি, সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন, মন্দির ভাঙচুর ইত্যাদি ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। এই বিষয়ে শুধু প্রশাসনকে নয়, জনগণকেও সতর্ক হতে হবে। একটি বড় ও পুরনো রাজনৈতিক দল হিসেবে গণতন্ত্রের স্বার্থে আওয়ামী লীগকেও পুনরুজ্জীবিত করা যেতে পারে; অবশ্য দলের চোর-গুন্ডা ও অর্থপাচারকারীদের আইনের আওতায় এনে। ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলও যখন ২০০৬ সালে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়, তারও সুনাম তখন খুব একটা অক্ষুণ্ণ ছিল না। তবে এও সত্য যে, আওয়ামী লীগের আমলে যে লুটতরাজ ও সম্পদ পাচার হয়েছে, সেই তুলনায় বিএনপি শিশু। কিন্তু সেও ধোয়া তুলসী পাতা নয়। 

বাংলাদেশের আঞ্চলিক বাস্তবতায় এমনকি আন্তর্জাতিক পরিসরে ভারত একটি বড় প্রভাবক। ভারতে যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে, তারই সবচেয়ে বন্ধুপ্রতিম মনোভাব ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতি। তার কারণও পরিষ্কার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয় ভারতকে পাশে রেখেই। এ ছাড়া শেখ হাসিনাও দেশত্যাগ করে ভারতেই আশ্রয় নিয়েছেন ‘সেফ জোন’ মনে করে। এর আগেও ১৯৭৫ সালের আগস্টে তার পিতা ও পরিবারবর্গের মৃত্যুর পর তিনি দীর্ঘদিন ভারতে ছিলেন। ভারতের বর্তমান বিজেপি সরকার অনেক ক্ষেত্রেই  বাংলাদেশ বিষয়ে পুরোমাত্রায় আওয়ামী লীগ নির্ভর। ফলে বাংলাদেশকে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে কীভাবে চলা যায় সেটি ভাবতে হবে। নরেন্দ্র মোদি সরকারকেও সেটি ভাবতে দিতে হবে ভূরাজনৈতিক পরিসর থেকে। আবার মোদি সরকারকেও তার আওয়ামী লীগ নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে হবে বর্তমান বাস্তবতায় ভারতের স্বার্থেই। ইসলামকে জুজু হিসেবে দেখিয়ে বিজেপি ও সংঘ পরিবারের যে রাজনীতি, সেটি বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদেরই শেষ পর্যন্ত বিপদাপন্ন করবে। সংখ্যালঘুদের স্বার্থ যেমন এখানে বিপন্ন, তেমনি তা ভারতেও। সে ক্ষেত্রে আমরা দুই দেশ সামষ্টিকভাবে কী করতে পারি তা ভেবে দেখার সময় এটি। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরুদের উসকানো কোনো সমাধান নয়, এই বার্তা আমার বাংলাদেশ ও ভারতের সব মানুষের প্রতি। 

অনেকে মনে করছেন যে, বাংলাদেশে যে সরকার পরিবর্তিত হলো, তা আরব বসন্তের মতো একটি রেজিম চেঞ্জকারী ‘বাংলাদেশ-রেইনিসিজন’ হলো নাকি? অনেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পশ্চিমের মদদপুষ্ট পশ্চিমেরই এক প্রতিভূ মনে করেন। আশা করি তিনি তার কাজে এসব যে নিছকই প্রোপাগান্ডা ও গুজব, তা প্রমাণ করে নিজেকে সম্মানজনক জায়গায় অটুট রাখবেন। অনেকে বলছেন, তিনি পশ্চিমা বলয়ে যথেষ্ট প্রভাবশালী হলেও আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে বিশেষত ভারতের সঙ্গে দর কষাকষিতে যথেষ্ট সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। আমি এর সঙ্গে একমত নই। তিনি ভারতকে বাগে রাখার মতো যথেষ্ট দক্ষ, কিন্তু সেটি বাংলাদেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে কিনা, তা নিয়েই আমি সন্দিগ্ধ। 

নাগরিক হিসেবে আমার অভিমত এই যে, সরকার অনতিবিলম্বে ছাত্ররাজনীতি অন্তত ক্যাম্পাসে বন্ধ করুক। কারণ এবার ছাত্রলীগের যে ভয়াবহ তাণ্ডব দেখেছি, ভবিষ্যতে তার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে। তবে অবশ্যই ক্যাম্পাসের বাইরে ছাত্র-ছাত্রীরা ছাত্র ফোরাম প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। কারণ বাংলাদেশে গণমুখী আন্দোলনের ইতিহাসে ছাত্রসমাজের ভূমিকা খুবই প্রশংসনীয়।

লেখক: গবেষক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫