Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

কতখানি বৈষম্যমুক্ত হবে বাংলাদেশ?

Icon

আলমগীর খান

প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২৪, ১৭:৫০

কতখানি বৈষম্যমুক্ত হবে বাংলাদেশ?

আলমগীর খান

রাজনীতি নিয়ে পণ্ডিতদের নানারকম সু- ও কুতর্ক বাদ দিয়ে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বাংলাদেশের তরুণরা এক নতুন স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। বয়স্কদের কাছ থেকে তারা নেতৃত্ব ছিনিয়ে নিয়েছে। এক বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে তারা। উন্নয়নের গল্প শুনতে শুনতে তারা ত্যক্তবিরক্ত। বয়স্কদের তুলনায় এই তরুণ সমাজ অনেক বেশি নৈতিক চেতনায় সমৃদ্ধ। মার্ক্স-এঙ্গেলস শ্রমিকদের সম্পর্কে বলেছিলেন, “হারাবার কিছু নাই, জয় করবার জন্য আছে সারা বিশ্ব।” বাংলাদেশের তরুণ ছাত্রছাত্রী সে কথাটাই প্রমাণ করলো নিজেদের বেলায়- এটা তার মেধা, সৃষ্টিশীলতা ও নতুনত্ব।

এই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের অনেক মানুষকে আবার নির্ভয়ে নিঃশ্বাস ফেলার অধিকার দিলো। কথা বলতে গেলেই এখন আর তাকিয়ে দেখতে হচ্ছে না আশেপাশে শুভঙ্কর দা আছে কিনা, লিখতে গেলেই আপাতত অন্তত কিছুদিন আর হেনস্তার ভয় নেই, হাঁটতে গিয়ে পিছনে কারো পায়ের শব্দে আর কেউ চমকে উঠছে না, গুম হওয়ার ভয়ে কাউকে রাত কাটাতে হচ্ছে না। এখন প্রত্যেকে তার নিজ দেশে বাস করছে, কারো বাপের দেশে নয়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের স্লোগান ও পরবর্তী সময়ের দেয়াল লিখনই বলে দেয় এ পার্থক্যসমূহ। ভয় ছিলো বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ও রক্ষাকবচ। দেশকে তারা কিছু দৃশ্যমান উন্নয়ন দিয়েছে- রাস্তা, দালান ও সেতুর বহর। অন্যদিকে উৎপাদনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি করেছে ভয়, আর সেটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কায়দাকানুনে। এটাই ছিলো তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি।

কিন্তু তরুণরা ক্ষমতাসীনদের চমকে দিয়ে দেখালো তারা ভয় পায় না, যা কাল হয়ে উঠলো সরকারের জন্য। সরকার ভেবেছিলো যে, পাহারাদারদের দিয়ে কিছু মানুষকে হত্যা করলেই ভয়ে চুপসে যাবে সবাই, আন্দোলন মিশে যাবে ধূলায়। ফল হলো উল্টো। নির্বিচারে নৃশংস উপায়ে নিরীহ শিশু ও তরুণ হত্যা আরও মানুষকে নিয়ে এলো বন্দুকের নলের মুখে। যারা বললো, তারা মৃত্যুকে ভয় পায় না। তখন ভয় স্থান নিলো বন্দুকধারীরই চোখেমুখে, নির্যাতনকারীর আত্মায়। মৃত্যুভয়হীন মানুষের স্রোতে কেঁপে উঠলো হত্যাকারী, কেননা এ দৃশ্য তার কল্পনার বাইরে। অবশ্যম্ভাবী হয়ে গেলো পট পরিবর্তন। 

কেন এ দৃশ্য ক্ষমতাসীনদের কল্পনার বাইরে? কারণ জেনারেশন গ্যাপ। এ এক নতুন প্রজন্ম- জেনারেশন জেড, ক্ষমতাসীনদের থেকে অনেক দুরে। পনের বছরে একটানা ক্ষমতার চূড়ায় বসবাস ও আরামদায়ক নিদ্রাযাপন তাদেরকে তৃণমূল থেকে ও বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম থেকে অনেক দুরে সরিয়ে দিয়েছিলো। তরুণ শিক্ষার্থীদের চাহিদা, আবেগ-আকাঙ্ক্ষা, দৃষ্টিভঙ্গি কোনোকিছুই ধরতে পারেনি ক্ষমতাসীন প্রজন্ম। নিজ প্রজন্মের সদস্যদের লোভ, ভয়, দম্ভ, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, পলায়নপরতা, চাটুকারিতা, চাপাবাজি, স্বার্থপরতা- এই বাটখারা দিয়েই তারা জেনারেশন জেডকে মেপেছে। এ নতুন প্রজন্মের সবাই যে একরকম, তা কখনোই নয়। তবু পার্থক্যটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের সহমর্মিতা ও সহানুভূতির চোখে না দেখা ও না বুঝতে পারাই তাদের মূল ব্যর্থতা। এ ভুলের মাশুল দিতে হয়েছে তাদেরকে বড় রকমেই। একটি পচা, সুবিধাভোগী, দুর্নীতিগ্রস্ত ও পরাজয়মুখী প্রজন্মের হাত থেকে ক্ষমতা ছুটে গেল নতুন সম্ভাবনাময় স্বপ্নবান প্রজন্মের হাতে।

কোনো সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশে এক নতুন কাল ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের জনক এই তরুণ শিক্ষার্থীরা। তবে এ আন্দোলন আকাশ থেকে পড়েনি। বাংলাদেশে রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে এ এক উজ্জ্বল অভিমুখ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্রদের ভূমিকা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা শিক্ষায় পশ্চাৎপদ এ দেশে ছাত্রছাত্রীই জনগণের সবচেয়ে সচেতন অংশ। সংগ্রামী ছাত্রছাত্রীর হাতেই সৃষ্টি হয়েছে, বায়ান্ন, ঊনসত্তর, নব্বই ও ২০২৪। বাছবিচারহীন কিছু অতি উৎসাহী তাই মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নগণ্য করে দেখার যে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করছে তা বালখিল্যতা ও নীচতা মাত্র। বায়ান্ন ছাড়া ঊনসত্তর হতো না, ঊনসত্তর ছাড়া হতো না একাত্তর, একাত্তর ছাড়া নব্বই হতো না, নব্বই ছাড়া চব্বিশও আকাশকুসুম মাত্র।

এবার ছাত্রগণঅভ্যুত্থানের মহড়া হয়েছিলো ২০১৮এর কোটা সংস্কার আন্দোলনে ও কিশোর বিদ্রোহে। সেদিনের কিশোর বিদ্রোহে রোপিত হয়েছিলো ৬ বছর পরের এই অভ্যুত্থানের বীজ। সেই একই দেশপ্রেম, নৈতিক দৃঢ়তা, আমূল পরিবর্তনের গভীর আকাঙ্ক্ষা, আত্মবিশ্বাস, অন্যায়ের সঙ্গে আপোশহীনতা। সর্বোপরি সেদিনের মতই এবারও দেশবাসীর ও সর্বশ্রেণির মানুষের মমতা, আস্থা, মৌন ও সক্রিয় সমর্থন ছিলো এই তরুণ শক্তির প্রতি। এই তরুণ জনগোষ্ঠির সবচেয়ে বড় শক্তিটি কি ছিলো?

তাদের নিষ্কলুষতা যা অরাজনৈতিক বলে পরিচিতি লাভ করেছে। নিঃসন্দেহে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোনো অরাজনৈতিক আন্দোলন হতে পারে না, এর নামেই সে সুযোগ বিলুপ্ত। কিন্তু এ আন্দোলন এক বড় জোটের বার্তাবহ, যা দলীয় নয়। যেহেতু প্রচলিত দলের প্রায় সবই কোনো না কোনোভাবে পরীক্ষিত ও বিভিন্নরকমে কলুষিত, তাই প্রয়োজন হয়েছে এক নতুন প্ল্যাটফর্মের যা অদলীয় বা অরাজনৈতিক রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। এরপরে ইতিহাসের মঞ্চে সংঘটিত করেছে মুক্তিযুদ্ধের পর এদেশে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ঘটনা ও পট পরিবর্তন। যে পট পরিবর্তন কেবল ক্ষমতার হাত বদলে সীমাবদ্ধ না থেকে বড় রকমের সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি বহন করছে।

কিন্তু স্বপ্ন তো একাত্তরেও ছিলো, ছিলো নব্বইয়েও- বৈষম্যহীনতার ও সাম্যের স্বপ্ন। এবার যার স্পষ্ট ঘোষিত নাম- বৈষম্যবিরোধিতা। আগের স্বপ্ন ভেঙে গেছে ঘুমেই, জেগে মানুষ দেখেছে আরেক দুনিয়া যা আগের মতই বা এমনকি মনে হয়েছে তারও চেয়ে মন্দ। ভেঙে যেতে পারে এবারের স্বপ্নও। তবে ভেঙে গেলেও অনেকদিন বা কাল ধরে থাকবে এ স্বপ্নের রেশ।

স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার বাহ্যিক কারণ অনেক- আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক শক্তির ভারসাম্য, টানাপড়েন এবং তাদের কিছু ভুল ও কিছু ঠিক পদক্ষেপ। এছাড়া এ সংকটের বীজ নিহিত আছে এ ছাত্রগণঅভ্যুত্থানের ভিতরেও। সমাজে যে শ্রেণির সত্যিকারভাবে হারাবার কিছু নেই, তাদের আশা কতটা পূরণ করতে পারবে নতুন রাজনৈতিক ক্ষমতাকাঠামো? আবার- কোটা না মেধা? মেধা মেধা- এ মন্ত্রেও লুকানো আছে পতনের বীজ।

বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে ক্রমান্বয়ে মেধার যে কারাবাস, বিপর্যয় ও হত্যা হয়েছে- কোটা, স্বজনপ্রীতি, দলপ্রীতি, অর্থ, সন্ত্রাস ইত্যাদি খড়গের নিচে- তা থেকে মেধার সত্যিকারের মুক্তি হবে এখনকার প্রধান চ্যালেঞ্জ। তারপর থাকবে আরও বড় চ্যালেঞ্জ- কোন শ্রেণির মানুষের মেধা, কোন জীবনদর্শনের অনুসারী, কোন স্বার্থের রক্ষক সে, কার সেবাদাস ইত্যাদি জরুরি প্রশ্ন। প্রথম চ্যালেঞ্জটি মোকাবেলা করার সময় থেকেই দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জের হিসাব রাখা জরুরি- না হয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন তার ঘোষিত লক্ষ্য থেকে বাস্তবে অনেক দূরে সরে যাবে। ক্ষমতার পালাবদল ও ক্ষমতাগ্রহণ কঠিন, কিন্তু টাইমমেশিনে চড়ে ভবিষ্যৎ থেকে পিছন ফিরে তাকানো গেলে বোঝা যেত ঐ স্বপ্নপূরণের তুলনায় ক্ষমতাগ্রহণও কতই না সহজ! প্রফেসর ইউনূস ব্যক্তিগত স্বপ্নপূরণে পৃথিবীতে হাতেগোনা দুচারজন সফল মানুষের মাঝে একজন। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের ও জাতির স্বপ্নপূরণে তিনি ও তার নেতৃত্ব কতখানি সফল হবে- তা বলা অনেক কঠিন। 

লেখক: সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি (ছোটকাগজ) 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫