Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

ছাত্র ও সরকারের আচরণে জনতুষ্টিবাদের বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান

Icon

আবু নাসের অনীক

প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২৪, ১৭:৫৩

ছাত্র ও সরকারের আচরণে জনতুষ্টিবাদের বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান

আবু নাসের অনীক

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদ-স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছে। দেশের জনগণ একটি নতুন স্বপ্নের জাল বুনেছে দীর্ঘ ১৫ বছর পর। অভ্যুত্থানটি সাধারণ ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে শুরু হলেও পরবর্তীতে এর সাথে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক দলসমূহ, ছাত্র সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সাধারণ জনতা। তবে নেতৃত্বে থেকেছে ছাত্রসমাজ। সহস্রাধিক প্রাণের বিনিময়ে আওয়ামী সরকারের পতন ঘটেছে। 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, বেঞ্চ বিচারপতি নিয়োগ থেকে শুরু করে সরকারের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমাদের কাছে দৃশ্যমান হয়েছে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ সরাসরি প্রভাব বিস্তার করছে।

সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ব্যানার হিসাবে এবং তরুণ প্রজন্মের চিন্তার প্রতিফলন হিসাবে এটাকে জনগণ ইতিবাচক হিসাবেই গ্রহণ করেছে। কিন্তু সরকার এবং তাদের বর্তমান কর্ম তৎপরতায় এক ধরণের আশঙ্কাবোধের সৃষ্টি হচ্ছে। যে পদ্ধতিতে এবং যেসমস্ত বিষয়বস্তুকে সামনে রেখে তারা অ্যাক্ট করছে সেটির সাথে জনতুষ্টিবাদ বা পপুলারিজম এর সাদৃশ্য খুজেঁ পাওয়া যাচ্ছে।

আসুন, আমরা বোঝার চেষ্টা করি জনতুষ্টিবাদ আসলে কী? জনতুষ্টিবাদ শুধু একটি মতামত গ্রহণ করে। তাদের দৃষ্টিতে, তারাই একমাত্র এই মতামতটি জানে এবং বুঝতে পারে, তাই তারাই একমাত্র যারা জনগণের প্রয়োজনে দাঁড়াতে পারে। এটিই জনতুষ্টিবাদের দার্শনিক ভাবনা।

মজার বিষয় হলো, তাদের কাছে এই ‘জনগণ’ সিলেকটিভ। জনগণের মধ্যে যারা তাদের অনুসারী হবে এবং তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপকে ইতিবাচকভাবে দেখবে ও প্রশংসা করবে-শুধুমাত্র তাদেরকেই তারা প্রকৃত জনগণ হিসাবে মনে করবে। এর বাইরের অংশ তাদের দৃষ্টিতে জনগণের কাতারে পড়বে না।

এই অংশটিকে তারা সাধারণত ষড়যন্ত্রকারী বা চক্রান্তকারী হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করে। সেজন্য দেখা যায়, কোন জনতুষ্টিবাদী শাসক যখন প্রভূত ক্ষমতার মালিক হয়, তখন তাদের কর্তৃত্ববাদী চেহারা প্রকাশিত হয়।

এরফলে তারা জনগণের অনেক অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে থাকে। বিভিন্ন চটকদারী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে তারা জনগণের সামনে সবসময়ের জন্য দৃশ্যমান থাকতে চায়। নিজেদের অপরিহার্যতাকে গ্রহণীয় করে তোলার জন্য কাঠামোগত সংস্কারের কথা বলা হলেও ব্যক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে। নিজেকে সবার সেরা মনে করা এবং জোর করে নিজেকে জনপ্রিয় করে রাখার এক ধরণের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। পপুলারিজমকে একারণে গণতন্ত্রে উত্তরণের ও বিকাশের ক্ষেত্রে একটি বাধা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। 

গণতন্ত্রে নানা পথ-মতের মিথস্ক্রিয়াতে নেতৃত্ব বিকাশের যে সম্ভাবনা থাকে এখানে সেই পথটি রুদ্ধ হয়ে যায়। একটি চরমপন্থী অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠা রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পপুলারিস্টদের উত্থান ঘটে।

সাধারণ মানুষের অনুভূতিকে কেন্দ্র করে নতুন চেতনার বিকাশ ঘটানোর প্রয়াস নেওয়া হয়। বিভিন্ন ধরণের স্পর্শকাতর এবং ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহকে নতুন নির্মিত চেতনার সাথে মিলিয়ে একটি ব্যবস্থাপনা তৈরি করা হয়। যেই ব্যবস্থাপনার অধীনে কোন ধরণের কোন প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ রাখা হয় না।

নিজেদের ইচ্ছামতো গড়ে তোলা এই চেতনা কাঠামোর মাধ্যমে নতুন রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামো সৃষ্টি করা হয়। যার সর্বশেষ গন্তব্য হয়ে ওঠে ফ্যাসিবাদে। 

আমার উপরের আলোচনার ধারাবাহিকতাতে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এবং সরকারের তৎপরতা মিলিয়ে দেখার অনুরোধ করবো। ইতিমধ্যে তারা তাদেরকেই জনগণ মনে করছে যারা তাদের কার্যক্রমকে শর্তহীনভাবে প্রশংসা করছে। যারা শর্তহীনভাবে প্রশংসা করছে না তারা তাদের কাছে চক্রান্তকারী এবং ‘দালাল’ হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এখন দেশের প্রভূত ক্ষমতার মালিক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। সেই ক্ষমতাবলে ১৫ আগস্টে ৩২ নাম্বারে লুঙ্গি ড্যান্স হয়েছে। সেই ক্ষমতাবলে এইচএসসি পরীক্ষা ২০২৪-এর অবশিষ্ট পরীক্ষা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিতে তারা বাধ্য করেছে। এইচএসসিতে সব মিলিয়ে অংশগ্রহণকারী ১৪ লাখ ৫০ হাজার ৭৯০ পরীক্ষার্থী। এর মধ্যে কত জন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন? কতজন শহীদ হয়েছেন? কত জন আহত? কত সময় পরীক্ষা পিছিয়েছে? 

এই সবকিছু এড্রেস করেও বিকল্প পদ্ধতিতে বাকী পরীক্ষা নেওয়া অবশ্যই সম্ভব ছিল। কিন্তু ছাত্ররা সরকারী সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য করলো। 

কাঠামোগত সংস্কারের পরিবর্তে তারা সর্বক্ষেত্রে ব্যক্তি পরিবর্তনকে অধিকতর গুরুত্বারোপ করে ভূমিকা নিচ্ছে। সিভিল প্রশাসনে যে রদবদল করা হচ্ছে তাতে কী সুবিধা পাওয়া যাবে সেটি বোধগম্য নয়। কারণ গত ১৫ বছর ধরে যারা এখানে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়েছে তার বড় অংশই বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সাথে সম্পর্কিত ছিল। আর যারা পদোন্নতি বঞ্চিত ছিলেন এরা অধিকাংশই বিএনপি-জামাত সমর্থক কর্মকর্তা। তারা এখন পদোন্নতি প্রাপ্ত হয়ে পদায়ন হচ্ছে। অর্থাৎ স্বচ্ছতা নিশ্চিত হচ্ছে না। এর বিপরীতে যেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন জবাবদিহিতা। সেদিকে তাদের নজর কম। 

ছাত্ররা হুটপাট করে রীতিমত ডিকটেট করে বিচারপতি পরিবর্তন করলো। অথচ এখন পর্যন্ত জুডিশিয়ারি রিফর্ম কমিশন গঠনের কোন উদ্যোগ নেই। একইরকমভাবে আমলাতন্ত্রের সংস্কারের বিষয়েও কোনও পদক্ষেপ নেই। দখলদারি ছাত্র রাজনীতি ঠেকানোর জন্যে তারা সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দিচ্ছে। তারা তো এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের একক স্টেকহোল্ডার নয়।

অথচ এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করেও শিক্ষক-ছাত্র-রাজনীতিবিদ সবার সমন্বয়ে একটি কমিশন গঠন করে কাঠামোগত সংস্কার করা সম্ভব। কিন্তু তারা সে পথে হাঁটছে না। অথচ ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’এর ব্যানার সক্রিয় রেখে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করছে। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হলে উঠতে চাইলে এখন তাদের চিরকুট ছাড়া ওঠা যাচ্ছে না। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররা শিক্ষকদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে, অপমান করে তাৎক্ষনিকভাবে পদত্যাগ করতে বাধ্য করছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে কাঠামোগত পদ্ধতিতেই তো অপসারণ করা সম্ভব। সেটি না করে তারা যে আচরণ প্রদর্শন করছে সেটি চরম কর্তৃত্ববাদীতার সামিল। 

সরকার বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কার্যক্রম সম্পর্কে কোন ধরণের প্রশ্ন উত্থাপন করলেই কিছু কমন ডায়লগ দেওয়া হচ্ছে সেই সিলেক্টিভ ‘জনগণ’ এর পক্ষ থেকে। বক্তব্যগুলি এমন,‘এখন বিভেদের সময় নয়, বরং ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে নেওয়ার’; ’১৫ বছরের দুঃশাসন ১৫ দিনে ঠিক হচ্ছেনা দেখে অনেকেই অস্থির’; ’১৫ বছর ধরে প্রশ্ন করেন নাই, এখন কেন প্রশ্ন করতে হবে’। এমন আরো নানা ধরণের কথা। এধরনের কথা জনতুষ্টিবাদকে রক্ষা করে।

লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, জনতুষ্টিবাদ এমন ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে চায় যার অধীনে কোন ধরণের কোন প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ রাখা হয় না। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য প্রশ্ন করাটা খুবই জরুরি। যতো প্রশ্ন করা হবে ততোই সঠিকভাবে তার কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সেটি সহায়ক হবে। 

আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে,  সহস্র প্রাণের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটেছে— পতিত সরকারটি প্রাথমিক অবস্থায় জনতুষ্টিবাদকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়েছিলো। স্বাভাবিকভাবেই এক পর্যায়ে তারা ফ্যাসিবাদে রুপ নেয়। দীর্ঘ সময় ধরে ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা টিকে থাকার কারণে আমাদের মনে অজান্তেই ব্যক্তিক পর্যায়েও ফ্যাসিবাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদীতা যেমন হঠাৎ করে চলে যাবে না একই রকমভাবে ব্যক্তিরটাও যাবে না। 

একটি ফ্যাসিবাদী সরকারকে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে নেতৃত্ব পতন ঘটায় সেই নেতৃত্বেরও জনতুষ্টিবাদে ভুগে আবারও ফ্যাসিবাদে রুপান্তরের সমূহ সুযোগ থাকে। বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে তার নজির আছে। বিভিন্ন জায়গাতে যেখানে জনতুষ্টিবাদের আধিপত্য দেখা গেছে জনগণের সন্তুষ্টি বিধানের শ্লোগানকে ভিত্তি করে; সেখানেই জনবিক্ষোভের কারণে তাদের বিনাশ হয়েছে। কিন্তু জনগণের এই উন্মত্ততার মধ্যেও আবার কিছু ব্যক্তিকেন্দ্রিক জনতুষ্টিবাদী চরিত্র সৃষ্টি হয়ে যায়। 

জনগণের পুঞ্জিভূত ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে এরা নিজেদের জনতুষ্টিবাদী আচরণ প্রকাশ করতে থাকে। এদের নির্দিষ্ট কোন আদর্শ বা দর্শন থাকে না। সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দর্শন এর অনুপস্থিতিতে বিগত জনতুষ্টিবাদীদের জায়গায় নতুন জন্ম নেওয়া জনতুষ্টিবাদীদের উত্থান পাল্টা একটি রাজনৈতিক সংকট তৈরি করে। আমরা যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাটি চাইছি তার জন্য আমাদের কাঠামোগত সংস্কার জরুরি এই মুহূর্তের বাস্তবতায়। কিন্তু অতি অবশ্যই এই প্রক্রিয়ার সাথে দেশের ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক শক্তিসমূহকে যুক্ত করতে হবে। 

আগামী দিনের রাষ্ট্র পরিচালনার চ্যালেঞ্জসমূহ তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার পথনির্দেশ তাদের কাছ থেকেই নিতে হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫