Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

সেইসব অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা জরুরি

Icon

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৪, ১৪:৩৬

সেইসব অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা জরুরি

ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

ছাত্র আন্দোলন নতুন কোনো বিষয় নয়। অনেক আগে থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শোষণ, নিপীড়ন,  নির্যাতনের বিরুদ্ধে ছাত্ররাই প্রথম আন্দোলনের সূচনা করেছে।  কিন্তু সংকট হলো কর্তৃত্ববাদ। কর্তৃত্ববাদ কোন সমাজে একবার জায়গা করে নিলে তারা কোনও আন্দোলন-সংগ্রামকে গুরুত্বতো দেয়ই না বরং নির্মমভাবে দমন করে থাকে। ছোট আন্দোলনও যে কালক্রমে দাবানল হয়ে উঠতে পারে তা ক্ষমতায় যাওয়ার পর তাদের মাথায় ঢোকে না। 

কোটা আন্দোলনের শুরু হয়েছিলো ২০১৩ সালে। তখন সে আন্দোলনকে তৎকালীন সরকার আমলে নেয়নি। আন্দোলন কিন্তু থেমে থাকেনি। ২০১৮ সালে  এ আন্দোলন অনেক শক্তি সঞ্চয় করে এসে দাঁড়ায়। ৮ এপ্রিল ঢাকার শাহবাগে কোটা সংস্কারের পক্ষে বিক্ষোভ শুরু হয়, আস্তে আস্তে সেটি দেশের বিভিন্ন  কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এবং শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে। পুলিশ কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা, ধরপাকড় চালিয়ে যেতে থাকে। একই সঙ্গে ছাত্রলীগের আক্রমণও অব্যাহত থাকে। তখন দেশের লেখক ও শিক্ষকদের একটি অংশ কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়ান। শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলন ও অবস্থান কর্মসূচির ফলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের দাবি মেনে নিয়ে, ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে সব রকমের কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন। 

আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে  নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের ইতি ঘটে এখানেই।  একই সময় আরেকটা আন্দোলনের সূচনা হয়। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। ঢাকায় ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দ্রুতগতির দুই বাসের সংঘর্ষে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া নিহত হয় ও ১০ জন শিক্ষাার্থী আহত হয়। এই মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিহত  দুই কলেজ শিক্ষার্থীর সহপাঠীদের মাধ্যমে শুরু হওয়া বিক্ষোভ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এসময় সড়ক পরিবহনের নেতা ও তৎকালীন নৌমন্ত্রী শাহজাহান খানের পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। 

শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমন করতে পুলিশ নামে। তাদের ওপর লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে  তাদের ছত্রভঙ্গ করে  দেয়ার চেষ্টা করে। পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগ ও সরকার-সমর্থক যুবকেরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকদের ওপর হামলা করে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং ছাত্রছাত্রীদের ওপর সরকারের দমনপীড়ন দেশে ও বহির্বিশ্বে তীব্রভাবে নিন্দিত হয়। পরবর্তীতে ৬ আগস্ট বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৃতীয় মন্ত্রিসভা একটি খসড়া ট্রাফিক আইন অনুমোদন করে ঠিকই কিন্তু চালকের মৃত্যুদণ্ড বিষয়টি চাপা পড়ে থাকে। 

৮ আগস্টের মধ্যে শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠলে সরকার ভেবেই নেয় আন্দোলন থেমে গিয়েছে। কিন্তু একটা বিষয় এখানে বলা দরকার, আমরা স্পষ্ট করে দেখলাম সরকার পুলিশ ও হেলমেট বাহিনীকে দিয়ে যে দমন পীড়ন চালালো তাতে একটি প্রজন্ম তাদের বিরুদ্ধে চলে গেল। এ বিষয়টি নিয়ে সরকার একবারও ভাবল না। একটা প্রজন্ম একটি সরকারের বিরুদ্ধে যাওয়া মানে কি শুধু ওই প্রজন্ম? তার ভাই-বোন বন্ধু- আত্মীয় স্বজন সবই এই ঘটনার সঙ্গে পরোক্ষভাবে যুক্ত। তাই ঘটনা সামান্য নয়, যেটা কর্তৃকর্তৃত্ব বুঝতে বারে বারে ভুল করে।  তাই পুঁজিবাদী সমাজে এসব সরকার সব ঘটনাগুলোকে দমন করে ‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ানোর মতো’ ঘটনা ভেবে বিষয়গুলি আমলে নিলো না। 

২০২০ সালে ঘটলো আরেক ঘটনা। ২০ জানুয়ারি কোটার বিষয়ে আগের জারি করা পরিপত্র স্পষ্ট করার পাশাপাশি মন্ত্রিসভার বৈঠকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সরকারি চাকরিতে অষ্টম বা তার ওপরের পদেও সরাসরি নিয়োগে কোটা বাতিলের প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়। উক্ত পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে অহিদুল ইসলামসহ সাতজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। ২০২৪ সালের ৫ জুন বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই পরিপত্র বাতিল করে রায় দেন ও কোটা পুনরায় বহাল করেন। যার ফলে পুনরায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। 

শুরুতে আন্দোলন সভা-সমাবেশের মধ্যে স্থির থাকলেও ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এক বক্তব্যে কোটা আন্দোলনকারীদের প্রতি অপমানজনক মন্তব্য করেন। এছাড়া আ.লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘আন্দোলনকারী ছাত্রদের জবাব ছাত্রলীগ রাজপথে দেবে’। এতে ছাত্ররা প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। আন্দোলন চলাকালীন বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠি, রড, হকি স্টিক, রামদা, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা করে। একই সাথে পুলিশও লাঠি, রাবার বুলেট দিয়ে হামলা চালাতে থাকে। প্রতিবাদে আন্দোলনকারীও তাদের দিকে ইটের টুকরা ছুঁড়ে জবাব দিতে থাকে। 

এসব হামলার ফলে ১৬ জুলাই থেকে আন্দোলন  আরও তীব্র হয়ে ওঠে। এদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হলে আন্দোলন পুরো দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯ জুলাই পর্যন্ত ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের অনান্য সংগঠন, বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ মাঠে নামিয়ে এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে আন্দোলন থামাতে ব্যর্থ হয়ে সরকার দেশজুড়ে কারফিউ জারি করে। দেশে সেনাবাহিনী নামানো হয়। এইসব ঘটনায় সারাদেশে প্রচুর আহত ও নিহতের ঘটনা ঘটে, এবং পুলিশ প্রায়  ৫০০ মামলা করে, গ্রেপ্তার করে অসংখ্য ছাত্র ও সাধারণ নাগরিককে। 

২১ জুলাই বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করে, এবং সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করে। ২২ জুলাই এই বিষয়ে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে।  কিন্তু ততদিনে বুড়িগঙ্গায় গড়িয়ে গেছে অনেক পানি। সরকার দমনপীড়নের চূড়ান্ত জায়গায় অবস্থা নিলো। ব্যবহার করলো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। ক্ষমতার মমতায় সরকার এদের লেলিয়ে দিলো ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে। একইসঙ্গে নামল ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সরকারের সহযোগীরা। এই দমন-পীড়ন কোন অবস্থায় রূপ নিয়েছিলো তা নিয়ে দেশী বিদেশী অনেক সংস্থা কাজ করেছে। তাদের রিপোর্ট দেখলে বোঝা যাবে ক্ষমতা রক্ষায় একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার কিভাবে কয়েকদিনে ৭৫৮ লোককে হত্যা করেছে। তাদের বেশির ভাগই নিহত হয়েছে প্রাণঘাতী অস্ত্রের গুলিতে। 

বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির হিসাবে, ৭০ শতাংশ মৃত্যুই হয়েছে গুলিতে। আহতদের সংখ্যা কয়েক হাজার। কী সব ভয়ংকর অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে ছাত্রসহ সাধারণ মানুষ ও শিশুদের উপর। এর মধ্যে ৪ আগস্ট এক দিনেই সারা দেশে নিহত হয় ১১৬ জন। ওই দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের অনেক  নেতা-কর্মীকে আন্দোলনকারীদের ওপর প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করতে  দেখা  গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ প্রয়োগের মতো পরিস্থিতি না থাকা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে গুলিবর্ষণের মতো ঘটনা ঘটেছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন ছবিতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলায় অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগে ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের হাতে শটগান, বন্দুক ও পিস্তল বেশি দেখা গেছে।  কোথাও কোথাও রাইফেলও  দেখা গেছে।  ফেনীতে সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর অনুসারীরা একে-৪৭ ও এম-১৬ রাইফেল দিয়েও গুলি করেছেন বলে স্থানীয় সূত্রের বরাতে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। 

৫ আগস্ট বিভিন্ন থানা থেকে পুলিশও অনেক গুলি চালিয়েছে। সবচেয়ে  বেশি গুলির ঘটনা ঘটেছে যাত্রাবাড়ীতে। আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করার  ক্ষেত্রে শটগান, পিস্তল ও চাইনিজ রাইফেল এই তিন  শ্রেণির অস্ত্রের ব্যবহার  হয়েছে।  কোথাও  কোথাও এসএমজি ও এলএমজির মতো অস্ত্রও ব্যবহৃত হয়েছে।

এ সকল তথ্য গণমাধ্যমে এসেছে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। যারা অস্ত্র বিশেষজ্ঞ তারা এসব বিষয়ে ভালো বুঝবেন। কিন্তু সহজভাবে যে ভাবনা করতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না তাহলো যদি একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে দমন করতে এসএমজি, এলএমজি, চাইনিজ রাইফেল ব্যবহার হয়ে থাকে সেটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। নিরস্ত্র ছাত্র আন্দোলনকে নিবৃত্ত করতে আলোচনাই যেখানে যথেষ্ট ছিল সেখানে এধরণের অস্ত্র যেভাবে ব্যবহার করা হলো তা কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। 

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত  যেসব আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স  বেসামরিক জনগণকে  দেয়া হয়েছে তাদের প্রদান করা লাইসেন্স স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে। আগামী ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে লাইসেন্সকৃত আগ্নেয়াস্ত্র ও  গোলাবারুদ সংশ্লিষ্ট থানায় জামা দিতে বলা হয়েছে। এই সময় এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে যথাযথ। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যেসব অবৈধ অস্ত্র (যেসব অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয় না) ব্যবহার করা হয়েছে, সেসব অস্ত্রের গতি কি হবে? 

যেসব অস্ত্র ব্যবহারের ছবি গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময় ব্যবহার হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নিশ্চয়ই এতদিনে শনাক্ত করেছেন। যদি সেসব অস্ত্র এখনো কারো হাতে রয়েই যায় তাহলে সেগুলো উদ্ধার করা জরুরি।  যারা এসব অস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে এবং যারা এর যোগানদাতা এদের আইনের আওতায় আনা দরকার।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫