শিশু-কিশোরদের বুকের রক্ত এবং অন্তর্বর্তী সরকারের চ্যালেঞ্জ

রইসউদ্দিন আরিফ
প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২২:৫৪

রইসউদ্দিন আরিফ। ফাইল ছবি
গত ১৯ আগস্ট এক দৈনিকে বড় ক্যাপশনসহ প্রকাশিত ছোট্ট একটি প্রতিবেদন, সকল পাঠকের মনের অনুভূতিকে নিশ্চয়ই প্রবল নাড়া দিয়েছে। এক ভয়ংকর ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক বিজয়ের পর, দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম শুরু হয়েছে-এই মর্মে লেখা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ‘রাজধানীর বিএএফ শাহিন কলেজের একাদশ শ্রেণির স্থগিত পরীক্ষা আবার শুরু হয়েছে।’
প্রতিবেদনের ক্যাপশনে দেখা যায়, শ্রেণিকক্ষের আসনে বসে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিচ্ছে, তার মধ্যে একটি আসন ফাঁকা। সেখানে রাখা আছে একটি বড় ফুলের তোড়া। তার পাশে কাগজে লেখা রয়েছে একটি নাম-‘শাফিক উদ্দিন আহম্মেদ আহ্নাফ’।
আহ্নাফ নামটি এখন বাংলাদেশের লাখো-কোটি মানুষের কাছে পরিচিত, শহীদ আবু সাঈদসহ আরও বহু শহীদের মতো এক রক্তে ভেজা নাম। সে গণ-অভ্যুত্থানে যোগ দিয়ে, মিরপুর ১০ নম্বরে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। গুলি তার বুকের ডান দিকে ঢুকে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। এ পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী অভ্যুত্থানে নিহত ৬৩০ জনের মধ্যে অন্তত ৮৯ জন শিশু-কিশোর। আহ্নাফ তাদেরই একজন। সে ছিল বিএএফ শাহিন কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র।
স্বৈরাচার পতনের ১০ দিন পর পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটি পড়ে এবং ক্যাপশনে পরীক্ষাকেন্দ্রের একটি কক্ষে পরীক্ষায় মনোনিবেশরত ছাত্রদের মধ্যে একটি ফাঁকা আসনে, আহ্নাফকে উৎসর্গকৃত ফুলের তোড়াটি দেখে আমি অশ্রুসংবরণ করতে পারিনি। সকালের নাশতা মুখে দিয়ে গিলতে পারিনি। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি। আমি নিশ্চিত, পত্রিকার পাতায় এই দৃশ্য দেখে অনেকেই চোখের পানি আটকে রাখতে পারেননি। অনেকেই হয়তো কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
সত্যিই আমাদের বাকরুদ্ধ হয়ে যায় এ কথা ভাবলে যে, এই ৮৯ জন শিশু-কিশোরকে নিয়ে আমাদের স্বপ্নগুলো কীভাবে হারিয়ে গেল! তাদের মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বজন-পরিজনের কথা একবার ভাবুন। কী রকম অসহনীয় যন্ত্রণায় বুক বিদীর্ণ তাদের। আহ্নাফ কি কলেজ ছুটির পর বাড়িতে ফিরেছে? না, ফেরেনি। কোনোদিন আর ফিরবে না। দুগ্ধপোষ্য সেই শিশুগুলো কি এখন মায়ের বুকের দুধ পান করার জন্য সজোরে কান্না করছে? না, করছে না, কখনোই আর করবে না। স্বৈরাচারের বুলেট তাদেরকে বাঁচতে দেয়নি। শত শত আহত কিশোর-যুবা সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে না। স্বৈরাচারের বুলেট তাদেরকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে।
দুই
কারা এই স্বৈরাচারী? শুধুই কি শেখ হাসিনা, নাকি তার দোসররাও, এমনকি তার পৃষ্ঠপোষণকারীরাও? এই দোসর ও পৃষ্ঠপোষকরাই বা কারা? তারা তো অবস্থান করে, মুক্তিযুদ্ধের একক নেতৃত্বের দাবিদার দলের মধ্যে। অবস্থান করে তারা ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার’ মধ্যে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অর্থ কি স্বৈরাচার? ফ্যাসিবাদ? অসংখ্য শিশু-কিশোর-যুবার বুকের ফিনকি দেওয়া রক্ত?
স্বৈরাচারীর দোসররা তো অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারণকারী সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রণালয়, গোয়েন্দাবাহিনী, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা ও সংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজসহ সর্বত্র। স্বৈরাচারের দোসর ও পৃষ্ঠপোষকরা তো কেউ ছাত্র, কেউ শিক্ষক, কেউ সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা, আমলা, বুদ্ধিজীবী, কবি-লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিক, কেউ বিচারক, কেউ দেবতুল্য পণ্ডিত-দার্শনিক-বিজ্ঞানী। এমনকি অফিস-আদালতসহ সকল প্রতিষ্ঠানের বিপুল সংখ্যক সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। কোথায় নেই তারা?
স্বৈরাচারী এবং তাদের দোসর ও পৃষ্ঠপোষকদের কোনো ব্যক্তি বা দল সৃষ্টি করে না। এদের সৃষ্টি করে বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থা ও ‘পবিত্র’ সংবিধান। এই বিদ্যমান সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার কারণেই, বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে ৫৩ বছর ধরেই তৈরি হয়েছে স্বৈরাচারী এবং তাদের দোসর ও পৃষ্ঠপোষকরা। এক স্বৈরাচারের পতন হয়েছে, আরেক স্বৈরাচার তৈরি হয়েছে। এই সবকিছুর মূল উৎস হচ্ছে আমলা-বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং আমলা-বুর্জোয়া আইন ও সংবিধান। রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র (সংবিধান) জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য প্রতিষ্ঠা না হওয়ার কারণেই এই মহাবিপর্যয়।
তিন
আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলি, কিন্তু কোনটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আর কোনটি আমলা-বুর্জোয়া রাষ্ট্র-এ দুইয়ের মধ্যে ফারাক বুঝি না। আমাদের রাজনৈতিক চেতনা ভোঁতা হয়ে আছে। অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলি আমরা। আমলা-বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমাদের চেতনাকে এমন ভোঁতা করে দিয়েছে যে, একচেটিয়াভাবে সমাজের ওপরতলার লোকদের, কোটি কোটি টাকার ভোটবাণিজ্যের যে নির্বাচন হয়, তা যতই অবাধ ও নিরপেক্ষ হোক, সেটি যে জনগণের নির্বাচন নয়, আমলা-বুর্জোয়াদের নির্বাচন-তা বোঝার বোধশক্তিও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে প্রধানত দেশের শ্রমিক, কৃষকসহ সকল পেশা ও সকল স্তরের লোকদের প্রতিনিধিত্ব ও অংশীদারত্বের ভিত্তিতে।
চার
আজকে রাষ্ট্রের ‘মেরামত’ এবং সংবিধান সংস্কারের স্লোগান উঠেছে। এটি খুবই এক অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাপূর্ণ স্লোগান। এই স্লোগান শুনে মনে হয়, আমাদের রাষ্ট্রটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই ছিল, কিন্তু গণতন্ত্রবিরোধী ফ্যাসিস্টরা ক্ষমতায় গিয়ে পনেরো বছরে রাষ্ট্রব্যবস্থাটিকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে, তাই এর মেরামত দরকার। প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্র ব্যবস্থাটি, কম আর বেশি, কবে লণ্ডভণ্ড ছিল না? পূর্বের লণ্ডভণ্ডের চেয়ে তফাত হচ্ছে, ভয়ংকর ফ্যাসিস্টরা দীর্ঘদিন ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ভয়াবহ রকমের লণ্ডভণ্ড করেছে। কিন্তু মেরামত করলেও এটি আমলা-বুর্জোয়া রাষ্ট্রই থেকে যাবে। ফলে যখনই হোক, দেশে পুনরায় গণতন্ত্রহীনতা ও ফ্যাসিবাদের উত্থানের আশঙ্কা থেকেই যাবে।
পাঁচ
তবে এবারের পরিস্থিতি ব্যতিক্রমিকভাবে একেবারেই ভিন্ন। ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে, তরুণ ছাত্রসমাজ এবং জনগণের মধ্যে যে আকাঙ্ক্ষা, অভিপ্রায় ও অঙ্গীকার তৈরি হয়েছে, সেটি আমলা-বুর্জোয়া রাষ্ট্রের মেরামতের অঙ্গীকার নয়। এই অভিপ্রায় ও অঙ্গীকার, বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থার খোল-নলচে পাল্টে দিয়ে জনগণের সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। এটি একটি পূর্ণ সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার।
ছয়
গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সাময়িকভাবে ক্ষমতায় আসা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার যদি ছাত্র-জনতার অভিপ্রায়, অঙ্গীকার ও সংকল্পের বিষয়টি অনুধাবন করতে সক্ষম হন, তাহলে তাদের বিজ্ঞোচিত কাজ হবে, যথাসম্ভব দ্রুতসময়ের মধ্যে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সংবিধানের যতটা পারা যায় পরিবর্তন এনে, ছাত্র-জনতার অভিপ্রায় বাস্তবায়নের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা। সে ক্ষেত্রে আমাদের মতে এবং দেশের অনেক বিজ্ঞজনের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের জরুরি কাজ হবে, বিদ্যমান সংবিধানের শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, এমন আইনগুলো রেখে, অন্যসব আইন ও কালাকানুন বাতিল করে প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থাসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্বিন্যাস করা। একটি সত্যিকারের সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ও আদর্শিক শক্তি গড়ে ওঠার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করাই হলো এখনকার প্রধান কাজ।
দেশের শ্রমিক-কৃষকসহ ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সকল পেশার মানুষের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণমূলক একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারলে, সেটিই হবে দেশ ও জনগণের প্রতি ড. ইউনূস ও তার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। কিন্তু বড় প্রশ্ন হচ্ছে, এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব তারা পালন করবেন অথবা করতে পারবেন কি?
রইসউদ্দিন আরিফ
লেখক ও গবেষক