
ছবি: সংগৃহীত
বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের জোর করে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়ার ঘটনা ঘটছে একের পর এক। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়দিন এধরনের খবর থাকছেই। একটি অপমানজনক আয়োজনের মাধ্যমে একজন শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করানোর ঘটনা ঘটছে। ইতিমধ্যে এ ধরনের অপতৎপরতায় অনেক শিক্ষককে একটি দুঃখজনক প্রক্রিয়ার মধ্যে তাদের দীর্ঘদিনের শিক্ষকজীবন থেকে বিদায় নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। যা সাদাচোখে দেখলে যে কেউ একে অন্যায়কর্ম হিসেবে সাব্যস্ত করবে।
যারা এই ডামাডোলে ভিকটিম হয়েছেন এবং সম্ভাব্য তালিকায় আছেন তাদের কাছে এই ধরনের পরিস্থিতি চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। যদি আমরা বিশ্বাস করি যে অপমান করে বের করে দেয়া শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাঁরা স্বৈরশাসক হাসিনার পতন চেয়েছেন তাহলে কী হবে বিষয়টা? যে রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমরা গত প্রায় ১২-১৫ অবধি ছিলাম, সেখানে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকেই কোনো না কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে যেতে হয়েছে। অনেকের ক্ষেত্রে সেই অপ্রিয় বাস্তবতা নিত্যসঙ্গী হয়েছে। তাই, বৈষয়িকজীবন ও জীবিকায়নের ন্যুনতম নিশ্চয়তা পেয়ে সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে বিভিন্ন মাত্রায় আপস করতে হয়েছে। আর সেই আপস, অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে।
একই সঙ্গে বলতে হয় মানুষকে রাজনৈতিক ক্ষমতাসীনদের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে। জেল-জুলুম-গুম-খুনের যে ভয়াবহ বিস্তার লাভ করেছিল তার ভয়াল থাবায় কতো মানুষের জীবন যে পথ হারিয়েছে, কতো মানুষ যে অন্যায় মামলার জালে জড়িয়ে জেলে থেকেছে তার ইয়ত্তা নেই। অনেক মানুষ জীবনহানির আশংকায় দেশান্তরিও হয়েছেন। এমন ঘটনাও ঘটেছে। তাহলে, আপনি একজন শিক্ষককে কী শুধু বাহ্যিক দিকটা দেখেই মূল্যায়ন করবেন? নাকি ভেতর-বাহির একটু খতিয়ে দেখবেন? একটা সময় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে যারা দুঃখ-দূর্দশায় পড়েছেন তারা হয়তো আইনি লড়াই করে নিজস্ব পদ-পদবি ফিরে পাবেন কিন্তু ততক্ষণে সংশ্লিষ্টদের জীবন কী আর ফিরে পাবে তাদের সময়! সেই জায়গা থেকে যদি উদ্ভূত পরিস্থিতিকে বুঝতে চাই তাহলে কী আমরা বলবো যা চলছে তা ঠিক? আমাদের অবশ্যই এর স্বরূপ সন্ধান করে মুক্তির উপায় খোঁজা উচিত।
কিন্তু এসব ঘটনা কেন ঘটছে, এগুলো কী স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটছে, নাকি আয়োজিত? এসব ঘটনা কী পরিহার করা যেত না? এরপরও বলতে হয় এসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার স্থায়ী সমাধানই বা কী- এসব নানা প্রশ্ন এখন জনমনে চলছে। যে সব ঘটনা গণমাধ্যমে ও সোস্যাল মিডিয়ায় এসেছে তার কিছু কিছু বিষয়ে কর্তৃপক্ষ সমাধানের উদ্যোগ নিচ্ছে, কিন্তু অধিকাংশ ঘটনাই এ মুহূর্তে অমীমাংসিত থেকে যাচ্ছে।
সন্দেহ নেই এর নেতিবাচক প্রভাব নিশ্চিতভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ করছে শিক্ষা কার্যক্রম ও শিক্ষার্থীদের ভবিষৎ। যেমনটা আগেই বলেছি-আলোচ্য বিষয়ে উদ্ভূত যে সমস্যা তা যেমন বহুমুখী তেমনি এর কারণও বিবিধ। অর্থাৎ এর প্রকৃত কারন, কেন এমন হচ্ছে, এরজন্য দায়ী কে বা কারা কিংবা এসব সংকট সমাধানেইবা কোন উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল কিনা, সেসব এখন আলোচনার দাবি রাখে। তা না হলে আমাদের সেই একই দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খেতে হবে।
আলোচনায় প্রাসঙ্গিক মনে করে দুটো বিষয় খানিকটা পরিস্কার করে নিলে সুবিধা হবে। তা হল-শিক্ষক কে? শিক্ষকতা কী? এ শব্দবন্ধ দুটি যদি বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে সাধারণভাবে পাওয়া যাবে, শিক্ষক হলেন তিনি- যিনি একজন শিক্ষার্থীর মনে জ্ঞানের ক্ষুধা তৈরি করেন করতে পারেন। অর্থাৎ শিক্ষক শিার্থীদের কতিপয় বিষয়ে শুধু পড়াবেন না, মুখস্ত করাবেন -তিনি এসব সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সবিস্তারে জানার তাগিদ সৃষ্টি করবেন।
জ্ঞান শিক্ষার সাথে জীবনযোগ কীভাবে করবেন সেই প্রজ্ঞা তৈরি করার আলোকিত ব্যক্তিটিই শিক্ষক। এ অর্থে শিক্ষকের দায়িত্ব হল-জ্ঞান আরোহণের সম্ভাব্য সকল উপায় উন্মোচন করা ও শিক্ষার্থীর জীবন চলার পথে জ্ঞান আরোহন ও বাস্তবায়নের পথ বাতলে দেয়া। যাতে শিক্ষার্থীরা দেখতে পায় একটি অবারিত আলোরপথ, জীবনের বিশাল-বিপুল ব্যপ্তি। পক্ষান্তরে, শিক্ষকতা হল পেশা। শিক্ষকতায় ব্যক্তিশিক্ষকের বাইরে তাঁর আরও অনেক বৈশিষ্ট্য দরকার যা হবে নৈতিকমানে উচ্চ। এ পেশায় ব্যবস্থাপনা আছে, মানুষকে সম্পদজ্ঞান করে তাকে গড়ে তোলার নানা ব্যবহারিক জ্ঞান । বহুপক্ষীয় অংশীজনের সম্পৃক্তায় সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ব্যপৃত থাকাই হল শিক্ষকতা।
শিক্ষকতা একটি আদর্শিক পেশা যা বিশেষ কিছু মূল্যবোধের দ্বারা পরিচালিত হয়। শিক্ষানুরাগ, জ্ঞান, দক্ষতা, নিরপেক্ষতা ও দায়বদ্ধতা এমন অনেক নৈতিক মূল্যবোধের অধিকারী হিসেবে একজন শিক্ষক শেষ বিচারে তার শিক্ষার্থীর রোল মডেল। শিক্ষক সে কারনেই অনুকরণীয়,অনুস্মরণীয়। এমন মূল্যবোধ সমৃদ্ধ শিক্ষকের দেখা আমরা আমাদের সময় হামেশাই পেতাম। আমরা, আমাদের থেকে জেষ্ঠ্য যারা তাদের অনেকের মুখে উচ্চ নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষকের কথা শুনেছি, শ্রদ্ধাজাগানিয়া অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়েছি।গল্প, কবিতা, নাটক ও চলচ্চিত্রে তেমন মাপের শিক্ষকের দেখা পাওয়া যেত। শুধু তাই নয়, শিক্ষকের মর্যাদা পরিবারে যেমন ছিল, তেমনি সমাজে ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজেও শিক্ষকদের অংশগ্রহণ সমানভাবে নিশ্চিত করা হত। শিক্ষকগণ সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় পুরাকালে ছিলেন অন্যতম অংশীজন।
এখন সব বদলে গেছে। শিক্ষক আর শিক্ষকতায় নেই, যেসব মূল্যবোধ একজন ধারন করলে শিক্ষক হতে পারেন তেমন মানুষ যে খুব বেশী আছে তা বলা যাবে না। শিক্ষক এখন যে কারো রাাজনীতির লাঠি ধরে নিজস্ব পদ-পদবি রক্ষা করতেই ব্যাকুল। দুঃখজনক হলেও সত্য যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের বর্তমান অবস্থার দিক থেকে বিবেচনা করলে কষ্ট হয়। সনদ বাগিয়ে ক্ষমতাসীন দলের আশির্বাদ কিনে শিক্ষকের চাকুরি নিয়েছেন এমন শিক্ষকের কথা আমরা জানি। যে বিষয়ে শিক্ষকের নিয়োগ সে বিষয়ে তার সর্বোচ্চ শিক্ষাগত অবস্থান কি, কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ থেকে তার লেখাপড়া এবং বিষয়ের ওপর তার দখল আছে কি না ইত্যাদি এখন শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আর বিবেচনায় নেয়া হয় বলে আমাদের জানা নেই। গত প্রায় দুই-আড়াই দশক ধরে দেশে বিশেষ করে যারা মফস্বল শহরে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বা নিয়েছেন তাদের অধিকাংশকেই একটি দীর্ঘ অবৈধ- অন্যায্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
শিক্ষক হওয়ার জন্য প্রাথমিক এবং প্রধান বিষয় যেটি অর্থাৎ শিক্ষাগত যোগ্যতা, মানুষ হিসেবে তার দৃষ্টিভঙ্গি, এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা কেমন এই বিষয়গুলিও তো শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে খুব একটা দেখা হয় বলে আমাদের জানা নেই। সরকারি শিক্ষক নিয়োগে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে তাদের নিয়োগ দেয় বলে সেখানে অতটা দূর্গতি হয়নি। কিন্তু বেসরকারি পর্যায়ে নিয়োগে যা হয়েছে তা যে কোনো বিবেকবান মানুষকে আশংকিত করবে। ওদিকে - সরকারি নিয়োগে শিক্ষকদের মান ও পেশাগত দক্ষতা নিয়েও খুব একটা আশাবাদি হওয়ারও কারন নেই। সেখানেও প্রশ্নফাঁস, দলীয়করণ ও ঘুষের যে মচ্ছব চলেছে সেটা নজিরবিহীন, অকল্পনীয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় বিভিন্ন পদ-পদবি পাওয়া নিয়ে যা হয়েছে সেটা আর যাই হোক যোগ্যতার ভিত্তিতে হয় নাই। এটা করা হয়েছে শিক্ষকদের রঙ (নীল, সাদা,....) দেখে। কার রঙ কি, কে কোন রঙে রঙিন সেটাই মূল বিবেচ্য হিসেবে কাজ করে। সেকারনে শিক্ষকরা তাদের প্রধান দায়িত্ব পাশে সরিয়ে রেখে রাজনৈতিতেই বেশী সক্রিয় হয়। একজন শিক্ষক একজন রাজনৈতিক ব্যক্তির পদাঙ্ক অনুসরণকারী হবে এটা ভাবাই যায় না।
শিক্ষক অথবা শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালন এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দুটোর মধ্যে সুষ্পষ্ট পার্থক্য ও স্বাতন্ত্রতা রয়েছে। দুটো দুই বিষয়। এই অতি প্রয়োজনীয় দুটি বিষয়ের দায়িত্ব ও সীমারেখা শিক্ষক যখোন ভুলে যান তখন ঐ জরুরি বিভাজনরেখাটি মিলিয়ে যায়। যা কোনোভাবেই সুফল আনতে পারে না। আর এ প্রবণতা শুধু যে শিক্ষকদের মধ্যে দেখা যেত তা-তো নয়। এই দুষ্টচক্রে আটকা পড়েছিল প্রায় সকল পেশাজীবী, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিককর্মী সবাই।
এ অপ-আয়োজন থেকে আমলাতন্ত্রের একটি কোনাও বাদ যায়নি। সবাই অবৈধ ক্ষক্ষমতায় মদমত্ত হয়ে কেবল ভয়াবহ ত্রাসের ছড়িই ঘুড়িয়েছে। মানুষকে বুঝতে চায়নি, শিক্ষার্থীর মনস্তত্ত্ব পাঠ করতে ব্যর্থ হয়েছে সবাই। মহামতি কার্ল মার্ক্সের মতে পুঁজিবাদী সমাজে ক্ষমতাকাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে মূলত পুঁজি, অর্থাৎ টাকা। অর্থ থাকলে ব্যক্তিমানুষ বা সমষ্টি যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারে। আর এমন অবস্থা যখন দীর্ঘদিন চলতে থাকে তখন একে একে ভেঙে পড়তে থাকে সমাজ টিকে থাকার মেরুদন্ডসম মূল্যবোধগুলো।
অর্থ-বিত্তের মালিক হতে তখন ব্যক্তিমানুষ শর্টকার্ট আর অবৈধ পথ বেছে নিতে দ্বিধা করে না। আর সেখান থেকে শিক্ষকরাও মুক্ত থাকতে পারেননি! তারা প্রায় প্রত্যেকে শিক্ষকতার মহত্তম আদর্শের প্রদীপটিকে গলাটিপে নিভিয়ে দেয়। আপস করে পুঁজিপতি-বেনিয়া-মুৎসুদ্দির সাথে। শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব কী শুধু পাঠদান? তারা কী শুধু কতিপয় পাঠ্যবই শিখিয়ে শিক্ষার্থীদের পাস করাতে ব্যপৃত থাকবে?আমি তা মনে করি না। আমি মনে করি, শিক্ষক হবে শিার্থীদের রোলমডেল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হবে ঐ এলাকার বাতিঘর। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি স্কুল বা কলেজ তার ম্যন্ডেটের মধ্যে থেকেই আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তারা ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি নিয়মিত আয়োজনের মাধ্যমে শিক্ষার্থী তথা তরুণ প্রজন্মের মননে সমাজ ও রাজনীতি সচেতনতার বীজ বপন করতে পারে।
তার মানে হল-একজন শিক্ষক এমন হবেন যাকে সকল শিক্ষার্থী ভক্তি সম্মান করবেন। আর চলতি বাস্তবতায় সেটিতে যখন বত্যয় দেখা যাচ্ছে তাহলে আপনাকে ধরে নিতে হবে-‘ডাল মে কুচ কালা হ্যয়’। এখনকার সময়ে শিক্ষার্থীরা দেখছে তার শিক্ষক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে থাকছেন। বাড়তি আয়ের আশায় শিক্ষার্থীদের সাথে ছল করছে- অর্থাৎ একজন শিক্ষকের থেকে শিক্ষার্থী যা প্রত্যাশা করে তা পাচ্ছে না। তখন শিক্ষার্থীরা কী করবে? তারা কীসের মাথা খেয়ে ঐ শিক্ষক বা শিক্ষকদেরকে সম্মান দেখাবে?
তার মানে এই নয় যে আজকের যে বাস্তবতা এটা সঠিক। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীর দ্বারা লাঞ্ছিত-অপমানিত হলে দেশের সার্বিক অবস্থাটা চোখের ভিতরে গেথে যায়। শিক্ষকের অপমান কোনমতেই গ্রহনযোগ্য নয়। এই সামাজিক সংকট নিরসনে আমাদেরও দায় রয়েছে। আমাদের সবার পক্ষ থেকেই শিক্ষাকে এক ও অন্যতম অগ্রাধিকার করার দাবি তুলতে হবে। এটা শুধু রাষ্ট্র করবে বা সংবাদপত্রে খবর বের হবে এমনটা মনে করলে হবে না। মানসম্মত শিক্ষা ও সেই শিক্ষার বাহক হিসেবে শিক্ষকদের নৈতিকমান নিশ্চিতে ছাত্র-শিক্ষক ও দেশপ্রেমিক মানুষ সবাইকে একসাথে কাজ করার কোনও বিকল্প নেই।