Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

সংবিধান সংস্কারের জন্য বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি করুন

Icon

কাজী জহিরুল ইসলাম

প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৭:৩৫

সংবিধান সংস্কারের জন্য বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি করুন

কাজী জহিরুল ইসলাম

এ দেশের মানুষকে রাষ্ট্র সংস্কারের মধ্য দিয়ে একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়েছে ছাত্র-জনতা। এই স্বপ্নই সারা দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। শিশু-কিশোররা বন্দুকের নলের সামনে বুক পেতে দিয়েছে একটি স্বস্তির বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য। আমাদের কিছুতেই ব্যর্থ হওয়া চলবে না। 

এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য দরকার একটি দক্ষ, সুশিক্ষিত, নির্লোভ ও সাহসী ড্রাইভিং ফোর্স। ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়েছে সেই সরকারের এই সামর্থ্য আছে। আমরা যারা স্বপ্ন দেখি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণের, সেই স্বপ্নযাত্রার রাস্তাটি কেমন হবে, অর্থাৎ আমার কল্পনার রোডম্যাপের নকশাটি কেমন হবে তা আমাকে প্রতিনিয়ত জাতির সামনে, সরকারের যারা ড্রাইভিং ফোর্স তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। কাজটি আমাদের সকলকে একসঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে করতে হবে। ভিন্ন ভিন্ন অসংখ্য রোডম্যাপ তৈরি হোক না, সেখান থেকে আমরা সবচেয়ে উপযুক্ত রাস্তাটি খুঁজে বের করব এবং সে পথেই হাঁটব।

একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, গণভবন কিংবা বঙ্গভবনে সরকার থাকে না। সরকার থাকে গণমানুষের ভিড়ের মধ্যে। আনুষ্ঠানিক কাজটি ২১ জন উপদেষ্টা করছেন কিন্তু সরকার আমরা সবাই। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করা, যেমন-হাসনাত, সারজিস, তাদের কোনো সরকারি পোর্টফোলিও নেই, কিন্তু তারা কি সরকারের অংশ নয়? বরং তারাসহ, আমরা সবাই, যারা বৈষম্যহীন বাংলাদেশ চাই, সকলেই এই সরকারের অংশ। আসুন আমরা ঠিক এভাবে সরকারকে, বাংলাদেশকে ধারণ করি।

রাষ্ট্র সংস্কার বিষয়টা একটু পরিষ্কার করা দরকার। এ নিয়ে অনেকের মধ্যে ধোঁয়াশা আছে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, আমরা বিচার বিভাগের সংস্কার করব। প্রধান বিচারপতিসহ সকল বিচারককে অপসারণ করে বর্তমান সরকারের অনুগত, বিপ্লবের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন এমন সব বিচারপতি/বিচারক নিয়োগ দিলাম। তাহলে কি বিচার বিভাগের সংস্কার হয়ে গেল? একদম না। এটা যদি করি তাহলে খুব সহজেই এই হাইপোথিসিস তৈরি করা যায়, ৬ মাস পর বিচার বিভাগ অতীতের মতো বর্তমান সরকারের আজ্ঞাবহ একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে এবং ৬ মাস না হলেও ৯ মাস পর এই হাইপোথিসিসের সত্যতা পরিলক্ষিত হবে। অর্থাৎ নতুন বোতলে সেই একই পুরনো মদ। এটাকে সংস্কার বলে না। 

সংস্কার বা রিফর্ম আমরা কেন করব? এই প্রশ্নের উত্তর বের করতে হবে সর্বাগ্রে। বিচার বিভাগ কি গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না? উত্তর হচ্ছে, না। এ বিভাগটি গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। মানুষ এই বিভাগের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পাচ্ছে না। এখন দ্বিতীয় প্রশ্ন, কেন মানুষ ন্যায়বিচার পাচ্ছে না? উত্তর হচ্ছে, বিভাগটি সরকারের পছন্দমতো রায় প্রদান করছে। এবার আমরা মূল কারণটি জানতে পেরেছি। সেটি হচ্ছে বিচার বিভাগের ওপর সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। এখন সংস্কারের কাজটি সহজ হয়ে গেল। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে এমনভাবে আলাদা করতে হবে যাতে নির্বাহী বিভাগ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিচারকার্যকে প্রভাবিত করতে না পারে। একটি পূর্ণ স্বাধীন বিচার বিভাগ তৈরি করতে হবে। কীভাবে তা করা যেতে পারে এ বিষয়ে একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি করুন, তাদের পরামর্শ অনুযায়ী বিচার বিভাগকে ঢেলে সাজান। এভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি অংশকে সংস্কার করতে হবে।

আমরা বহুকাল থেকে রাষ্ট্রের একজন ন্যায়পাল, ইংরেজিতে যাকে অম্বুসপার্সন বলে, নিয়োগের কথা শুনে আসছি। সব সরকার ক্ষমতা গ্রহণের আগে কিংবা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে ন্যায়পাল নিয়োগের কথা বলেন কিন্তু কেউ কখনো তা করে দেখাননি। ড. ইউনূসও তার ভাষণে ন্যায়পাল নিয়োগের কথা বলেছেন। আমি, আমরা আশান্বিত হয়েছি, এবার তাহলে ন্যায়পাল নিয়োগ হবে। কারণ ড. ইউনূস রাজনৈতিক সরকারগুলোর মতো মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেবেন না। ন্যায়পাল হবেন রাষ্ট্রের একজন ন্যায়সঙ্গত মধ্যস্থতাকারী, তিনি উচ্চ পদমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি হবেন। তিনি নির্বাহী বিভাগকে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের জন্য নির্দেশ/পরামর্শ দিতে পারবেন। রাষ্ট্র কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি অন্যায় আচরণ করলে সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ন্যায়পালের কাছে ন্যায্য বিচার প্রত্যাশা করতে পারবেন। বাংলাদেশের নিযুক্ত ন্যায়পালের পদমর্যাদা কী হবে, তার হাতে কতটুকু ক্ষমতা থাকবে এসব বিষয় বিশেষজ্ঞরা ঠিক করবেন। তবে আমি মনে করি ন্যায়পালের ওপরে কেবল রাষ্ট্রপতি থাকবেন, তিনি রাষ্ট্রপতি ছাড়া আর কারও কাছে জবাবদিহি করবেন না। অবশ্যই তার অবস্থান নির্বাহী বিভাগের বাইরে এবং ওপরে থাকতে হবে। 

রাষ্ট্র সংস্কার মাথা থেকেই শুরু করতে হবে। সর্বপ্রথম সংবিধান সংস্কারের কাজে হাত দিতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের পুরো ভাষণে সংবিধান সংস্কারের কোনো কথা না থাকায় আমি খুব হতাশ হয়েছি। এই সংবিধানের আলোকে কোনো সংস্কারই টেকসই হবে না। সংবিধান অক্ষত রেখে আপনারা শুধু বিভিন্ন পদের মানুষ বদলাতে পারবেন, প্রকৃত সংস্কারের কাজ কিছুই হবে না। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে সরকার ক্ষমতায় আসবে তারা আবারও একটি নতুন ফ্যাসিস্ট দানব হয়ে উঠবে।

আর্টিকেল ৭০-এর ফ্লোর ক্রসিং ধারা বহাল রেখে মানসম্মত গণতন্ত্রের চর্চা অসম্ভব। দুই মেয়াদের বেশি কেউ সরকারপ্রধান হতে পারবে না। ব্রেক দিয়েও না। এই ধারা সংযুক্ত না করলে দেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে না, পারিবারিক রাজনীতির অবসান ঘটবে না। শুধু রাষ্ট্রক্ষমতায়ই নয়, প্রতিটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকেও এই নীতি অনুসরণ করতে হবে, অর্থাৎ দুই মেয়াদের বেশি কেউ দলের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক থাকতে পারবেন না। এটি করা হলে দলে গতিশীলতা আসবে, নতুন নেতৃত্ব আসবে। মেধাবীরা রাজনীতিতে যুক্ত হবে। সরকারের মেয়াদকাল ৫ বছর থেকে কমিয়ে ৪ বছরে আনার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। সরকারপ্রধান হিসেবে শপথ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক দলের প্রধানের পদ থেকে তার ইস্তফা হয়ে যাবে। তবে তিনি তার দলের প্রাথমিক সদস্য থাকতে পারবেন। এই ব্যবস্থা না রাখলে রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধানরা অতীতের মতো দলীয় প্রধানের মতোই আচরণ করবে। আমরা খুব কম সময়ই প্রধানমন্ত্রীদের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে দেখেছি। তারা দলের প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছেন এবং দলীয় কর্মকাণ্ডে ব্যতিব্যস্ত থেকেছেন। 

এগুলো খুব মৌলিক এবং অবশ্য করণীয় পরিবর্তনের কথা বললাম। আরও অনেক নৈতিক, মানবিক, সাম্য ও ঐক্য সংশ্লিষ্ট, প্রযুক্তি সম্পৃক্ততা, পরিবেশ বিষয়ক এবং দার্শনিক পরিবর্তন দরকার হতে পারে। অতি দ্রুত সংবিধান সংস্কারের জন্য বা নতুন সংবিধান রচনার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি করুন। আপনারা যদি সংবিধান সংস্কার করে দিয়ে যেতে না পারেন, আপনাদের সকল কর্মকাণ্ড অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যর্থ হয়ে যাবে এবং জুলাই বিপ্লবের উদ্দেশ্য পুরোপুরি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। 


Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫