বাংলাদেশ-ভারতের দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক

মো. মোজাহিদুল ইসলাম নয়ন
প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৬:৫৪

মো. মোজাহিদুল ইসলাম নয়ন। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল
গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে পালানোর পর বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ককে বহুমুখী অভিধায় দেখতে পাচ্ছি।
বলা ভালো, এই প্রথম দেশের এক বিরাট সংখ্যক মানুষ বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়েছেন। কিন্তু দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ন্যুনতম যে প্রিন্সিপালস মানা হয় এক্ষেত্রে এর একটিও ঘটেনি। সেই ফারাক্কা বাঁধ দেয়া থেকে শুরু করে ট্রানটিজ-ট্রান্সশিপমেন্ট ও করিডোর দেয়ার নামে ধোঁকাবাজি, অভিন্ন নদী সমূহের পানি একতরফা সিদ্ধান্তে বন্ধ অথবা ছেড়ে দেয়া, ভারসাম্যহীন বাণিজ্যসম্পর্ক, পর্যটন, চিকিৎসা ব্যবসায় আলোচ্য দেশটি বাংলাদেশের সাথে সেই মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে আজ অবধি প্রভুসম আচরণ করে চলেছে। আর সেই শক্তি’র প্রদর্শন তারা কারণে-অকারণে, যখন-তখন করে দেখায়, যেমন-সীমান্তহত্যা, চোরাচালানি ও কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সি। এতো বিশাল স্বার্থ সংশ্লিষ্ট একটি বিষয় এত বছরে কেনো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার হয়নি সেটাই বরং অনেক আশ্চর্যের।
কিন্তু রাজনৈতিক এই পালাবদলে আলোচনার একেবারে সামনের কাতারে আলোচ্য বিষয়টিকে নিয়ে এসেছে। মানুষ এখন দিন-রাত এ আলোচনা নিয়েই কমবেশি ব্যস্ত। আমরা যখন বলি যে ভারত বিরাট প্রতিবেশী দেশ হিসেবে তিনদিকেই ঘিরে রয়েছে। দুইদেশের মধ্যে মোট স্থলসীমান্ত ৪০৯৬ কিলোমিটার অথবা ২৫৪৫ মাইল। ভাবুন, কী বিশালব্যপ্তি নিয়ে দেশটি আমাদের প্রতিবেশী। অন্যদিকে বাংলাদেশ আর মিয়ানমারের মধ্যে বর্ডার মাত্র ২০৭ কিলোমিটার বা ৬৯ মাইল। তাও বেশির ভাগটা জুড়েই রয়েছে নাফনদী।
গত ২০২২ পর্যন্ত দুইদেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ও পণ্যপ্রকরণ দেখলেই এ বিষয়ে একটি চিত্র পাওয়া যাবে যা নিঃসন্দেহে আশাপ্রদ কিছু নয়। যেমন-উপর্যুক্ত সালে বাংলাদেশ ভারতে পণ্যরপ্তানি করেছে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পরিমাণ। অন্যদিকে ভারত রপ্তানি করেছে ১৩ বিলিয়ন ডলারেও বেশি। ২০১৭ সালকে একটা ভিত্তি বছর ধরে দুইদেশের বাণিজ্যঘাটতি আন্দাজ করতে চান তাঁদের জন্য বলি-১৭-২২ বিগত ঐ পাঁচ বছরে ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য পরিমাণ বেড়েছে ৫৯০ মিলিয়ন থেকে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে ভারতের বেড়েছে ৭.২ বিলিয়ন থেকে ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশের সাথে ভারতের দ্বি-পাক্ষিক বহু চুক্তি, সমঝোতা স্মারক রয়েছে। এর মধ্যে গত ৩১ শে জুলাই ২০১৫ সালে ওরকম একটি চুক্তির মাধ্যমে ১৬২টি ছিটমহল দুইদেশের মধ্যে বিনিময় হয়। তাতে প্রায় অর্ধলক্ষাধিক মানুষের ৫০ বছরের নাগরিকত্বহীনতা দূর হয়। সরকারের তথ্যবাতায়নে এরইমধ্যে স্বাক্ষরিত ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের কথা বলা আছে। কিন্তু সেখানে যত বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে বা হবে বলে বলা হচ্ছে তার মধ্যে বাণিজ্য, বাণিজ্যঘাটতি দূর করার মতো প্রত্যক্ষ বা সুষ্পষ্ট তেমন কোনো অঙ্গীকার নেই। পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হওয়ার মাসখানেক আগে তাঁর সর্বশেষ ভারত সফরে যে ১০টি সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি করেছেন সেখানেও নেই বাণিজ্য ও বাণিজ্যঘাটতি কমিয়ে আনার বিষয়ে তেমন কিছু নেই।
আলোচ্য দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে আলাপ করতে গেলে আরও দু’একটি বিষয়ে আমাদের ধারণাগত ঐক্য দরকার। আর এর একটি হল-চলতি দ্বি-পাক্ষিক সংক্রান্ত যে আলোচনা-বিতর্ক চলছে সেখানে আমরা কাকে 'কর্তা' মনে করব সেটা। কথা না বাড়িয়ে বলি-এখানে 'কর্তা' হল রাষ্ট্র স্বয়ং। অর্থাৎ এখানে সম্পর্ক, আলোচনা বা সার্বিক কূটনৈতিক বিষয় যাকিছু আছে তার সবই নির্ধারিত হতে হবে সমতা ও সম-মর্যাদার ভিত্তিতে। এখানে কথা হবে সমানে সমান। আধুনিক বিশ্বে রাষ্ট্রসমূহের দ্বি-পাক্ষিক অথবা বহু-পাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমতা-র নীতিকে সর্বাগ্রে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলা আছে।
বিষয়টি আরও পরিষ্কার করা যায় এভাবে। অর্থাৎ, রাষ্ট্রের প্রমিতসংজ্ঞা ও রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যগুলো খেয়াল করলেও বিষয়টি আরও খানিকটা সুষ্পষ্ট হবে। আর উপর্যুক্ত সম্পর্কে রাষ্ট্র যখন অধিকর্তা তখন রাষ্ট্রের 'সার্বভৌমত্ব' উপাদানটিই অন্যতম নিয়ামক। কেননা, এই উপাদানটি-ই রাষ্ট্র হিসেবে কোনও বিশেষ এনটিটি বা আধেয়-কে রাষ্ট্রিক বৈধতা দেয়। কোনো একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীকে একটি সাধারণ ভৌগোলিক সীমায় অবস্থানগত কারণে যদি তাকে রাষ্ট্র হতে চায় তাহলে তার 'সার্বভৌমত্ব-র’ স্বীকৃতি থাকতে হবে। সার্বভৌমত্বের অন্যতম বস্তুগত নির্দশন হল- নিজস্ব পতাকা, জাতীয়সংগীত, নির্দিষ্ট সীমারেখা এবং ওই বিষয়ে সারাবিশ্বের অধিকাংশ দেশের স্বীকৃতি। সে কারণে সার্বভৌমত্বের অধিকারী কোনও রাষ্ট্র অন্য যে কোনও রাষ্ট্র থেকে কোনোভাবেই ছোট বা বড় নয়। সামরিক শক্তি, ভৌগোলিক ব্যাপ্তি অথবা আর্থিক অবস্থানের কারণে কোনো রাষ্ট্রের আক্ষরিক পার্থক্য থাকতে পারে কিন্তু শুধু সে কারণে তারা কোনোভাবেই অন্য কোনো রাষ্ট্রের থেকে বেশি সবল বা দুর্বল নয়।
বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে চলতি দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কের মূল উপাদানগুলো হলো-সীমান্ত নিরাপত্তা, বাণিজ্য, পানি, সীমান্ত চোরাচালান ইত্যাদি। এছাড়া, আরও কিছু উপাদান আছে যেমন-পর্যটন, চিকিৎসাসেবা, সাম্প্রদায়িকতার ঝুঁকি ও দায় প্রভৃতি। কিন্তু অন্যান্য উপাদানগুলো সম্পর্কের প্রধান প্রধান উপাদান আলোচনা করতে গেলে চলে আসবে।
আগেই উল্লেখ করেছি বাংলাদেশের মোট সীমান্তের অল্পকিছু এলাকা ছাড়া প্রায় পুরোটা জুড়েই রয়েছে ভারত। ফলে, অধিক জনসংখ্যা অধ্যষিত দুটি দেশের মানুষের নানা জীবিকায়ন প্রয়োজন, স্বজনসম্পর্ক, সংস্কৃতিক নৈকট্য ও নির্ভরতা এতো প্রবল যে দুইদেশের বিশেষ করে সীমান্তে বসবাসকারী মানুষের উভয়ের প্রয়োজনের যাতায়াত রয়েছে। এই যে স্বাভাবিক আসা-যাওয়া সেটাকে কিন্তু কোনোভাবেই চোরাচালান বলা যাবে না। কিন্তু সব প্রয়োজন ছাড়া যখন বাণিজ্যনীতি না মেনে, সরকারকে করফাঁকি দিয়ে, রাতের আঁধারে, আর্থিক সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে সীমান্ত সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনকে ব্যবহার করে যে পণ্য ও সেবার কারবার চলে সেটা অবশ্যই চোরাচালান।
কিন্তু এত বছরে দুইদেশের সরকার এ নিয়ে নানা সময় নানান কিছু করলেও কার্যকর কোনও ফলাফল আনতে পারেনি। সীমান্তে চোরাচালান চলছেই। কিন্তু ঐ যে ভাতৃসম সম্পর্ক, জীবনের দৈনন্দিন প্রয়োজনে, কৃষি, গবাদিপশু পালন ইত্যাদি নানাকারনে চলমান আসা-যাওয়া, লেনাদেনার সম্পর্ক কিন্তু কোনোসময়েই সীমান্ত প্রশাসনের বিধি-নিষেধ নৈতিকশক্তি বলে উপেক্ষা করে এসেছে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনও এসকল বিষয়কে অনেক সময়ই দেখেও না দেখার ভান করে এসেছে। কিন্তু বিশেষ করে ভারত সময়ে অসময়ে নিজের স্বার্থে সীমান্তে প্রায়ই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সীমান্তে হত্যা। এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু, সীমান্তে বসবাসকারী দরিদ্র-খেটেখাওয়া মানুষের প্রাণহানি সেই শুরু থেকে আজকের দিন পর্যন্ত থেমে থেমে চলছেই। এরই সর্বসাম্প্রতিক ভিকটিমের নাম কুলাউড়া-র স্বর্ণাদাস! সীমান্তহত্যা বন্ধে দু’পক্ষের তৎপরতা প্রায়শই দেখা যেতো। কিন্তু সেগুলো সবগুলোই শেষবিচারে হয়ে পড়ে রুটিন কার্যক্রম। সীমান্তে বাংলাদেশের নিরীহমানুষ মরতেই থাকে।
পানি, অন্যতম একটি দ্বি-পাক্ষিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়। এটি এমন একটি বিষয় যা দুইদেশের মানুষের ‘লাইফলাইন’ বা ‘প্রাণভোমরা’ হিসেবে কাজ করে। ভারতের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশ বয়ে ৫৪টি নদ-নদী বঙ্গোপসাগরে মেলে। আর এই দীর্ঘনদীপথ, নদীরজল, নদীসমূহের অববাহিকা, চর, দ্বীপ কতোকিছু যে মানুষের জীবনের সাথে, জীবিকায়ন সংগ্রাম-সংস্কৃতির সাথে আষ্টেপিষ্টে মিশে আছে তার ইয়ত্তা নাই। যে সব নদী দুইদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসছে তারমধ্যে ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা, সুমরা, কুশিয়ারা, ফেনি, মাতামুহুরি নদী আমাদের প্রচলিত কৃষি, কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ জীবনযাত্রা, জীবিকায়নকে প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রভাবিত করে। তাই, কোথায় পানি বাড়ছে, কোথায় বাঁধ খুলে পানি ছেড়ে দেয়া হচ্ছে, কোথায় পানি অবৈধভাবে পানি নিয়ন্ত্রণ করে ভিন্নপথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তার এতটুকু উনিশ-বিশ হলেই আমরা আন্দোলিত হই, ক্ষয়ক্ষতিসহ সার্বিক বিপদাপন্নতায় পতিত হই। অথচ আন্তর্জাতিক সুষ্টষ্প আইনী অঙ্গীকার ও বিচারব্যবস্থা থাকার পরও কেন আমরা ভটিরদেশ হয়েও একতরফাভাবে বঞ্চিত হব? কেন আমাদের ওপর এই অন্যায় অচ্যাচার করা হবে? তাই, শত শত কিলোমিটার পথে প্রবাহিত অর্ধশতাধিক নদীর অববাহিকায় যারা বসবাস করেন তাদের কাছে দেশটির ভারতে সাথে সম্পর্কের সুরাহা ন্যায্য পানিবণ্টন করেই করতে হবে। অন্য কোনও উপায়ে সমাধান আর নেই।
বাণিজ্য, সেটিও আমাদের ওপর অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রতিবেশী দেশদুটি পারস্পরিক বোঝাপোড়া দিয়ে যেখানে উইন-উইন সিচুয়েশনে বাণিজ্য করতে পারে সেখানে পুরো উল্টোচিত্র। সেই শুরুর দিনগুলি থেকে আজ অবধি সেই ভারসাম্যহীন একটি বাণিজ্যসম্পর্কে আমরা আটকা পড়েছি। তারা যদি ১০০টি পণ্য বাংলাদেশে এনে বিক্রি করে সেখানে বাংলাদেশ হয়তো ১০টিও করতে পারে না। তাহলে কীভাবে হবে? এছাড়া, রয়েছে চিকিৎসাবাণিজ্য, পর্যটন, পানি, বালু, সুন্দরবন সবকিছুতেই ভারতের গায়ের জোর খাটানোর বিষয়টি খুবই দৃষ্টিকটুভাবে চোখে পড়ে।
করিডোর, ট্রান্সশিপমেন্ট ও ট্রানজিটের মাধ্যমে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত স্বল্পকর প্রদান, পরিবহনকৃত পণ্য সম্পর্কে বাংলাদেশকে অন্ধকারে রেখে আনা-নেয়া করার মাধ্যমে দেশটি তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি প্রদেশে পৌঁছানো ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা চালিয়ে নিচ্ছে। পূর্বে সেই সাতটি প্রদেশের যে কোনোটি যেতে যে পরিমাণ পথ পাড়ি দিতে হত, যে পরিমাণ সময় লাগতো এবং যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হত এখন তারা তার দশভাগের একভাগ দিয়ে করতে পারছে। আর এতে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উভয় সরকারই লাভবান হচ্ছে। অথচ আমরা মাঝখান দিয়ে লাভের কোনও মুখ দেখছি না। আমরা সবাই কমবেশি জানি যে, পূর্বভারতের আঞ্চলিক বিবাদ, স্বাধিকার ও স্বাধীনতার যে আন্দোলন নাগা, কুকি, চীন ও মেইতেই গোষ্ঠীর মধ্যে চলছে সেসব দমন করার জন্যও বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের নির্বিঘ্ন যাতায়াত করা অতীব প্রয়োজন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার সেই একপেশে চুক্তিকে মেনে নিয়ে ভারতের আশির্বাদ নিয়ে অগণতান্ত্রিক উপায়ে দেশের শাসনক্ষমতা করায়ত্ব করে রেখেছিল।
ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কৌশলগত ভূ-নিরাপত্তা ও পানিবণ্টনে একপেশে আচরণ করলেও হাসিনা সরকার ছিল নিরব। দেশের একটি সর্ববৃহৎ ও স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী একটি রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হয়ে আওয়ামী লীগ কীভাবে শুধু ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে ভারতের কাছে দেশকে গুরুত্বহীন করে দিয়েছে। সাবেক ক্ষমতাসীন দলটি একদফা একদাবি অর্থাৎ অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার গ্যারান্টি পেয়ে দ্বি-পাক্ষিক কোনো ইস্যুতেই ভারতের সাথে দরকষাকষিতে যায়নি। যা বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতির একটি দল হিসেবে তাদের চরম দেউলিয়াত্বেরই প্রমাণ। অন্তঃসারশূন্য ও ভাসা ভাসা রাজনৈতিক দর্শন, চটকদারি উন্নয়ন উদ্যোগ বা লোকদেখানো উন্নয়ন অভিষ্ঠ প্রচার করে হাসিনা সরকার দেশবাসীকে এক অভাবনীয় ইন্দ্রজালের মধ্যে বেঁধে রেখেছিলেন। মানুষ, কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন নির্দশন দেখেই সার্বিক উন্নয়ন দেখেছেন বলে বিভ্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু দিনশেষে কারুরই সত্যিকার চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলেনি।
ভারত এদেশে তাদের দক্ষজনবল, ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা, ব্যবসায় যন্ত্রপাতি-প্রযুক্তি সেল করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিয়েছে। প্রচুর সংখ্যক কর্মী ও ব্যবস্থাপক এদেশে কাজ করার সুবাদে তারা আমাদের ডেভেলপমেন্ট সিক্রেটস্, আর্থ-সামাজিক কলা-কৌশল, ইন্ডিজিনাস নলেজ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ইত্যাদির সব খবরাখবর সংগ্রহের কাজও করেছে। ফলে, এদেশ থেকে শুধু অর্থই তারা হাতিয়ে নেয়নি বরং এদেশের মানুষ, প্রতিবেশ, প্রকৃতি, জল-স্থল সবসম্পর্কেই তথ্য পাচারও করেছে।
কিন্তু এভাবেই কি চলবে? এর বিপরীত বাস্তবতা যা এদেশের অধিকাংশ মানুষের অনুমদিত তা কি করা যাবে না? নিশ্চয়ই যাবে। কিন্তু- এরজন্য প্রয়োজন অন্তত চারটি বিষয়। এক. মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ রাজনৈতিক অঙ্গীকার; দুই. সমতা ও মর্যাদারভিত্তিতে দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক কাঠামো ও সংস্কৃতি; তিন. ভারসাম্যপূর্ণ বাণিজ্য সম্পর্ক ও চার. দক্ষ জনবল।
রাজনৈতিক দৃঢ় অঙ্গীকার ছাড়া কোনো সরকারই জনবান্ধব নীতি-পলিসি নিতে পারে না। ক্ষমতার আসনে বসে, পাখির চোখে সমাজ বাস্তবতা দেখে প্রকৃত অবস্থা আঁচ করা যায় না। উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া কোনও উন্নয়ন মডেলও গ্রহণযোগ্য ও ফলদায়ক হবে না। তাই একটি নিরবিচ্ছিন্ন গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ, উন্নয়ন চাহিদা নিরূপণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন ইত্যাদি পুরো প্রক্রিয়ায় অর্থপূর্ণ জনসম্পৃক্ততা থাকতে হবে। কোটাভিত্তিক জনপ্রতিনিধিত্ব নয় বরং একটি একীভূত উন্নয়ন সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করতে হবে যাতে সমাজের সর্বস্তুরের মানুষ বিশেষ করে সর্বোচ্চ পিছিয়ে রাখা জনগোষ্ঠীকে লিঙ্গ, ধর্ম, সম্প্রদায়, জাতিতাত্ত্বিক পরিচয় ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে বিবেচনা না করেই।
সমতা ও সমমর্যাদাপূর্ণ দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক নিশ্চিতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, কূটনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, আমলাতন্ত্র ও মিডিয়াকে সক্রিয় ভূমিকায় থাকতে হবে। সরকারের কোনও নীতি, উদ্যোগ দেশের স্বার্থকে বিবেচনা করে হচ্ছে কি না, চুক্তির আওতা ও শর্তসমূহ জনগণের সামনে খোলাসা করে তুলে ধরাও এক্ষেত্রে একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। যাতে চুক্তিস্বাক্ষরের পরে দেশজুড়ে একটা সন্দেহ ও পরস্পরবিরোধী কথা না আসে। কূটনৈতিক শিষ্টাচার, আইনী অঙ্গীকার ও দুইদেশের জনস্বার্থের বিপরীতে কোনো দেশ কোনও উদ্যোগ নিলে তা স্বল্পসময়ের আলোচনায় সমাধান করা যাবে এমন ব্যবস্থাপনা তৈরি করা জরুরি।
ভারতের মতো সুবৃহৎ একটি দেশের সাথে বাণিজ্যঘাটতি মিটিয়ে ফেলা খুব সহজ বিষয় নয়। এরজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ‘দুদেশের মধ্যে বাণিজ্য’ বলতে আমরা কী বুঝব সেটা। সেই বিষয়টির সুরাহা করার প্রক্রিয়ায় ‘বাণিজ্যসমতা’ বলতে ফিফ্টি-ফিফ্টি শেয়ার না বুঝে আনুপাতিক ন্যয্যতা’র ওপর জোর দিতে হবে। দেশের আকার, পণ্যবৈচিত্র্যতা, পণ্যপরিসর, আর্থিক লগ্নির পরিমাণ, লাভ-ক্ষতির হিস্যা ইত্যাদি প্রত্যেকটিই আনুপাতিক ন্যয্যতার ভিত্তিতে সেট্ল করার দাবি জোরালো করতে হবে। পণ্যবাণিজ্যের হেজিমনিও আর একটি বিষয়। অর্থাৎ, যে সকল পণ্য পৌণঃপৌনিকভাবে কেবল ভারওই তৈরি করছে, বাজারে নিয়ে আসছে এবং ব্যবসায় করছে। সেই পণ্যে বা সেই ধরনের পণ্যে বাংলাদেশের প্রবেশাধিকার নেই অথবা সীমিত করে রাখাকে আমরা পণ্য ও ব্যবসায় হেজিমনি বুঝব।
পূর্বে যা হবার হয়েছে ধরে নিয়ে এগুলে কিন্তু সমাধান পাবো না আমরা। দুইদেশের মধ্যে সম্পাদিত বাণিজ্য চুক্তি, চুক্তির প্রয়োগ ও লাভ-ক্ষতি-এর নির্মোহ মূল্যায়ন করতে হবে। মূল্যায়ন থেকে প্রাপ্ত সুপারিশের ভিত্তিতেই ভারতের সাথে বাংলাদেশের দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্যসম্পর্ক নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। নতুন করে সম্ভাব্য বাণিজ্যসম্পর্ক হতে হবে এদেশের গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের চাহিদার ভিত্তিতে, ন্যায্যতা আর মর্যাদার ভিত্তিতে।