জাতি ও সভ্যতার বিকাশে গ্রন্থ ও গ্রন্থাগারের অপরিহার্যতা

আলমগীর খান
প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৫:০৮

আলমগীর খান
জাতি ও সভ্যতার বিকাশে গ্রন্থ ও গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমরা খুব কমই ওয়াকিবহাল। অথচ আধুনিক সভ্যতার নির্মাতাই হচ্ছে বই। যদি মানুষ বই আবিষ্কার করতে না পারত তবে মানবসভ্যতা কৃষি যুগের পূর্বেকার শিকার যুগেই আটকে থাকত, আজকের পর্যায়ে আসার কোনো সুযোগই হতো না।
কাগজ আবিষ্কারের পূর্বে অবশ্য বইকে মাথার মধ্যে স্মৃতিতে সংরক্ষণ করে রাখতে হতো। সে সময়ের মহান সৃষ্টির মধ্যে মহাকাব্য, ধর্মীয় গ্রন্থসমূহ উল্লেখযোগ্য। স্মৃতির বাইরে যেটুকু সম্ভব হয়েছিল তা হচ্ছে পাহাড়ের গায়ে, পাথরের ওপর লিখে রাখা। এরপর একসময় কাগজ আবিষ্কার করতে পারে মানুষ। সেই কাগজে হাতে লিখে জ্ঞান সংরক্ষণ করতে হতো। শুরুতে ছিল এক লম্বা টানা ফালি যা মোড়ানো থাকত ও খুলে পড়তে হতো। কেবল একটি বই পড়ার জন্যই জ্ঞানপিপাসুকে দেশান্তর হতে, সমুদ্র পাড়ি দিতে কিংবা হাজার মাইল অতিক্রম করতে হতো।
ছাপাখানা এসবকে খুব সহজ করে দিল। তবে পৃথিবীতে এই অমূল্য জ্ঞানকে সংরক্ষণের জন্য লাইব্রেরি গড়ে উঠেছে বই ছাপানোর আগে থেকেই। যে দেশ জ্ঞানবিজ্ঞানে ও সভ্যতায় যত বেশি এগিয়ে ছিল তাদের ছিল তত বড় লাইব্রেরি। বিদেশি শত্রুরা অনেক লাইব্রেরিকে চিরতরে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য এ ছিল সবচেয়ে মোক্ষম উপায়। এখন লাইব্রেরি গঠন ও ব্যবস্থাপনা সে আমলের চেয়ে অনেক সহজ। কারণ বই ছাপানোর প্রযুক্তি, যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি ইত্যাদি। তবু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, গর্ব করার মতো আন্তর্জাতিক মানের একটি জাতীয় গ্রন্থাগার এ দেশে এখনো গড়ে ওঠেনি।
গ্রন্থাগার যে কী এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুপরিচিত কথাগুলো লাইব্রেরি প্রবন্ধ থেকে আরেকবার স্মরণ করা যাক, “মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে। ইহারা সহসা যদি বিদ্রোহী হইয়া উঠে, নিস্তব্ধতা ভাঙিয়া ফেলে, অক্ষরের বেড়া দগ্ধ করিয়া একেবারে বাহির হইয়া আসে! হিমালয়ের মাথার উপরে কঠিন বরফের মধ্যে যেমন কত কত বন্যা বাঁধা আছে, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে মানবহৃদয়ের বন্যা কে বাঁধিয়া রাখিয়াছে!”
গ্রন্থাগার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মূল্যবান ছোট্ট লেখাটির এই অংশটি বহুল উদ্ধৃত। কিন্তু শেষাংশে তার আক্ষেপটির কথা কমই শোনা যায়, যেখানে রয়েছে আমাদের দুরবস্থার কথা। তিনি লিখেছেন: “দেশ-বিদেশ হইতে, অতীত-বর্তমান হইতে প্রতিদিন আমাদের কাছে মানবজাতির পত্র আসিতেছে; আমরা কি তাহার উত্তরে দুটি-চারটি চটি চটি ইংরেজি খবরের কাগজ লিখিব! সকল দেশ অসীম কালের পটে নিজ নিজ নাম খুদিতেছে, বাঙালির নাম কি কেবল দরখাস্তের দ্বিতীয় পাতেই লেখা থাকবে! জড় অদৃষ্টের সহিত মানবাত্মার সংগ্রাম চলিতেছে, সৈনিকদিগকে আহ্বান করিয়া পৃথিবীর দিকে দিকে শৃঙ্গধ্বনি বাজিয়া উঠিয়াছে, আমরা কি কেবল আমাদের উঠানের মাচার উপরকার লাউ কুমড়া লইয়া মকদ্দমা এবং আপীল চালাইতে থাকিব!”
পৃথিবীতে কোনো দেশ ও জাতি সভ্যতা-সংস্কৃতিতে কতটা উন্নত তা বোঝা যেতে পারে সেখানকার গ্রন্থাগার দেখে। খ্রিষ্টের জন্মের ৩০০ বছর আগে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় শুরু হয়েছিল গ্রন্থাগার তৈরির এই রেওয়াজ। বলা হয় মূল ধারণাটি দার্শনিক অ্যারিস্টটলের। তিনি তার ছাত্র বিশ^জয়ী আলেকজান্ডারকে প্রভাবিত করেছেন বিজিত নগরসমূহে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠায়। বলা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩১ সালে মিশর জয় করার পর আলেকজান্দ্রিয়া নগর প্রতিষ্ঠাকালেই গ্রন্থাগারের স্থানটি স্বয়ং আলেকজান্ডার নিজেই নির্বাচন করেন। পরবর্তীকালে তার সেনাপতি টলেমির হাতে গড়ে ওঠে এই বিশ্বখ্যাত গ্রন্থাগারটি। জ্ঞানের প্রতি কী রকম নেশাগ্রস্ত হলে যে এ রকম একটি বিরাট কর্মযজ্ঞ করা যায় তা না জানলে ভাবা দুরূহ।
এ ব্যাপারে ভায়োলেট মোলার লিখেছেন, “সব সফল বই সংগ্রহকারীদের মতো, মিশরের রাজা ও গ্রন্থাগারকর্তারা বিবেকের তোয়াক্কা না করে তাদের স্বপ্নজয়ের পিছনে ছুটেছেন। চুরি, ধার ও ভিক্ষা- যখন যা প্রয়োজন তাই করে তাদের সংগ্রহ সমৃদ্ধ করেছেন। তাদের আদেশ ছিল আলেকজান্দ্রিয়া দিয়ে গমনকারী যে কোনো জাহাজ তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখতে হবে সেখানে কোনো স্ক্রল বা প্যাপিরাসের পাকানো ফালি আছে কিনা, থাকলে তা বাজেয়াপ্ত ও হস্তগত করতে হবে। এগুলো গ্রন্থাগারের ‘জাহাজ থেকে পাওয়া’ নামাঙ্কিত তাকে উঠত। এথেন্সবাসীরা তাদের মূল্যবান লেখাগুলোর অনুলিপি করতে আলেকজান্দ্রিয়ায় পাঠালে তারা মূলটি রেখে অনুলিপিটি ফেরত দিত। প্রয়োজনে বিরাট অঙ্কের নিশ্চয়তা বাবদ অর্থ গচ্চা দিয়েও তারা এ কাজ করত। কেবল গ্রন্থাগারের সমৃদ্ধির জন্য। এই দখলদারিমূলক সংগ্রহনীতি ভালো ফল দিয়েছিল, দুয়েক দশকের মধ্যেই এ গ্রন্থাগারে জমা হলো রান্না থেকে ইহুদি ধর্মতত্ত্ব পর্যন্ত প্রত্যেক বিষয়ে হাজার হাজার রচনা- যে সংগ্রহ পরিমাণে ও বিষয়বৈচিত্র্যে এই গ্রহের যে কোনো স্থানের তুলনায় অদ্বিতীয়। টলেমিয় রাজারা কেবল গ্রন্থই সংগ্রহ করেননি তারা মন-মস্তিষ্কও সংগ্রহ করেছেন। নয়জন গ্রিক দেবী মিউজের সম্মাননায় তৈরি বেদিস্থলে তারা পণ্ডিত সম্প্রদায়কে জড়ো করেছিলেন। এটি মিউজ থেকে মিউজিয়াম নামে পরিচিত হলো ও গ্রন্থাগারের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হলো।”
হাজার বছর ধরে আলোক বিচ্ছুরণের পর সপ্তম শতকে ধ্বংসের মুখে পড়ে আলেকজান্দ্রিয়ার এই অতুলনীয় গ্রন্থাগারটি। তবে পঞ্চম শতকেই এটি খ্রিষ্টান ধর্মান্ধদের আক্রমণের শিকার হয়। ৪১৫ সালে এ রকমই এক ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হন তৎকালে আলেকজান্দ্রিয়ার সবচেয়ে খ্যাতিমান ও মেধাবী নারী-দার্শনিক থিয়োনের কন্যা গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ হাইপেশিয়া। ধর্মান্ধ দুর্বৃত্তরা তাকে ডাইনি আখ্যা দিয়ে ঝিনুকের খোসা দিয়ে চামড়া ছিলে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এত দিনে খ্রিষ্টান ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক বইয়ে ভরে যাওয়া আলেকজান্দ্রিয়ার চূড়ান্ত পতন ঘটে ৬৪১ সালে মুসলিম শাসকদের কাছে। কথিত আছে যে, বিজয়ী খলিফার নির্দেশ ছিল গ্রন্থাগারের সবই জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে কেবল অ্যারিস্টটলের লেখাগুলো ছাড়া। এরপর জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনন্য আলোকবর্তিকা হিসেবে আলেকজান্দ্রিয়ার স্থান দখল করে আব্বাসীয় শাসনাধীন বাগদাদ।
আধুনিক মানুষের ইতিহাস গ্রন্থাগারেরও উত্থান ও পতনের ইতিহাস। বর্তমান বিজ্ঞানের চোখে একটি ক্ষুদ্রতম জীবনও মূলত একটি জ্ঞানকোষ বা গ্রন্থ। যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতিমান জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী কার্ল সাগান লিখেছেন যে, ঘাস থেকে মানুষ পর্যন্ত প্রত্যেকের ডিএনএ ডাবল হেলিক্সে যে তথ্য মুদ্রিত আছে তা চার অক্ষর সংবলিত ভাষায় লেখা। একটি আণুবীক্ষণিক ভাইরাসে যে তথ্য আছে তা আমাদের একটি বইয়ের ১ পৃষ্ঠার সমান। একটি ব্যাকটেরিয়ায় যে তথ্য সংরক্ষিত তাকে ইংরেজি অক্ষরে রূপান্তর করলে হবে ১০০ পৃষ্ঠার একটি বই। একটি অ্যামিবার তথ্যকে মানবভাষায় রূপান্তর করলে তা দিয়ে হবে ৫০০ পৃষ্ঠার মোট ৮০ খণ্ড গ্রন্থ। আর তিমি বা মানুষের প্রতিটি কোষের নিউক্লিয়াসে যে তথ্য সংরক্ষিত তা দিয়ে হবে ১০০০টি গ্রন্থ-মানে আমাদের প্রত্যেকটি কোষ একেকটি গ্রন্থাগার।
মস্তিষ্কের ভাষা আবার জিনের ডিএনএ দিয়ে লেখা নয়। এটি নিউরন কোষ ও তার সংযোগ দিয়ে লেখা। মানবমস্তিষ্কে তথ্যের পরিমাণ ১০০ ট্রিলিয়ন। সাগান লিখেছেন, “আমাদের প্রত্যেকের মাথায় যে তথ্য আছে তা ইংরেজিতে লিখলে হবে ২ কোটি বই, পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রন্থাগারগুলোর সমান। মস্তিষ্ক অল্প জায়গায় এক বিশাল ভাণ্ডার।” কোন পর্যায়ে ও প্রয়োজনে মস্তিষ্ক সৃষ্টি হলো? সাগানের কথায়, “যখন কেবল আমাদের জিন বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্য আর সংরক্ষণ করতে পারছিল না, ধীরে ধীরে উদ্ভব হলো মস্তিষ্কের। কিন্তু এরপর সময় এলো সম্ভবত দশ হাজার বছর আগে, যখন আমাদের প্রয়োজন হলো আরও জানা যা মস্তিষ্কের ধারণক্ষমতায় কুলায় না। সুতরাং তথ্যের বিপুল ভাণ্ডারকে আমরা আমাদের দেহের বাইরে জমা করতে শিখলাম। যতদূর জানি আমরাই এই গ্রহের একমাত্র প্রাণী যারা উদ্ভাবন করতে পেরেছি একটি সামাজিক স্মৃতিভাণ্ডার যা জিনেও নয়, মস্তিষ্কেও নয়, দেহের বাইরে। স্মৃতির এই ভাণ্ডারের নাম গ্রন্থাগার।”
স্পষ্টতই গ্রন্থাগার হচ্ছে মস্তিষ্কের আরও বিকশিত ও সম্প্রসারিত অংশ যা মানবদেহের বাইরে কিন্তু সমাজদেহের অভ্যন্তরে অবস্থিত। গ্রন্থাগার দেখে সমাজের, জাতির ও রাষ্ট্রের মানসিক স্তর, বিকাশের পর্যায় ও অবস্থা বোঝা যায়। গ্রন্থাগার তৈরি তাই কোনো শখ নয়, ভবিষ্যতে স্বাধীন সত্তা নিয়ে বেঁচে থাকার শর্ত ও মন্ত্র। সেজন্য গ্রন্থাগার তৈরি, সংরক্ষণ ও বিকশিত করার জন্য প্রয়োজন সর্বমুখী ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ। যত তাড়াতাড়ি আমরা এ সত্য অনুধাবন করতে পারব ততই মঙ্গল।