Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

দেশ বিনির্মাণে শিক্ষা ক্ষেত্রে সংস্কার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ

Icon

এম আর খায়রুল উমাম

প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৫:৫৩

দেশ বিনির্মাণে শিক্ষা ক্ষেত্রে সংস্কার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ

এম আর খায়রুল উমাম

শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলনের সুফল সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে সবার প্রথমে প্রয়োজন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করে মানসম্মত করা। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটা সরকার শিক্ষা সংস্কারে ব্রতী হয়েছে। কিন্তু শেষ বিচারে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে থেকে গিয়েছে। 

সাধারণ শিক্ষা নিয়ে এত পরীক্ষা হয়েছে যা গিনিপিগকেও হার মানায়। প্রায় সব সরকার শিক্ষানীতি করার জন্য কমিশন করেছে কিন্তু কিছু শিক্ষার্থীদের বাধার মুখে, কিছু সরকারের অনীহার কারণে বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। আমি কিছু করব, আমরা কিছু করব, নেতার নামে কিছু করব করতে গিয়ে দেশের পুরা শিক্ষা ব্যবস্থাটাই তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্তদের কেউ রাতে স্বপ্ন দেখে সকালে ঘুম থেকে উঠে কোনো সময় নষ্ট না করেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। প্রস্তুতিবিহীন চাপানো শিক্ষা ব্যবস্থা প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষাকে মানহীন করে ফেলেছে। দেশের সর্বত্র এর প্রভাব প্রকটভাবে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। 

স্বাধীনতার প্রায় ৪০ বছর পর জাতি একটা শিক্ষানীতি পেয়েছিল। মহান সংসদ প্রফেসর কবীর চৌধুরীর করা সেই শিক্ষানীতি অনুমোদন দিলেও তার অর্থনৈতিক সুপারিশ পাস করেনি। শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে অর্থের প্রত্যক্ষ যোগ আছে তা তৎকালীন সংসদ সদস্যদের বিবেচনায় আসেনি বোধ করি। এমনও হতে পারে জাতিকে শিক্ষানীতি দিলাম এই তো অনেক, এ শিক্ষানীতি যে বাস্তবায়ন করতে হবে এমন বিশ্বাস বা প্রয়োজন কেউ বোধ করেনি। সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, এই অনুমোদিত শিক্ষানীতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা একবারও পড়েনি বা চোখ বোলাননি। ফলে শিক্ষানীতি ফাইলের মধ্যেই পড়ে থাকল এবং দায়িত্বপ্রাপ্তরা স্বপ্নে পাওয়া পথে শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরিচালনা করতে লাগলেন। যদিও অনুমোদিত শিক্ষানীতি দেশ ও জাতির সব চাহিদা পূরণে সক্ষম এমন দাবি করা যাবে না। তবে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করেছিল সময়ের প্রয়োজনে শিক্ষানীতি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা আলোচনা-পর্যালোচনা করবেন এবং দেশ ও জাতির স্বার্থে তা পরিবর্তন- পরিমার্জন করে পূর্ণতার দিকে নিয়ে যাবেন। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের স্বৈরাচারী মনোভাবের কারণে একদিকে পড়ে রইল শিক্ষানীতি আর অন্যদিকে পড়ে রইল শিক্ষা ব্যবস্থা। সর্বোপরি ঘটনার সবটুকুই সাধারণ মানুষের বোধের বাইরে দিয়ে চলে গেল। শিক্ষা সংস্কার দেশের প্রথম প্রয়োজন আর সেজন্য প্রয়োজন শিক্ষানীতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে দ্রুততম সময়ে পদক্ষেপ গ্রহণ। 

দেশের বেহাল শিক্ষা ব্যবস্থার মূল কারণ মানবসম্পদ পরিকল্পনা না থাকা। দেশ ও জাতির জন্য কোন পেশার কত জনবল প্রয়োজন তা না জানার ফলে যখন যার যা মনে এসেছে তখন সে রকম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই দেশে তৈরি করেছে। এতে করে দেশে শিক্ষিত বেকারের পাহাড় জমেছে আর শিক্ষা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়নি। একপাশে সরকারি অর্থের অপচয় হয়েছে বিপরীতে অভিভাবকরাও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দেশের মোট উন্নয়ন ব্যয়ের ৮০-৯০ ভাগ প্রকৌশল ও কারিগরি সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডে খরচ হয়ে থাকে। আবার এই কর্মকাণ্ডের ৮০-৯০ ভাগ অংশ জুড়ে থাকে তত্ত্বাবধায়ন ও মেরামতের কাজ। বাকি ১০-২০ ভাগ কর্মকাণ্ডের মধ্যে থাকে পরিকল্পনা, রূপরেখা প্রণয়ন ইত্যাদি। আমাদের দেশে এই দুই ধরনের কাজের জন্য পৃথক জনবল তৈরির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু মানব সম্পদ পরিকল্পনা না থাকায় কর্মক্ষেত্র বিবেচনায় সরকার আনুপাতিক হারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেনি। তদুপরি দেশের সমাজ ব্যবস্থা যেভাবেই বর্ণনা করা হোক না কেন সত্য এই যে আন্তরিকভাবে সকলেই আমরা অভিজাত সমাজে বসবাস করতে পছন্দ করে থাকি। ফলে কারিগরি কর্মক্ষেত্রগুলোতেও শিক্ষার প্রকার ভেদে আগ্রহ ও আভিজাত্যবোধের ঘাটতি দেখা যায়। সকলেই আশা করে উপরতলার বাসিন্দা হতে। ফলে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, বিদ্বেষ আর জিঘাংসা বাড়তেই থাকে। 

দেশের চিকিৎসক সমাজ নিজেদের আভিজাত্য রক্ষা করার জন্য নিজেদের পদ-পদবি এবং ক্ষমতা ব্যবহার করে এলএমএফ কোর্স বন্ধ করে দিতে সক্ষম হয়েছে। সরকারও এমবিবিএস চিকিৎসকদের মন রাখতে এলএমএফ কোর্স বন্ধ করে গ্রামবাংলার বিশাল জনগোষ্ঠীকে ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবার বাইরে রেখে দিয়েছে। আমাদের দেশের অনেক দায়িত্বপ্রাপ্তরাই পদ-পদবি পেয়ে বিশাল লটবহর নিয়ে বিদেশে ছুটে যায় রুটিন চেক আপ করার জন্য। যারা চিকিৎসা নয়, শুধু রুটিন পরীক্ষার জন্যও বিদেশনির্ভর, দেশি চিকিৎসকদের প্রতি তাদের আস্থার প্যারামিটার বিবেচনা করলেই সাধারণ মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা অনুমান করা যায়। এদের কাছে আশা করাই কঠিন ছিল যে এদের হাত ধরে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত হবে। বর্তমান সংস্কারের ধারাবাহিকতায় তাই স্বাস্থ্য খাত হতে হবে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার খাত। 

দেশের চিকিৎসকরা যা করতে সক্ষম হয়েছে তা ডিগ্রি প্রকৌশলীরা করে উঠতে পারেনি। তবে তারা পলিটেকনিক শিক্ষা কোর্স বন্ধের ব্যবস্থা করতে না পারলেও ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি কখনও। কারিগরি কর্মক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে বিভাজন তা না মেনেই তত্ত্বাবধান ও মেরামতের কাজেও নিজেদের নিয়োজিত করতে চেয়েছে তারা। এজন্য ডিগ্রি প্রকৌশলীরা আইনের আশ্রয় নিতেও পিছপা হয়নি। এই যে ডিগ্রি প্রকৌশলীরা নিম্নপদে আসতে চান তার অনেক কারণ থাকলেও, সেগুলো উল্লেখ না করেও বলা যায়- কারিগরি কর্মকাণ্ডের যে দায়িত্ব পালনের জন্য জনগণের করের টাকায় ডিগ্রি প্রকৌশলীদের তৈরি করা হয়ে থাকে, তার সিংহভাগ কাজই বিদেশিদের দিয়ে করানো হয়ে থাকে। এমনকি যমুনা সেতুর নির্মাণ দেখার পরও আমাদের ডিগ্রি প্রকৌশলীরা পদ্মা সেতু তৈরির পরিকল্পনা, রূপরেখা প্রণয়নে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থতার পরিচয় রেখেছে। নিজেদের দায়িত্ব ও কাজ সঠিকভাবে করতে না পারার অক্ষমতা ঢাকতেই বোধ করি নিম্নপদের দিকেই এদের চাহিদা থাকে বেশি। এহেন অবস্থা উত্তরণে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন শত সহস্র অসঙ্গতিতে ভরা। এগারো রকমের প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কীভাবে সাম্যের সমাজ গঠন করা সম্ভব তা সাধারণ মানুষের বোধের মধ্যে আসে না। শিক্ষানীতি স্নাতক ডিগ্রিকে চাকরি বাজারের জন্য সর্বোচ্চ ডিগ্রি হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে নির্দেশ দেওয়ার পরও স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জয়জয়কার চলমান। প্রশাসন, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদরা প্রতিযোগিতা করে পদ দখলে মরিয়া। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এসবের মধ্য থেকে বের করা না গেলে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে বলে বিশ্বাস করা কষ্ট হয়। একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য এক বিঘা জমি সর্বপ্রথমে বিদ্যালয়ের নামে দলিল করতে হয়, অথচ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একটা ফ্ল্যাটে পরিচালিত হচ্ছে। একের পর এক পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে যন্ত্রপাতিহীন একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে। দক্ষ জনশক্তি কীভাবে হবে ব্যবহারিক কাজ না করে, হাতে কলমে না শিখে। তাই সামগ্রিক সমস্যা চিহ্নিত করে শিক্ষানীতির আলোকে পরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ খুব জরুরি। সবচেয়ে বেশি জরুরি শিক্ষার্থীদের সামাজিক বিজ্ঞান, ইতিহাস ও মানবিক বোধসম্পন্ন শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা। নইলে মানবিক সমাজ বিনির্মাণ হবে কীভাবে? 

বর্তমান সরকার অর্থনীতিকে যে গুরুত্ব দিচ্ছে তার চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থার মেরামত। খ্যাতনামা শিক্ষাবিদদের নিয়ে তাদের পরামর্শে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে উদ্যোগ গ্রহণ করা না গেলে কোনো অর্থনৈতিক কাঠামো আমাদের ভবিষ্যৎকে আলোকিত করতে পারবে না। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫