চাকরির ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম আনা কি জরুরি

শারমিন সুলতানা
প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৭:৪৫

শারমিন সুলতানা। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল
বর্তমানে আলোচনার শীর্ষে থাকা বিষয়টি হলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন— যা দেশের সর্বস্তরের জনগণকে আকৃষ্ট করেছে। সময়ের দাবিতে নানান ঘটনাবহুল এই আন্দোলনে প্রাণ গেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল- কলেজের শিক্ষার্থীর। নিহত হয়েছেন বিভিন্ন পেশাজীবী। দুঃখের বিষয় হচ্ছে অধিকার সম্পর্কে সচেতন এ মানুষগুলো ন্যায়-অন্যায় বুঝলেও এদের অনেকেই রাজনৈতিক কূট- কৌশল বোঝেননি, বোঝেন না।
সাধারণের গণঅধিকার সুনিশ্চিত করতে প্রাণ দিয়েছে ছাত্ররা। আর অনেকে মাথায় কাফন বেঁধে রাস্তায় বের হয়ে আবারো ঘরে ফিরে পড়ার টেবিলে বসেছে। সরকারি স্কুল- কলেজের কথা বাদ দিয়ে যদি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কথাই ধরি তবে ভয় যে এরাই তো কিছুদিন পর চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হতে পারে। কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রামে যারা জীবন দিয়েছে তাদের মধ্যে তো পাবলিক বা প্রাইভেট চেতনা ছিল না। বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে সবাই লড়েছে, প্রাণ দিয়েছে এক সঙ্গেই। এরপরও কি চাকরির ক্ষেত্রে সরকারি বা প্রাইভেট বৈষম্য থাকবে?
ভাইবা বোর্ডের মুখোমুখি যারা হয়েছেন তারাই জানেন যে, কোটার চেয়েও চাকরি প্রার্থী কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছে সেই প্রশ্ন কর্তাবৃন্দের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে 'টুয়েলভ ফেইল' সিনেমা কিন্তু সবার জীবনের সত্য নয়। যখন একজন চাকরি প্রার্থীকে শুরুতেই তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম জিজ্ঞেস করা হয়, তখন কারো মনোবল বেড়ে যায় আবার কারো কমে যায়। চাকরি প্রার্থীর অর্ধেকের মনোবল ভাঙে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম নিয়ে আর বাকি অর্ধেকের মনোবল ভাঙে বিষয়ের নাম নিতে গিয়ে। অথচ সব প্রতিষ্ঠান, সব বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মান পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু আমরা কি সত্যিকার অর্থে সে সম্মান দেই?
এসব প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক এবং এ লেখনি অবান্তর তখনই হতো যখন বা যদি পরীক্ষক এসব প্রশ্নে প্রভাবিত না হয়ে পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করে প্রার্থীকে প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটি করতেন । শুনতে খারাপ লাগলেও এটিই বাস্তব যে, এখনো পরীক্ষক প্রার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ও বিষয়ের নাম দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাকে মূল্যায়ন করে থাকেন।
মোটামুটিভাবে বলা যায়, প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যে বিভেদ রচনা করা হয় এ ক্ষেত্রে ফলাফল কোনো গুরুত্ব পায় বলে মনে হয় না। অর্থাৎ সেই বৈষম্য থেকেই যায়। মেধার চেয়ে যদি প্রতিষ্ঠান জরুরি হয় ওঠে সেটি অমানবিক নয় কি?
এখন কথা হচ্ছে, চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে মেধাবীকে নেবে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু তা বলে সব মেধাবী যে হাতে গোনা দু'একটা জায়গাতেই থাকতে পারে সে নিশ্চয়তা কে দেবে? এক্ষেত্রে সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তার প্রতিষ্ঠান না জেনে বাছাই করলেই বোধ হয় একটা সমতা তৈরি হতে পারে। কেননা আমরা কেউই নিরপেক্ষ নই, সবাই কোনো না কোনো মানুষ বা বিষয়ের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। এক্ষেত্রে বিষয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম গোপন রাখার বিধান থাকা উচিৎ।
চাকরি তো অনেক পরের বিষয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিষয়ের পরিচয় (সরকারি নাকি প্রাইভেট ভার্সিটি, কলেজ নাকি সাধারণ ডিপ্লোমা, ইঞ্জিনিয়ারিং নাকি আর্টসের কিছু, বিবিএ নাকি ...) ইত্যাদি । পারিবারিকভাবে, সামাজিকভাবে কিংবা চাকরিগতভাবে জীবনের নানান জায়গায় একজন সম্ভাবনাময় ব্যক্তিকে সংকটের মুখোমুখি হতে হয়। এ দায়টা আমাদের সবার। একজন মানুষ নিজের ভেতরের সম্ভাবনা বোঝার আগেই তাকে দমিয়ে দেয়ার যে প্রক্রিয়া এটি বন্ধ করা উচিত।
কোনো কোনো চাকরির বিজ্ঞাপনে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ করে দেওয়া হয় যেন ক,খ, কিংবা গ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাড়া কেউ আবেদনই না করে। যোগ্যতা যাচাই এর অধিকার কি এখানে অবমাননার স্বীকার হচ্ছে না? আর যদি ক,খ বা গ বিশ্ববিদ্যালয়ই গুরুত্বপূর্ণ হয় তবে তারা কি এদেশের সব শিক্ষার্থীদের শিক্ষার চাহিদা পূরণ করতে পারবে? যদি তাই হয় তবে ইউজিসি কেন অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়? আর লোকে যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কালজয়ী মনে করে তারা একাই কি দেশকে এগিয়ে নিচ্ছে? বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার মান যদি খারাপই তবে সে বিষয়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহণ করুক! তাহলেই তো সবার মান বেঁচে যায়।
ঘুষ, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদির পর আরেকটি বাস্তবতা হলো অঞ্চলভিত্তিক, বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক, একই সাবজেক্টকেন্দ্রিক ইজম। এতকিছুর লড়াই করার চিন্তাই শিক্ষার্থীকে জ্ঞানী নয়, সুযোগসন্ধানী ও চাটুকার করে তোলে।
সত্যিকারের বৈষম্য যদি দূর করতেই হয় তবে নাম লুকিয়ে জ্ঞান ও দক্ষতাকে সামনে আনতে হবে। এটি কোনো শিক্ষার্থীর চাওয়া নয়, বিবেকবান কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। তবেই শিক্ষা বাঁচবে, ছাত্র বাঁচবে। ছাত্র বেঁচে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাঁচাবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেঁচে দেশ বাঁচাবে। অন্যথায় পরিবর্তন সোনার কাঠি হয়ে কেবল রূপকথাতেই শোভাবর্ধন করবে। আজকের ছাত্ররা অহমবোধে নয়, উদারতায় জ্ঞানী হোক, আজকের দেশ ছোট করায় নয়, সম্মান প্রদর্শনে বড় হোক।
লেখক: শিক্ষক, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়