Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

বৈষম্যবিরোধী বলতে কী বুঝব

Icon

মো. মোজাহিদুল ইসলাম নয়ন

প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৮:৩৬

বৈষম্যবিরোধী বলতে কী বুঝব

মো. মোজাহিদুল ইসলাম নয়ন। ছবি: সংগৃহীত

বৈষম্য শব্দটির মর্মার্থ দেশের শতকরা নব্বই জন মানুষেরই জানা। তারা জন্মাবধি বৈষম্যের অপ্রিয় ছোবলে বিদ্ধ হয়ে আসছে। সেই দেশে বড় কোনও আন্দোলনের মূল স্লোগান যে বৈষম্যবিরোধী হবে সেটিই তো স্বাভাবিক। জুলাই ছাত্র-গণআন্দোলন-এ যে সব দাবিকে সামনে নিয়ে এগিয়েছে তার পুরোভাগে ছিল-বৈষম্যবিরোধী এক নতুন দিনের প্রত্যাশা।

কিন্তু কথা হচ্ছে, আলোচ্য পরিপ্রেক্ষিতে বৈষম্যবিরোধী বলতে আমরা কী বুঝব? ‘বৈষম্যবিরোধী’  যে শব্দদ্বয়ের সন্ধিতে হয়েছে তাকে আলাদা করে দেখলেই শব্দদ্বয়ের আক্ষরিক অর্থ পরিস্কার হয়ে যায়। ‘বৈষম্য’ শব্দের সোজাসাপ্টা অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘অসম’। বন্টনে, ভাগে-যোগে অসম পরিমাপক ব্যবহার করার নামই বৈষম্য। বৈষম্য বলতেই চলে আসে একজনকে ঠকিয়ে আরেকজনকে বেশি দেয়া, কতিপয় মানুষকে সুবিধা দিয়ে কোটি মানুষকে ভূখা রাখা। বৈষম্য মানে তথাকথিত ক্ষমতাসীনদের ভোগ-বিলাস নিশ্চিত করতে লক্ষ মানুষকে চিরতরে দারিদ্রসীমার নিচে দাবিয়ে রাখার নির্মমতা। আর ‘বিরোধী’ শব্দটিতো আলোচ্য ‘বৈষম্য’-কে না করে দেয়া।

অর্থাৎ, কোনো বৈষম্য বা অসমকে সমর্থন না করা। যে বিপুল বিশাল শিক্ষার্থী বা তরুণ চলতি অসমতার অচলায়ন ভাঙতে চেয়েছে, সেই দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে দেশের ঘাড়ে চেপে বসা হাসিনার স্বৈরশাসনকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে  পেরেছে -  সেটা তো আশাবাদী হওয়ার মতো জাগরণ! একটা সময় এসেছিল যখন এদেশের অধিকাংশ মানুষ শেখ হাসিনার  লৌহকঠিন শাসনকে মেনে নিয়ে জীবনলীলা সাঙ্গ করতে চেয়েছিল। তারা প্রায়শই বলত-যতো যাই হোক, হাসিনা নিজে সরে না গেলে কিছু করার নেই। দেশের বিরাট সংখ্যক মানুষের ঐ যে ভয়ার্তভাবনা সেটিকে তো তারুণ্যই মিথ্যা প্রমাণ করল।

তারুণ্যের শক্তিতে আমরা আরেকবার স্বাধীনতার স্বাদ পেলাম। কিন্তু কথা হচ্ছে, আলোচ্য ‘বৈষম্যবিরোধী’ বলতে আমরা কী বুঝব? যে অসাম্যের মধ্যে আমাদের বসবাস, যে অসমব্যবস্থাপনায় আমাদের দেশের সকল প্রতিষ্ঠান, আইন-নীতিমালা, আচরণ, ব্যবহার সেখানে বৈষম্যবিরোধী একটি নতুন বাস্তবতা তৈরি করা কী সহজ কথা? তাই, এ পর্যায়ে আমাদের অবশ্যই বুঝে নেয়া দরকার ‘‘আলোচ্য ক্ষেত্রে তরুণরা বৈষম্যবিরোধী বলতে কী  বোঝাতে চেয়েছে” সেটি। আন্দোলনের দিনগুলোতে তরুণরা বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুলের শিক্ষার্থীরা আলোচ্য বিষয়ে তাদের বক্তব্য দেয়াল লিখনের মাধ্যমে পরিস্কার করেছে। আমরা যদি দেয়ালে দেয়ালে অঙ্কিত গ্রাফিতি ও স্লোগান লক্ষ করি তাহলে দেখা যাবে বৈষম্যবিরোধী বলতে তারা আসলে কী বোঝাতে চেয়েছে সেটি।

তারা রাষ্ট্র জনগণের মালিকানায় পরিচালনার কথা বলেছে। অর্থাৎ, রাষ্ট্র ও সরকারের সর্বপর্যায়ে জনগণের প্রতিনিধিত্বের কথাই তারা বলেছে। অর্থাৎ, তারা বলতে চেয়েছে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালিত হবে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে, একক কোনো দলের দ্বারা নয়। তারা চাকরিতে যৌক্তিক কোটাব্যবস্থা রাখার কথা বলেছে। বলেছে- নারী-পুরুষ, সর্বধর্ম, জাতিতাত্ত্বিক পরিচয় নির্বিশেষে সবার সমঅংশগ্রহণ নিশ্চিতের কথা। ঘুষের বিরুদ্ধে, দূর্নীতির বিরুদ্ধে, জুলুম, ধর্ষণসহ যত রকম নিপীড়নমূলক আচার-আচরণ আমরা দেখি তার চির অবসানের কথা তারা বলেছে। 

অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, উন্নয়নে আঞ্চলিক বৈষম্য (প্রধানমন্ত্রী যে জেলার সেই জেলাতেই সব উন্নয়ন), সমউন্নয়ন, রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে নাগরিকের নায্য হিস্যা নিশ্চিতের কথা দেয়ালে দেয়ালে এখনও জ্বলজ্বল করছে। আমরা কী তাদের লেখা স্লোগান, গ্রাফিতিগুলো পড়ে ‘বৈষম্যবিরোধী’র অর্থ বুঝতে চাইব না? যারা সুস্থ ধারার রাজনীতি, রাজনৈতিক বন্দোবস্ত দেখতে চান, তেমন প্রতিজন নিশ্চয়ই তরুণদের মতই প্রত্যাশা করেন। তরুণদের প্রত্যাশার সঙ্গে নিজেরা রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সত্যিকার জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ দেখতে চাই তাহলে আসুন-‘বৈষম্যবিরোধী’ বিষয়টিকে আরও কিছুটা খোলসা করি। 

প্রথমত বৈষম্য আমাদের মানুষের অস্থি-মজ্জায় এমনভাবে মিশে আছে যাকে সর্বব্যাপী বলা যায়। বলা যায়, একটি অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের প্রথমেই তাকাতে হবে নিজের দিকে। অর্থাৎ, প্রতিটি মানুষেরই প্রয়োজন আত্মমূল্যায়ন, গভীর আত্মপোলব্ধি। যাতে ব্যক্তিবিশেষ বুঝতে পারে তারমধ্যে, তাদের মধ্যে, যাদের সঙ্গে তার বসবাস, ওঠাবসা, চলাফেরা তারা নিজের মধ্যে কতটা আর কীভাবে ‘বৈষম্যকে’ ধারণ করে।

 এমন কেউ যখন বৈষম্য দূর করতে ভূমিকা রাখতে চায় তাহলে কীভাবে সে নিজেকে পরিশুদ্ধ করবে এবং তার চেনা চৌহদ্দির মধ্যে আলোচ্য বিশেষ এই দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে সেটা একটি বিশেষ ভাবনার বিষয়। ব্যক্তি যদি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি মনের গহীনে ধারণ করে তাহলে তার দ্বারা (যে যতই শিক্ষাদিক্ষা লাভ করুক না কেন)  কোনোদিনই বৈষম্যবিরোধী কিছু করা সম্ভব হবে না। কারণ, মানুষ শেষ বিচারে তার ভেতরে প্রোথিত দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারাই পরিচালিত হয়। আর দৃষ্টিভঙ্গি এমন একটি আধেয় যা খালি চোখে দেখা যায় না কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গিকে ধরা যায় ব্যক্তির আচরণগত প্রকাশে। 

বিষয়টি আরও স্পষ্ট করতে একটি উদাহরণ দেয়া যাক। ধরুন, যদি কোনো ব্যক্তি নারী-পুরুষের ভিন্নতার কারণে দুটি সত্তাকে ভিন্ন মনে করে। সেক্স্যুয়াল পার্থক্যের কারণে ভিন্ন শক্তি বা ক্ষমতার আধার মনে করে তাহলে সে প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীর চেয়ে পুরুষকে বেশি শক্তিশালী মনে করবে। এমন ব্যক্তিবিশেষ ‘শক্তি/ক্ষমতাকে খুব সংকীর্ণ অর্থে বুঝে থাকে। বৈষম্য রয়েছে আমাদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে (ইন দ্য সোস্যালাইজেশন প্রসেস), আমরা পরিবারে যখন বড় হই তখন ভাই-বোনদের খাদ্য, খাদ্যের পরিমান, খাদ্যমান, খাদ্যপরিবেশন অথবা খাদ্যগ্রহণ সময়, পোশাক, খেলাধুলা, খেলাধুলার সামগ্রী ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রেই পার্থক্য লক্ষ করি। এছাড়া, কথা বলার ধরন, কথার টোন্ কথার সাউন্ড ইত্যাদি সবকিছুতেই নারী-পুরুষকে পার্থক্য করার কালচার সমাজে রয়েছে। একটি ছেলে যদি সন্ধ্যায় বাড়ির বাইরে যেতে পারে সেক্ষেত্রে কন্যা সন্তানকে সময়ে-অসময়ে বাইরে যাওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পরিবারের মধ্যে এমন লৈঙ্গিক পার্থক্য চর্চা করে বেড়ে ওঠা ছেলে ও মেয়ে উভয়েই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমাজের বৃহত্তর পরিসরে আসে। যখন তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যায়, চাকরি-বাকরিতে যায় এবং বৈবাহিক সম্পর্কে সম্পর্কিত হয় তখনও সেই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিই তাদের চালিত করে। ফলে, প্রায় সর্বক্ষেত্রেই আমরা নারী-পুরুষের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত বিস্তর পার্থক্য লক্ষ করে থাকি।

আমি মনে করি, নারী-পুরুষের বেড়ে ওঠার পথে যে ভিন্ন সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া সেখানেই বৈষম্যের বীজ রোপিত হয়। যা ব্যক্তিমানুষের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যে দিনে দিনে কেবল গভীরই হয়। আর একসময় সেই বৈষম্যের বীজ ব্যক্তির মধ্যে মহীরূহ হয়ে দানবে পরিনত হয়। তাকে আর সংশোধনের সুযোগ থাকে না। আমরা যদি প্রতিষ্ঠানে আসি সেখানেও বৈষম্য দেখি! দেখি, নারী-পুরুষে পার্থক্য, ব্যবস্থাপনায় নারীর জন্য এক ব্যবস্থা তো পুরুষের জন্য আরেক আয়োজন। তেমনি-আদিবাসী হলে একরকম, ভিন্ন লৈঙ্গিক পরিচয়ে (তৃতীয় লিঙ্গ) পরিচিত হলে তাকে বা তাদেরকে একেবারেই আলাদা চোখে দেখা হয়। বলা বাহুল্য, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য আমাদের দেশে এখনও অনেক প্রতিষ্ঠানে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা বা সুযোগ-সুবিধা গড়ে ওঠেনি। ব্যক্তি প্রতিবন্ধী হলে, নারী হলে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় কম শিক্ষিত হলে, গ্রামের মানুষ হলে, গায়ের রঙ ভিন্ন হলে, উচ্চতায় খাটো হলে, কথা বলায় আঞ্চলিকতা থাকলে তাতেও বৈষম্যের অভিজ্ঞতা হয় শতভাগ ক্ষেত্রেই। রাজনৈতিক দল, জাতীয় প্রতিষ্ঠান, দ্রষ্টব্য ইত্যাদিতে বৈষম্য আরও দৃশ্যমান।

বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী রাজনৈতিক দলসমূহে ৩৩ শতাংশ (এই যে ৩৩ শতাংশ এটিও তো একপ্রকার বৈষম্যই) সদস্য নারী হতে হবে। কিন্তু এখনও কোনো রাজনৈতিক দল সে লক্ষ্য পূরণ করেনি। বিগত প্রায় তিন দশক ধরে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী দুজনই নারী হলেও তারা স্ব-স্ব দলে নারীর প্রতিনিধিত্ব আনুপাতিক করতে পারেনি। তার অর্থ হলো-সমাজ যেখানে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা চালিত সেখানে নারীবিশেষ শুধু শীর্ষপদে থাকলেও নারী-পুরুষের সমতা আনতে ব্যর্থ হয়।

আর সে কারণেই দৃষ্টিভঙ্গিতে সেক্যুলার হওয়া, অসাম্যকে ধিক্কার জানানোর বিষয়টি ব্যক্তি বা সমষ্টির এক বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্যে হতে হবে যা একটি মৌলিক শিখন। এটা চাইলেই আকাশ থেকে পড়বে না। দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫৪ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে  কিন্তু এখনও দেশের শতভাগ মানুষ খাবার পায় না। এখনও দেশের ১২ শতাংশের বেশি মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমার মধ্যে বাস করছে। অর্থাৎ, দেশের প্রায় আড়াই থেকে তিনকোটি মানুষের দৈনিক আয় দুই ডলারের নিচে। বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের বাজারে ঐ আয় দিয়ে একজন মানুষ কীভাবে জীবন চালাচ্ছে তার খোঁজ কি আমরা রাখছি? এছাড়া, ৩৪% মানুষ রয়েছে দারিদ্র্যসীমার নিচে।

দেশের চরম দরিদ্র ওই মানুষগুলোকে টার্গেট করে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু আছে। সরকারের হিসেবে ১৪০টিরও বেশি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে কিন্তু তার কতটি ওই দরিদ্র মানুষগুলোর জন্য সহায়ক সেটি একটি বড় প্রশ্ন। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির একটি বড় অংশ হল-সরকারের পেশনশন কর্মসূচি। আর যে কয়েকটি কর্মসূচি দরিদ্রমানুষের জন্য রয়েছে তারমধ্যে একটি দুটি বাদ দিলে বাকি সবই লোক দেখানো। ভিজিডি অর্থাৎ ভারনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট কর্মসূচিই কেবল দুইবছরের সাইকেলে পরিচালিত হয়। যেখানে একজন নারী উপকারভোগী প্রতিমাসে ৩০ কেজি চাল/গম, কিছু পরিমাণ সঞ্চয় এবং কতিপয় বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে। যদিও সেগুলোর মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে কিন্তু এছাড়া আর সবগুলি কর্মসূচিই আসলে এককালীন। যেমন-ভিজিএফ, কাবিখা, কাবিটা, টিআর ইত্যাদি বিশেষ সময়ে পরিচালিত হয়। ফলে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির নামে সরকার যতো বাগড়ম্বর করে থাকে তা বাস্তবিক তেমন কিছুই নয়। 

আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনায় আঞ্চলিক বৈষম্যও অনেক প্রকট। যেমন ধরুন-জাতীয় বাজেটে যে সার্বিক বরাদ্দ (যেমন-চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা) তা দেশের মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে যে ভাগফল পাওয়া যায় তাই হল-একজন নাগরিকের মাথাপিছু বাজেট হিস্যা। যদি ধরে নিই একটি ইউনিয়নে গড়ে ২৫ হাজার মানুষের বাস তাহলে সেখানে জাতীয় বাজেটের হিস্যা হবে আনুমানিক ৭ কোটি ৯০ লাখ টাকার ওপরে। কিন্তু বাস্তবে ইউনিয়ন প্রতি বার্ষিক বরাদ্দ কত? এখন পর্যন্ত যে অভিজ্ঞতা তাতে সেটি ১০ লাখ টাকা তা তার কিছু কমবেশি। তার মানে জাতীয় বাজেটের ন্যায্যহিস্যার চেয়ে ইউনিয়ন প্রতি বার্ষিক বরাদ্দ অনেক অনেক কম। এছাড়া, দেশের ভৌগলিক ভিন্নতা, জনসংখ্যার তারতম্য, যোগাযোগের বাস্তব অবস্থা, জমির উর্বরতা, শিক্ষা-স্বাস্থ-পয়ঃনিষ্কাশনের সুযোগ-সুবিধা, কর্মসংস্থানের সুযোগের ভিন্নতা ইত্যাদি বিবেচনায়ও দেশের একেকটি অঞ্চল একেক ধরনের উন্নয়ন সহায়তা দাবি করে। কিন্তু চলতি উন্নয়ন সংস্কৃতিতে ঢালাও বরাদ্দ দেয়া হয়। ফলে, আঞ্চলিক বিশেষ সমস্যা ও সংকটের সমাধান হয় না।

উন্নয়ন বাজেট বরাদ্দ নিয়েও রয়েছে নানান কূটচাল। যে সকল মন্ত্র-এমপি তারা অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে যেভাবে উন্নয়ন বরাদ্দ তাদের স্ব-স্ব নির্বাচনী এলাকার অনুকূলে নিয়ে যায় তাতেও আঞ্চলিক বৈষম্য আরও প্রকট হয়ে ওঠে। বিগত সরকারের সময়ে আমরা দেখেছি, অনেক মন্ত্রী-এমপি জাতীয় উন্নয়ন বরাদ্দ এমনভাবে নিজ এলাকায় নিয়ে গেছে যে দেশের বেশিরভাগ জেলা বা অঞ্চলের উন্নয়নবৈষম্য প্রকট হয়ে ধরা পড়েছে। এছাড়াও, আমাদের আরেকটি অসুস্থ  সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। সেটি হচ্ছে যে সব এলাকা বিরোধীদলীয় এমপি, বিরোধীদলীয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীর এলাকা হিসেবে পরিচিত সেই এলাকায় উন্নয়ন কার্যক্রম একেবারেই বন্ধ করে দেয়া। যেমন ধরুন-বিগত হাসিনা সরকারের সময় গোপালগঞ্জ জেলা বা ঐ অঞ্চলের উন্নয়নে (মূলত অবকাঠামোগত) যে পরিমান অর্থ খরচ করা হয়েছে তা কী কোন যুক্তিতে করা হয়েছে? সেটা কী কোনোভাবে অন্যান্য জেলার উন্নয়ন বরাদ্দের সাথে আনুপাতিকভাবে সঠিক? সেই জেলায় ১০০ টাকা বরাদ্দের বিপরীতে পঞ্চগড়ে কত টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সে প্রশ্ন তো করাই উচিত। এগুলো সবকিছুই বৈষম্যের যে বীজ আমাদের ব্যক্তি বিশেষ বা সমষ্টির মধ্যে রয়েছে তারই বিশ্রি বহিঃপ্রকাশ। 

দেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলসমূহের অর্থনৈতিক কর্মসূচি কী? বিগত ৩০ বছরের অধিককাল দেশ শাসন করেছে যে দুটি দল তাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মসূচি কী? তারা তো মুক্তবাজার অর্থনীতি অর্থাৎ পুঁজিবাদী অর্থনীতিকেই দলীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। সেই কারণে তাদের দলীয় গঠনতন্ত্র, ঘোষণাপত্র, নির্বাচনি ইশতেহার কোথাও তো বৈষম্যবিলোপে অর্থনৈতিক কর্মসূচি নেই। তারা কীভাবে অর্থনৈতিক সমতা বা সাম্য আনবে? জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে সবাইকে উন্নয়ন ও সমাজের মূলধারায় আনবে তার কী কর্মসূচি আছে তাদের?

 ভূমিসংস্কার নিয়ে, পার্বত্য অঞ্চলে, সমতলের আদিবাসীদের জন্য কী বিশেষ কর্মসূচি তাদের আছে? দলিত-ভিন্ন লৈঙ্গিক পরিচয়ের মানুষ কীভাবে মূলধারায় আসবে তার কী অঙ্গীকার আছে ওই সব রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচিতে? সমাজতন্ত্রকে মূলমন্ত্র করে যে রাজনীতি এদেশে প্রচলিত তাদের দলীয় ঘোষণাপত্রে বৈষম্যবিরোধী ও সাম্যের কর্মসূচি ব্যাখ্যা করা আছে কিন্তু‘ তার বাস্তবতা আমরা এতোবছরে কতটুকু দেখতে পাই? শেষ বিচারে রাজনীতি তো দলীয় কর্মসূচি সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করে এবং আস্থায় নিয়ে এগিয়ে যাওয়ারই নাম। 

সেখানে সমাজতান্ত্রিক বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো তো আজও পর্যন্ত দেশের জনগোষ্ঠীর বৃহৎ অংশের নিকট পৌঁছাতেই পারল না। বৈষম্যের বীজ ব্যক্তির মধ্যে পরিবারে রোপিত হলেও তার বিকাশ হয় মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে। দেশের শিক্ষাকার্যক্রম, শিক্ষাপদ্ধতি ও শিক্ষানীতি কী বৈষম্যহীন? না। বরং এদেশে একাধিক শিক্ষাপদ্ধতি চালু আছে। আছে সাধারণ শিক্ষা, মাদ্রাসাশিক্ষা, ইংলিশ মিডিয়াম, কওমি মাদরাসাশিক্ষা, কিন্ডারগার্টেন আরও কতো কী! উপর্যুক্ত এতো এত রকম শিক্ষাপদ্ধতি চালু রেখে আমরা কীভাবে বৈষম্যহীন দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন প্রজন্ম পাব? উক্ত সকল প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে যদি আপ্তবাক্য হিসেবে ‘বৈষম্যবিরোধী’ সমাজ চাই বলি তাহলে তা কেবল মরিচীকার পেছনে উদ্দেশ্যহীন ছোটাই হবে।

লেখক: অধিকারভিত্তিক উন্নয়ন সন্ধানী

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫