Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

বিপ্লবের চেতনাই এখন আমাদের সমষ্টিগত ধর্ম

Icon

কাজী জহিরুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৫:০০

বিপ্লবের চেতনাই এখন আমাদের সমষ্টিগত ধর্ম

কাজী জহিরুল ইসলাম

আপনারা কি ছাদ পেটানোর গান শুনেছেন? পুরান ঢাকার উর্দুভাষীরা এই ধরনের গানকে বলত কোবাকাম। বাংলাদেশের সর্বত্রই ছাদ পেটানোর সময় শ্রমিকরা সমবেত কণ্ঠে এক অসাধারণ তালে তাদের নিজস্ব অঞ্চলের সারিগান করে এবং সেই ছন্দে ছন্দে ছাদ পেটান। সেসব গানের কথায় প্রচুর অশ্লীল শব্দও থাকে। নৌকার গুণ টানার সময় মাঝিরা গান করেন, দলবেঁধে খেত নিড়ানোর সময় চাষিরা গান করেন। কাজের সঙ্গে সংগীতের কী সম্পর্ক? সম্পর্ক হচ্ছে- তালের। কাজের ছন্দ ঠিক রাখার জন্য দরকার হয় গান, ছন্দোবদ্ধ কবিতা। 

জুলাই বিপ্লবের সময় ছাত্র-জনতা কাজী নজরুল ইসলামের গান গেয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় আন্দোলনের ভিডিওতে সংযোজন করেছে, কারার ঐ লৌহ কপাট/ভেঙে ফেল করলে লোপাট, দুর্গম গিরি কান্তার মরু, মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম, পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, দেশটা তোমার বাপের নাকি করছো ছালাকলা/কিছু বললেই ধরছো চেপে জনগণের গলা ইত্যাদি। এসব গান, কবিতা, দেয়াল লিখন, গ্রাফিতি, কার্টুন, আন্দোলনে নিহত বিপ্লবীদের পোর্ট্রেট, কবিতার লাইন, দ্রোহের কবিতা আবৃত্তির অডিও/ভিডিও ইত্যাদি শিল্পকর্ম আন্দোলনকে সব সময় চাঙ্গা রেখেছে, উদ্দীপ্ত রেখেছে এবং সামনে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে; বিপ্লবী তরুণ ছাত্র-জনতার হৃদয় থেকে ভীতি দূর করে তাদেরকে সত্যের পথে, দেশপ্রেমের পথে জীবন উৎসর্গ করতে উৎসাহিত করেছে। 

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার কাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জন হয়েছে। স্বৈরাচার দেশ ছেড়ে পালিয়েছে; কিন্তু আমাদের কাজ শেষ হয়ে যায়নি। যে প্রত্যাশা নিয়ে ছাত্র-জনতা জীবন দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে, সেই প্রত্যাশার সূর্য উদয় হয়েছে ৫ আগস্ট; কিন্তু আকাশ এখনো মেঘে ঢাকা। মেঘ সরিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে একটি রৌদ্ররোজ্জ্বল দিন উপহার দেবার জন্য আমাদের অনেক কাজ করতে হবে। সেই কাজের জন্য দরকার অনুপ্রেরণা; দরকার সঠিক ছন্দের গান, কবিতা।

আমাদের পরিশ্রান্ত দেহ ও মনের বিশ্রামের জন্য শিল্প দরকার, আবার উজ্জীবিত রাখার জন্যও শিল্প দরকার। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার যে লক্ষ্য আমরা নির্ধারণ করেছি, সেখানে পৌঁছানোর একটি সঠিক রাস্তা আমাদেরই নির্মাণ করতে হবে। রাষ্ট্র-সংস্কার হচ্ছে সেই রাস্তা। এই কাজটি করার জন্য আমরা একটি নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছি, সেই সরকার রাষ্ট্রযন্ত্রের নাট-বলটু টাইট দিচ্ছে, যন্ত্রাংশ বদলাচ্ছে, নতুন যন্ত্রাংশ সংযোজন করছে। এই কাজ করতে গিয়ে তারা ক্লান্ত হয়ে যেতে পারেন, বিভ্রান্ত হতে পারেন, পথভ্রষ্ট হতে পারেন, ঘুমিয়ে পড়তে পারেন, অলস হয়ে পড়তে পারেন, অনৈতিক প্রলোভনে পা দিতে পারেন। 

তারা যেন ঠিক পথে থাকেন সেজন্য এদেশের ছাত্র-জনতাকে সজাগ থাকতে হবে এবং ছাত্র-জনতাকে সজাগ রাখার জন্য লেখক, কবি, শিল্পীসমাজকে ক্রমাগত জাগরণের শিল্প তৈরি করতে হবে। বিপ্লবকে দীর্ঘজীবী করে বৈপ্লবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিল্পকর্ম। আইনস্টাইন বলেছেন- শিল্প আমাকে বিপ্লবের কাছে নিয়ে যায়, উল্টোটাও হয়, বিপ্লব আমাকে শিল্পের কাছে নিয়ে যায়। বিপ্লব আর শিল্প একে অন্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। একটি সমাজে যদি বিপ্লবের চেতনায় উজ্জীবিত শিল্প তৈরি না হয় সেই সমাজের পক্ষে বিপ্লবের সুফল মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া প্রায় অসম্ভব। বিপ্লবের চেতনাকে স্থায়ীত্ব দেয় শিল্পকর্ম। আমাদের মনে রাখতে হবে ২০২৪ সালের জুলাই মাসের ৩৬ দিনে বাংলাদেশে যে বিপ্লব ঘটেছে- এই বিপ্লবের চেতনাই এই ভূখণ্ডের মানুষের ঐক্যের মূলমন্ত্র, প্রধানতম ধর্ম। ব্যক্তিগতভাবে আমরা মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, নাস্তিক যা-ই হই না কেন, সমষ্টিগতভাবে আমাদের ধর্ম হলো- বিপ্লবের মূল যে চেতনা ‘বৈষম্যহীন বাংলাদেশ’ সেটি। এই চেতনাই পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে।

এই ঐক্যের মন্ত্রকে কেন্দ্রে রেখে আমাদের তৈরি করতে হবে মানসম্মত শিল্পকর্ম। এখন পর্যন্ত আমরা ৬২০ জন শহীদের নাম জেনেছি, এই তালিকা আরও বড় হবে। সব শহীদের জন্য একটি করে ভাস্কর্য তৈরি করতে হবে। প্রতিটি জেলার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে জুলাই বিপ্লবের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করতে হবে, যাতে সকালে অফিসে ঢোকার সময় জেলার সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীদের এই বিপ্লবের মূলমন্ত্রটি মনে পড়ে। প্রতিটি স্মৃতিস্তম্ভে সেই জেলার শহীদদের নাম খোদাই করে লেখা থাকবে।

বিপ্লবের চেতনায় উজ্জীবিত প্রচুর গান লিখতে হবে, সুর করে দেশের বরেণ্য শিল্পীদের দিয়ে তা প্রতিটি টিভি চ্যানেলে পরিবেশন করাতে হবে। প্রচুর কবিতা লিখতে হবে, প্রচুর বই লিখতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতিটি ধাপকে সহজ করার জন্য, জনবোধ্য করে তোলার জন্য নাটক, পথনাটক, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। বিপ্লবের গ্রাফিতি, পথের আল্পনা, দেয়াল লিখন ইত্যাদির ওপর চিত্রকর্ম, আলোকচিত্র প্রদর্শনী ইত্যাদির আয়োজন করতে হবে। বিপ্লবের সঙ্গে জড়িত সবার আন্দোলন সম্পৃক্ততার গল্প লিখতে হবে। বিপ্লবের ওপর বেশ কিছু ভালো উপন্যাস লিখতে হবে। টক শোগুলোতে সারা বছর ধরে বিপ্লবের ওপর আলোচনা করতে হবে। এসবের মধ্য দিয়ে সরকারকে চাঙ্গা রাখতে হবে, যাতে লক্ষ্য অর্জন হওয়ার আগে কেউ ঘুমিয়ে পড়তে না পারে।

জাতীয় সংগীত বদলানো/না বদলানো নিয়ে একটি ঘৃণ্য রাজনীতি হচ্ছে। বিপ্লবকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই একদল অন্ধ, বোকা এবং স্বার্থপর মানুষ এই প্রশ্নের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে একটি ইস্যু তৈরি করছে। জাতীয় সংগীত বদলানোর প্রসঙ্গ উত্থাপনের সময় এটা নয়। আমাদের এখন সময় বিপ্লবের সংগীত রচনা করার। আমাদের জাতীয় সংগীত আছে, রণসংগীত আছে। আসুন এবার একটি অসাধারণ বিপ্লব-সংগীত রচনা করি। জাতীয় অনুষ্ঠানে দরকার হলে আমরা বিপ্লব-সংগীতের অংশবিশেষ বাজাব। অন্তত এই বিপ্লবী সরকার তাদের রাষ্ট্র-সংস্কারের রোডম্যাপে যতদিন থাকছে ততদিন নিজেদের উজ্জীবিত রাখার জন্য বিভিন্ন সভা-সমাবেশে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি বিপ্লবের সংগীত পরিবেশন করতে পারে। 

বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার যে সুযোগ আমরা পেয়েছি, তা কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না। ব্যক্তিগত প্রাপ্তির কথা ভুলে গিয়ে যার যা আছে তা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে, যাতে আমরা একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারি, যাতে বাংলাদেশের মানুষ সর্বার্থেই স্বাধীন মানুষ হয়ে উঠতে পারে এবং প্রত্যেকে তার মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী সঠিক মর্যাদা পায়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫