Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

একজন আদর্শিক বুদ্ধিজীবী: অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক

Icon

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:৪৫

একজন আদর্শিক বুদ্ধিজীবী: অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক

অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক

বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধির চর্চায় যে কয়েকজন মানুষ আছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। জীবনযাপনে অত্যন্ত সাধারণ এই অধ্যাপক সমাজকে বরাবর দেখেছেন এক নির্মোহ, নিরপেক্ষ এবং বাস্তববাদী চোখ দিয়ে। কোনো রাজনৈতিক পক্ষ বা ক্ষমতার অংশ হিসেবে তিনি কখনো কাজ করেননি।

বিশেষত যে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে তিনি দীর্ঘদিন কাজ করেছেন, সেখানকার যে রাজনীতি তা মূলত নিজেদের সুবিধা অর্জনের পথেই যায়; কিন্তু এসব থেকে তিনি সযতনে নিজেকে মুক্ত রাখতে পেরেছেন। যদিও দেশের যে কোনো সংকটকালে তার চিন্তার প্রকাশে তিনি সরব থেকেছেন, প্রয়োজনে প্রতিবাদ করেছেন। নিজের কর্তব্য এবং দায়িত্বশীলতা প্রকাশে কখনো পিছপা হননি।

ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক ছাত্ররাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত হন। তারপর থেকে কখনই রাজনীতির সঙ্গে বিযুক্ত হননি। তার আদর্শ মার্কসবাদ বা সমাজতন্ত্র। তবে তিনি রক্ষণশীল সমাজতন্ত্রী নন, বরং উদারনৈতিক সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী একজন মানুষ। সেটি শেষ পর্যন্ত মানবতাবাদী চিন্তাভাবনার দিকেই যায়। তার মতে, মানুষই হচ্ছে আসল কথা। মানুষের কল্যাণের জন্যই পৃথিবীর সব তত্ত্ব এসেছে। এই উদারনৈতিক সমাজতান্ত্রিক অবস্থান তার মধ্যে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের চিন্তা প্রভাবিত করেছে। তার চিন্তা, জীবন এবং কর্ম একটা মানবিক কল্যাণকর সমাজের দিকেই অগ্রসর বা ধাবিত হয়েছে। সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তার মধ্যে সব সময় কাজ করেছে, যার পথ তিনি খুঁজেছেন তার বিভিন্ন রচনার মধ্য দিয়ে। সমাজতান্ত্রিক আদর্শের পক্ষে তিনি তার লেখনীকে সব সময় সক্রিয় রেখেছেন। 

তিনি তার প্রতিটি কাজের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন একজন শিক্ষাব্রতী, সাহিত্যানুরাগী, নির্লোভ এবং মানবদরদী মানুষ হিসেবে। মানুষের প্রতি কমিটেড বা একজন আদর্শিক বুদ্ধিজীবী বলতে তাকেই বোঝায়। তার সম্পর্কে বলতে গেলে অনেকের মুখেই যে শব্দটি অনিবার্য হয়ে ওঠে তা হলো- একজন ভালো মানুষ। শিক্ষক হিসেবেও তিনি অত্যন্ত ছাত্রবৎসল, সৎ, সুস্থির এবং দৃঢ় চিত্তের একজন মানুষ ছিলেন। তার প্রাক্তন ছাত্রদের কাছে এখনও তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক। শিক্ষক হিসেবে তিনি তাদের পরম শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার। 

সন্তান দীপন হত্যাকাণ্ডের পর ছাত্রদের আয়োজিত এক বিক্ষোভ সমাবেশে তিনি এসেছিলেন। পুত্র হত্যার বিচার আশা করেন কিনা- এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি খুব ঠাণ্ডা মাথায় বলেছিলেন, ‘দীপন আমার পুত্র; কিন্তু  তাকে হত্যার বিচার আমি চাই না, অন্তত এই সরকারের কাছে চাই না। আমি চাই পরিবর্তন। দীপনের মৃত্যুর বিনিময়ে যদি সমাজ বদলায়, তা হলে ওটাই হবে আমার কাম্য’। এই হচ্ছেন আদর্শ শিক্ষক আবুল কাসেম ফজলুল হক। ব্যক্তিগত শোকের বিনিময়ে হলেও তিনি প্রত্যাশা করেন একটি সুন্দর সমাজের। 

ইতিহাসের যে গতিপ্রকৃতি সেটা দিয়েই তিনি সমাজকে দেখতে অভ্যস্ত। এর সঙ্গে মিশেছে তার স্থানিক বা আমাদের সমাজের শ্রেণিবিন্যাসের যে ধারণা। ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি যেমন রাজনীতি ও সমাজকে বিশ্লেষণ করেছেন, তেমনি এখানকার শ্রেণি বিন্যাসের ধারণাকেও তিনি যুক্ত করেছেন। বুদ্ধিজীবিতার ব্যাপারে তিনি এমন একটি অবস্থান নিয়েছেন, যেখানে সব সরকারের আমলে ক্ষমতার বাইরে থেকে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন, প্রশ্ন তুলেছেন। কখনো আপস করেননি, কখনো সুবিধাও নেননি। এক্ষেত্রে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের গতানুগতিক যে ধারা; তার মধ্যে তার অবস্থান ভিন্ন, স্বতন্ত্র। 

১৯৪৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- মুক্তিসংগ্রাম (১৯৭২), কালের যাত্রার ধ্বনি (১৯৭৩), একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলন (১৯৭৬), উনিশশতকের মধ্যশ্রেণি ও বাঙলা সাহিত্য (১৯৭৯), রাজনীতি ও দর্শন (১৯৮৯) ইত্যাদি। লেখক জীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালে পেয়েছেন বাংলাদেশ লেখক শিবির পুরস্কার, ১৯৮১ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন। আদর্শিক এই বুদ্ধিজীবীর জন্মদিনে রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

নাসরিন আখতার
উপ-সম্পাদক, সাম্প্রতিক দেশকাল

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫