Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

গভর্নরের বক্তব্য এবং বাস্তবতা

Icon

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ১০:১২

গভর্নরের বক্তব্য এবং বাস্তবতা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

ক্ষমতায় বসেই দেশের ১০টি ব্যাংক দেউলিয়া অবস্থায় আছে বলে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। তিনি অবশ্য ব্যাংগুলোকে রক্ষা করার আশ্বাস, দুর্বল ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার পরিকল্পনাও তার আছে। কিছু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন করে আবার গঠন করেছে। এতে ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে মাত্র, ব্যাংকের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। 

বাণিজ্যিক ব্যাংকের মালিকদের ওপর জনগণের আস্থা থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তালিকাভুক্ত হওয়ার প্রয়োজন হতো না। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর আস্থা আছে বলেই জনগণ বাণিজ্যিক ব্যাংকে টাকা জমা রাখে। বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জনগণের সেই আস্থায় ধস নামিয়ে দিয়েছেন। পরে নানা পদক্ষেপ ও আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও জনগণের আস্থা আর ফেরত আসছে না, তারল্য সংকটে ব্যাংকগুলোর নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। 

আওয়ামী আমলেও ব্যাংকগুলোর লিকুইডিটি বা তারল্য সংকট ছিল; কিন্তু এই সংকট এখন চরম আকার ধারণ করেছে। সবাই তাদের জমা টাকা তোলার জন্য ভিড় করছে; ভিড় যত বাড়ছে, ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট ততবেশি উন্মোচন হচ্ছে, চেকের টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। যে ব্যাংক আমানতকারীর টাকা পরিশোধ করতে পারে না, সেই ব্যাংকে কেউ নতুন করে টাকা জমা রাখবে- এই আশা বাংলাদেশ ব্যাংক করে কী করে? যে কোনো ব্যাংকের তারল্য সংকটে বাংলাদেশ ব্যাংক পাশে থাকবে- এই কথাটি বলে আগের গভর্নর রউফ তালুকদার জনগণকে আশ্বস্ত করেছিলেন; নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর এমন একটি আশ্বাস দিয়ে গোপনে কঠোর মনিটরিং করতে পারতেন। বাংলাদেশ ব্যাংককে মনে রাখতে হবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন গভর্নরের মন্তব্যের কারণে মানি-মার্কেটে সুনামি হয়ে যেতে পারে। 

আমাদের অর্থনীতি এত বড় নয় যে, অর্ধ শতাধিক ব্যাংক প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার জন্য উপযোগী। দেশে ব্যাংকের সংখ্যা বাড়লেও সে অনুসারে কাস্টমার না বাড়ায় আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণে অসম প্রতিযোগিতা বেড়েই চলেছে। কোথাও কোথাও একই ভবনে একাধিক ব্যাংক-শাখা। দুর্বল ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জীবন বীমার কর্মচারীদের মতো টাকার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে; কিন্তু টাকা পাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক গ্যারেন্টি দেওয়া সত্ত্বেও সবল ব্যাংকগুলো দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ধার দিচ্ছে না। সংকটে পড়ে ১২ শতাংশের বেশি সুদে আমানত নিয়ে ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সৃষ্ট দুর্যোগ থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে; কিন্তু টেকসই উন্নতি দৃশ্যমান হচ্ছে না। 

শুধু অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে নয়, ব্যাংকগুলোর দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার গুজব ও অপপ্রচার শুরু হয়েছে করোনার সময় থেকে। বাজারের পণ্যমূল্যের খবর পরিবেশন করে করে মিডিয়া যেভাবে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেয়, ঠিক তেমনি ‘দেউলিয়া’ ব্যাংক আর ‘খেলাপি’ ঋণের কথা বলে বলে ব্যাংকগুলোর ওপর জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। 

এস আলম সব ব্যাংকের টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে- এমন প্রচারে আমানতকারীর মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক। বর্তমান গভর্নর প্রথম প্রথম প্রায় প্রতিদিন এস আলমকে নিয়ে বিবৃতি দিয়ে গেছেন। গভর্নরের অতিরিক্ত বিবৃতির কারণে এস আলমের মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর অস্তিত্ব নিয়ে জনগণের মধ্যে একটা ভীতির জন্ম হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত এক লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তারা কী করেছে তা বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সংশ্লিষ্ট তফসিলি ব্যাংকের জানার কথা। ঋণ নেওয়া তো অপরাধ নয়, ঋণ প্রদানে অনিয়ম হলে দাতা-গ্রহীতা উভয়ই অপরাধী। 

খেলাপি ঋণের হার নিয়ে যেভাবে মিডিয়ায় হৈচৈ হচ্ছে তা অতিরিক্ত ও অতিরঞ্জিত। ত্রিশ বছর আগেও রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ছিল ৩৩ শতাংশের বেশি, এখন সম্ভবত ১১ শতাংশের কাছাকাছি; অবশ্য এখন খেলাপি ঋণের হিসাবায়ন ভিন্নতর। ব্যাংকের ওপর এস আলম গ্রুপের অযাচিত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কয়েকটি কলাম লিখেছি, বাংলাদেশ ব্যাংকে আমার জুনিয়র কর্মকর্তার প্রতি তাদের প্রীতির কারণে আমি ডেপুটি গভর্নর হতে পারিনি বলে জানতাম। তার পরও এই গ্রুপের বিনাশ কারও কাম্য হতে পারে না। বর্তমানে এস আলমের ছয়টি ব্যাংকে ২৬ হাজার কোটি টাকা জমা আছে বলে জানা যায়, অন্য ব্যাংকেও থাকতে পারে। এই গ্রুপের সম্পদ কত তার হিসাব সম্ভবত এখনও বের করা হয়নি; তবে এক লাখ কোটি টাকার কম হবে বলে মনে হয় না। করপোরেট ব্যবসায়ীরা বেনামে ঋণ নিতে অভ্যস্ত, পরিদর্শনে ধরা পড়লে অতীতে গোপনে নিয়মিত করে জরিমানাসহ তা আদায়ের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবে হৈচৈ করছে- মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে এস আলম গ্রুপে কর্মরত এক লাখ আশি হাজার শ্রমিক-কর্মচারীকে কর্মহীন করে দেওয়া দেশের জন্য সুবিবেচনার পরিচায়ক হবে না। 

কয়েকটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে কেবল ব্যাংকের মালিকদের টাকার চাহিদা পূরণের জন্য- কথাটি আমার নয়, বর্তমান অর্থ উপদেষ্টার। এই ব্যাংকগুলো তাদের মালিকদের ঋণের চাহিদা মেটাতে গিয়ে কোনো নিয়মনীতি মানেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকও তাতে সায় দিয়েছে, সায় না দিলে এত অনিয়ম হতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের অফসাইট, অনসাইট তদারকির বেড়াজাল ভেদ করে কী করে এত অনিয়ম হলো, তা বের করার জন্য একটি কমিশন হওয়া দরকার। অবশ্য নিজের ব্যাংক থেকে মালিকদের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণে প্রতিবন্ধকতা তৈরির ক্ষেত্রে সব সরকারের আমলে আইনের পর আইন প্রণয়ন করা হয়েছে; কিন্তু তাদের নিয়মবহির্ভূত ঋণ গ্রহণ বন্ধ হয়নি; বরং কঠোর আইনকানুন ব্যাংকের মালিক ও ব্যাংক ব্যবস্থাপকদের দুর্নীতির আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে। ব্যাংকমালিকদের অপকর্ম থেকে নিবৃত্ত করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃঢ় অবস্থান অপরিহার্য। 

দুর্বল ব্যাংকগুলোর সংকট কাটিয়ে তোলার নিমিত্তে আওয়ামী লীগ আমলে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন ফ্রেমওয়ার্ক’ শিরোনামে একটি সার্কুলার ইস্যু করে; এই সার্কুলারের ভাষ্য অনুযায়ী ব্যাংকগুলো ওই ফ্রেমওয়ার্ক বাস্তবায়নপূর্বক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হলে ২০২৫ সাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূত করার মতো পদক্ষেপ নিতে পারবে। পতনোন্মুখ ব্যাংককে উদ্ধার করার এই নীতি বাস্তবায়নের কথা বর্তমান গভর্নরও বলছেন। আমাদের দেশে দুর্বল ব্যাংকগুলো স্বেচ্ছায় মার্জ হবে না, মার্জ হলে মালিকদের ক্ষমতা হারানোর ভয় রয়েছে; তাই ব্যাংকের মালিকরা তাদের ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া করতে রাজি থাকলেও মার্জ করতে রাজি হবে না। ব্যাংক নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া আর মিডিয়ায় বিভ্রান্তমূলক তথ্য পরিবেশন করা এক কথা নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু থাকলে তা নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে উপশম করাই শ্রেয়। অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানও রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলোর সংটকালীন মূলধনের জোগান দিয়েছেন। দেউলিয়া থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে আমেরিকাও তাদের ব্যাংকগুলোকে এক সময় অর্থায়ন করেছে। সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশয়ের কথা জনগণকে জানিয়ে পতনোন্মুখ ব্যাংকগুলোর পতন নিশ্চিত করা সুবিবেচনা প্রসূত বলে মনে হয় না। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫