
কাজী ইকবাল
বাংলাদেশের ইতিহাসে গণঅভ্যুত্থান বিশেষ এক স্থান দখল করে আছে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ তথা গণযুদ্ধ, ১৯৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থান এবং ২০২৪ সালের জুন-জুলাই মাসে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হচ্ছে সর্বশেষ গণঅভ্যুত্থান। এই হিসাবে বলা যায় যে, ২০২৪ সালের এই অভ্যুত্থানটি বাংলাদেশের ইতিহাসে ৫ম গণঅভ্যুত্থান।
বর্তমান গণঅভ্যুত্থানটির পটভূমি খুবই সংক্ষিপ্ত। ২০১৮ সালে চাকুরিক্ষেত্রে বাংলাদেশে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সভাসমাবেশ করতে থাকে। তখনকার প্রচলিত চাকরির কোটা ব্যবস্থায় ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তান ও নাতি-পুতিদের জন্য ৩০%, জেলা কোটা ১০%, নারীদের জন্য ১০%, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫% এবং প্রতিবন্ধী ১% নিয়ে মোট ৫৬% কোটা। ফলে মেধাবীদের জন্য স্বাভাবিকভাবেই ছিল চাকরির মোট পদের ৪৬% পদ।
এই বৈষম্যের কারণেই চাকরি প্রত্যাশীরা আন্দোলনের পথ বেছে নেয়। শিক্ষাজীবন শেষ করে শিক্ষার্থীরা যখন এই বৈষম্য দেখতে পায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই হতাশ হয়; কিন্তু পরে যখন তারা উপলদ্ধি করতে পেরেছিল আন্দোলন ছাড়া এই কোটা ব্যবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয় তারা তখন সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করে। ৫৬% কোটার বদলে চাকরিতে ১০% কোটা ব্যবস্থা চালু করার দাবি করে। ২০১৮ সালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ৫ দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। ২০১৮ সালের ১৩ মার্চের মধ্যে সরকারকে তারা এই দাবিগুলো মেনে নেওয়ার আহ্বান জানালে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। এই অবস্থায় ওই বছরই ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে সব ধরনের কোটা ব্যবস্থা বাতিলের ঘোষণা দেন। পরে ঘোষণাটি সরকারি পরিপত্র প্রকাশের মধ্য দিয়ে কার্যকর হয়ে যায় এবং ছাত্ররাও তাদের সকল আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেয়।
২০১৮ সালের পর ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে একটি রিট করে ২০১৮ সালের কোটা বাতিল সংক্রান্ত সরকারি আদেশের পরিপত্রটি বাতিলের আবেদন করা হয়। এই আবেদনের পরিপেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর কোটা বাতিল সংক্রান্ত ২০১৮ সালের সরকারি পরিপত্রটি বাতিল ঘোষণা করেন। প্রশ্ন দেখা দেয়, কোটা ব্যবস্থার বিষয়ে বাংলাদেশের সংবিধানে সমাজের দুর্বলদের জন্য চাকরিতে সুযোগদানের বিষয়টি আছে। সেখানে কিন্তু কোথাও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা বা কোটা রাখার কোনো শব্দ নেই। সরকার এতদিন তাদের ক্ষমতা রক্ষার কথা বিবেচনা করে মুক্তিযোদ্ধার উত্তরসূরিদেরকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের জন্য নির্বাহী আদেশে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরসূরিদের জন্য চাকরিতে বেশি সুযোগদানের লক্ষ্যে ৩০% কোটা ব্যবস্থা চালু করে; কিন্তু ২০১৮ সালে সব ধরনের কোটা বাতিল করা হলে প্রশ্ন ওঠে, সরকার কি জেনেশুনে সরকারি সেই পরিপত্রটি আদালতে যেন বাতিল হয়ে যায় সেই ব্যবস্থাই করে রেখেছিল?
এসব প্রশ্ন যখন ওঠে তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্তব্য করেছিলেন, তিনি বিরক্ত হয়ে ওই সময় জাতীয় সংসদে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এখন ২টি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে— এক. তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তার ঘোষণার মধ্য দিয়ে সংবিধান লঙ্ঘন করেছিলেন। দুই. প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যখন শপথ নিয়েছিলেন, সেখানে উল্লেখ ছিল যে তিনি অনুরাগ ও বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোনো কাজ করবেন না। ফলে তার কোনো কাজ বিরক্ত হয়ে করার সুযোগ নেই। সে কারণে শেখ হাসিনা তার নিজের নেওয়া শপথ ভঙ্গ করার দোষে দুষ্ট।
২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট কোটা ব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত সরকারি পরিপত্রটি বাতিল ঘোষণার পর সেই আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে সরকার আপিল করতে গড়িমসি করে। সরকারের উদ্দেশ্য ছিল কোটা সংক্রান্ত বিষয়টি যেন আদালতের মাধ্যমে সমাধান হয়। কারণ নিম্ন থেকে উচ্চ— সব আদালতের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল। বিষয়টিকে আদালতের মাধ্যমে করার একটাই উদ্দেশ্য, এতে করে সরকার বলতে পারবে যে, আদালতের রায়ের ভিত্তিতে নতুন করে কোটা ব্যবস্থা চালু করাটা সরকারের দায়িত্ব। সে কারণে সরকার আন্দোলনকারীদের বারবার বলে যাচ্ছিল, আদালতের রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
২০২১ সালে হাইকোর্টের রায়ের অনেক পর মূলত আন্দোলনকারীদের চাপে সরকার সুপ্রিমকোর্টে আপিল করতে বাধ্য হয়। ২০২৪ সালের ৪ জুলাই সেই মামলার শুনানির জন্য দিন ধার্য করা হলেও সেদিন শুনানি না হয়ে ১ মাস পিছিয়ে দেওয়া হয়। আন্দোলনকারীরা সরকারের এই পদক্ষেপকে অপকৌশল হিসেবে বিবেচনা করে সেটাকে প্রতিহত করার জন্য আবার মাঠে নামে।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলন ছিল মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক; কিন্তু ২০২৪ সালে সেই আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে যায়। শুধু সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নয় বরং কলেজ, এমনকি স্কুল শিক্ষার্থীরাও এই আন্দোলনে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে। জুলাই মাসের শুরু থেকেই এই আন্দোলনে জনগণ যুক্ত হতে থাকে। এর বিবিধ কারণ রয়েছে।
শেখ হাসিনার একটানা ১৬ বছরের শাসনে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা চরম আকার ধারণ করে। দ্রব্যমূল্য লাগাম ছাড়া বৃদ্ধি, বেকারত্ব, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি, দুর্নীতি, লুটপাট, বিদেশে অর্থ পাচার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের একছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি ছাড়াও আওয়ামী লীগ ও তাদের সব অঙ্গসংগঠনের মধ্যদিয়ে জনগণের ওপর শোষণ—নির্যাতনের মাত্রা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। ২১ জুন, ২০২৪ শেখ হাসিনার ৬ দিনব্যাপী ভারত সফরে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন চুক্তি ও স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে এলে জনগণের ওপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হয়। এর মধ্যে অন্যতম, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতে উত্তর-পূর্বের সঙ্গে রেল যোগাযোগের বিষয়টি।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ব্যপকতা এবং গণবিস্ফোরণ থেকে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হওয়ার ঘটনাতে, উল্লিখিত বিষয়গুলো সামনে না আনলে এই আন্দোলনের বিস্মৃতি ব্যাপকতা এবং বিষয়কে বোঝা যাবে না।
১ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে নতুন করে আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়া হয়। সেখানে ৭ জুলাই সমগ্র বাংলাদেশে ব্লকেড নামে হরতালের ডাক দেওয়া হয়। সেইদিন আবার প্রচলিত পেনশন ব্যবস্থা উঠিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে বাংলাদেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারীরা ধর্মঘটে নামেন। এই অবস্থায় ৭ জুলাই বাংলা ব্লকেড সফল হয়। ৮ জুলাই শেখ হাসিনা ৪ দিনের সফরে চীনে যান; কিন্তু সেই সফরের ৩ দিনের মাথায় তিনি দেশে ফিরে আসেন, সেই সফর ব্যর্থ হয়েছে বলে জানা যায়। ১৫ জুলাই শেখ হাসিনা চীন সফরের ওপর সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চাকরি মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরা পাবে; না কি রাজাকারদের নাতিপুতিরা পাবে? এই বক্তব্যের পরিপেক্ষিতে সেদিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পরের দিন সারাদেশের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করতে থাকে।
প্রকৃতপক্ষে ১৯ জুলাই থেকে চলমান বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ব্যাপক আকারে জনগণের অংশগ্রহণের ফলে সমগ্র আন্দোলনটি গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ওই ৩ দিনে দুুইশর বেশি ছাত্র-জনতার মৃত্যু হলে আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এই অবস্থায় ২১ জুলাই কারফিউর মধ্যে সুপ্রিমকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ বসে চাকরির কোটা ৭ শতাংশ নির্দিষ্ট করে রায় দেন। যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৫% ক্ষুদ্র নৃগোষ্টীর জন্য ১% কোটা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
কিন্তু এতো কম সময়ে এতো বেশি মৃত্যু এবং থানায় আগুন, পুলিশের গুলিতে প্রতিদিন মৃত্যুর ঘটনা, কারফিউ প্রভৃতির পরও আন্দোলনের গতি এবং মাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই অবস্থায় শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিলে তারা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের জুলাইব্যাপী আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয় ৫ আগস্ট।
সেই দিন তারা মার্চ টু ঢাকা ডাক দেয়। সেদিনও ঢাকায় কারফিউ ছিল। কিন্তু সকাল থেকে হাজার হাজার ছাত্র জনতা কারফিউ ভেঙ্গে ঢাকার রাস্তায় নেমে আসে। গোটা ঢাকা শহর জনতার দখলে চলে যায়। এই অবস্থায় ৩ টায় শেখ হাসিনা পদত্যাগের ঘোষণা প্রচারিত হলে সারাদেশের মানুষ আনন্দে মেতে ওঠে। উল্লেখ্য যে, শেখ হাসিনা শুধু পদত্যাগ করেননি, দেশে ছেড়ে পালিয়ে যেতেও বাধ্য হন।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য। প্রথমত. এই গণঅভ্যুত্থানের প্রচলিত ছাত্র সংগঠন কোনো জোটের নেতৃত্বে হয়নি। কোনো রাজনৈতিক দলও এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিল না। অবশ্য বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দল এই আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন দিয়েছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের মধ্যে শতাধিক সমন্বয়ক সমগ্র আন্দোলনকে পরিচালনা করেছিল। তাদের দফার মধ্যে শুধু কোটা সংস্কারের বিষয়টি ছিল; কিন্তু এক পর্যায়ে সেটি সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে রূপ নেয়।
দ্বিতীয়ত. এই আন্দোলনে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এতো বেশি সংখ্যায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আর নেই। এ ছাড়াও শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরাও ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন। একটা পর্যায়ে হাসিনা সরকারের পতনের এক দফা আন্দোলন শুরু হলে সেখানে সাধারণ মানুষও অংশ নেয়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে হেলিকপ্টারের সাহায্যে গুলি করার ঘটনা এবারই প্রথম ঘটেছে। এ ছাড়া এই প্রথম জনগণ ৪০০ এর অধিক থানা আক্রমণ ও আগুন লাগায় এবং পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করে। হাসিনার আমলে সরকার পুলিশের মাধ্যমে ব্যাপক আকারে জনগণকে হত্যা, নির্যাতন, গুম ইত্যাদি করেছিল। সে কারণে একদিকে পুলিশের প্রতি যেমন তৎকালিন ক্ষমতাসীন সরকারের আস্থা ছিল, পাশাপাশি তাদের প্রতি জনগণের ছিল চরম ক্ষোভ। পুলিশের ওপর এই মাত্রায় জনগণের আক্রমণআগে কখনও দেখা যায়নি। এসব বৈশিষ্ট্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে বা যারাই বাংলাদেশে পরবর্তীতে ক্ষমতায় থাকুক না কেন, এর থেকে যদি শিক্ষা না নেয়, তা হলে তাদেরও যে একই পরিণতি হবে— সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।