
গত ১০ অক্টোবর ২০২৪ সন্ধ্যায় ফেসবুকে মোবাইলে ধারণ করা প্রায় এক মিনিটের একটি ভিডিওর কিছু অংশ ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দেখা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরীর জেএম সেন হল মাঠের দুর্গাপূজা মণ্ডপে ছয়জন যুবক ‘ইসলাম ধর্মের মাহাত্ম্য’ প্রকাশ করে- এমন একটি গান গাইছেন। ভিডিওটিতে দেখা যায়, কোনো বাদ্যযন্ত্র ছাড়া মাইক হাতে নিয়ে ওই ছয় যুবক পূজার মঞ্চে গান গাইছেন। পূজামণ্ডপটি চট্টগ্রাম শহরের রহমতগঞ্জ এলাকায়। চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন কমিটি এই পূজার আয়োজন করে বলে এটিকেই চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় পূজামণ্ডপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ভিডিওতে গানের যে কয়েকটি লাইন শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল সেগুলো ছিল ‘এসো সেই ইসলাম বুঝি, সত্য ন্যায়ের পথ খুঁজি, বিশ্ব মানুষের মুক্তির শেষ পথ, বিপ্লব ইসলামী বিপ্লব’ মর্মে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। পূজা কমিটির সভাপতি আশীষ ভট্টাচার্য বিবিসি বাংলাকে জানান, পূজা মণ্ডপে যে ইসলামি গান গাওয়া হবে, সে বিষয়ে কমিটির সদস্যরা আগে থেকে কিছু জানতেন না। তিনি বলেন, পূজা উদযাপন কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক সজল দত্তের অনুমতি নিয়ে ওই ছয় যুবক গান গাইতে মঞ্চে উঠেছিলেন বলে তিনি জানতে পেরেছেন। মঞ্চে ওঠার আগে ওই যুবকদের ‘চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমি’র সদস্য হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।
আবার কিছু গণমাধ্যমের খবরে বলা হয় যে, ওই যুবকরা সন্ধ্যায় উপস্থিত হয়ে সজল দত্তকে অনুরোধ করেন তাদের গান গাওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য। তবে প্রকৃতপক্ষে ঠিক কী ঘটেছিল, তা নিশ্চিতভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। এই ঘটনার জের ধরে রাতে জেএম সেন হলের পূজামণ্ডপে বিক্ষোভ করে কয়েকশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। সে সময় সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র্যাবের সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম বৃহস্পতিবার রাতেই জেএম সেন হলের পূজামণ্ডপে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দেন।
সে সময় তিনি এই ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং পরবর্তী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দোষীদের আইনের আওতায় আনার ঘোষণা দেন। শুক্রবার দুপুরের মধ্যেই পুলিশ জানায়, যে ছয়জন গান পরিবেশন করেছিলেন তাদের দুজনকে আটক করা হয়েছে। আটক দুজনই স্থানীয় একটি মাদ্রাসার শিক্ষক। যাদের আটক করা হয়েছে তাদের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে কি না বা তারা ‘অসৎ উদ্দেশ্যে’ এই কাজ করেছিলেন কি না তা জানতে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
অন্যদিকে মাত্র এক মাস আগে ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ইসলামের নবীকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে কটূক্তি করে স্ট্যাটাস দেওয়ার অভিযোগে খুলনার সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকায় উৎসব মণ্ডল নামের এক ব্যক্তি গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। গণপিটুনিতে গুরুতর আহত ওই কিশোর মারা গেছে বলে শুরুতে বলা হলেও, আইএসপিআর থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে সে জীবিত আছে। আইএসপিআর আরও জানিয়েছে, আহত ব্যক্তির বয়স ২২ বছর। পুলিশের তরফ থেকে আগে জানানো হয়েছিল যে তার বয়স ১৫ বছর। এদিকে ফেসবুক স্ট্যাটাসে ঠিক কী লেখা হয়েছিল সে বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি।
ধর্মীয় অনুভূতি সব ধর্মের মানুষেরই সমান হওয়ার কথা। যে কারণে উৎসব মণ্ডল গণপিটুনির শিকার হলেন অনুরূপ কারণে মণ্ডপে ইচ্ছাকৃতভাবে সাম্প্রদায়িক গান গাওয়ার জন্য আটক ব্যক্তিদের কিন্তু গণপিটুনি দেওয়া হয়নি। এমনকি নাজেহাল বা হেনস্তার শিকারও তারা হননি। সভ্য দেশে গণপিটুনি কাম্য নয়। কিন্তু সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সঠিক তথ্য প্রকাশ জরুরি। তদন্তের স্বার্থে তাদের রিমান্ড মঞ্জুর না করা প্রকৃতার্থে দুর্ভাগ্যজনক। এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের আইনগত দায়দায়িত্ব রয়েছে, যা ভুলে যাওয়া সমীচীন হবে না। তাদের দায়িত্ব হবে বিজ্ঞ পিপির সঙ্গে আলোচনা করে পুনরায় রিমান্ডের আবেদন পেশ করার ব্যাপারে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া। আইন মন্ত্রণালয় ও বিজ্ঞ দায়রা জজ, চট্টগ্রাম বিষয়টিতে নজরদারি অব্যাহত রাখবেন এটা সবার আইনানুগ প্রত্যাশা। একই সঙ্গে মানবাধিকার কমিশন এ ক্ষেত্রে মনিটরিং ও কার্যকর ভূমিকা রাখবে এটিও কাঙ্ক্ষিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত সাম্প্রতিককালে বিচার বহির্ভূত দুটি হত্যা মানুষকে ব্যথিত করেছে। বিচার কার্যক্রম তথা আইন প্রয়োগকারীদের ওপর আস্থাহীনতা এর অন্যতম কারণ হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। উৎসব মজুমদার এবং জেএম সেন হল পূজা মণ্ডপে উসকানিমূলক গান পরিবেশনকারী সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে বিচারের সম্মুখীন করার বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে রিমান্ড নামঞ্জুর করে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করার প্রচেষ্টা হবে বেদনাদায়ক ও অনাকাঙ্ক্ষিত। এটি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও জনপ্রত্যাশার প্রতিকূল কাজ হবে।
সংসদ বাংলাদেশসহ বাংলাদেশ টেলিভিশনের ৩টি চ্যানেল প্রতিদিন অনুষ্ঠান প্রচার করে বিভিন্ন বিষয়ে। এদের উচিত ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্টকারী এসব ঘটনাসহ বিচারবহির্ভূত হত্যার অবসান কল্পে উপযুক্ত জনমত গড়ে তোলা।
চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমির ফেসবুক পেজ ঘুরে দেখা যায়, সংগঠনটি মূলত মুসলমান
শিল্পী-সাহিত্যিকদের নিয়ে ইসলাম ধর্ম সম্পৃক্ত অনুষ্ঠান করে থাকে। সংগঠনের কোনো অনুষ্ঠানে হিন্দু শিল্পী সাহিত্যিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা ও উন্নয়নে তারা ইতিপূর্বে কোনো ভূমিকা রেখেছেন এমন প্রমাণ চোখে পড়ে না। এমন প্রেক্ষাপটে তারা কেন পূজা মণ্ডপে গান গাইতে গেলেন সেটি অবশ্যই উদ্ঘাটনের দাবি রাখে। সংগঠনের কাউকে না জানিয়ে সজল দত্ত কেন সাংস্কৃতিক ঐক্যের এই পূর্বসম্পর্কহীন দলকে সংগীত পরিবেশনে আমন্ত্রণ জানালেন তার রহস্য উন্মোচনের আবশ্যকতা উপেক্ষাযোগ্য নয়।
একজন ইসলাম ধর্মাবলম্বী ইসলামের জয়গান সংবলিত গান পরিবেশন করতেই পারেন। কিন্তু সেটা তারা হিন্দুদের দুর্গাপূজার মণ্ডপে কেন গাইতে গেলেন এটিই বড় জিজ্ঞাসা। অর্ধশতাব্দী আগেও যখন হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি অনেক নিবিড় ছিল তখনও পূজা মণ্ডপে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বার্থে এ ধরনের গান পরিবেশনের কথা ভাবাই যেত না।
একই কারণে উৎসব মন্ডল আসলে কী লিখেছিলেন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী থাকতে কেন তাকে বিচার বহির্ভূত শাস্তির সম্মুখীন হতে হলো তা সঠিক করে নিরূপণ করা বিধেয়। এক যাত্রায় পৃথক ফল আদালত ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আস্থা ক্ষয়ে ইন্ধন জোগাবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার যুগপৎ আন্দোলনে আমরা ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তির আনন্দ অনুভব করলেও ফ্যাসিবাদের দোসররা তাদের অপকর্ম থেকে এখনও বিচ্যুত হয়নি। তারা বিভিন্নভাবে সমাজে দ্বন্দ্ব ও অস্থিরতা সৃষ্টির বিভিন্নমুখী পাঁয়তারা চালিয়ে যাচ্ছে মর্মে অনুমিত হয়। এসব অপপ্রয়াসকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দেওয়াই শ্রেয় হবে।