Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

ছাপানো টাকায় মুদ্রাস্ফীতি

Icon

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ১৩:১১

ছাপানো টাকায় মুদ্রাস্ফীতি

জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ফ্যাসিবাদী সরকার লুটপাট করার জন্য নতুন করে ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়ার কারণে মুদ্রাস্ফীতির শিকার হয়েছে দেশের মানুষ এবং এই মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও মুদ্রাস্ফীতি এবং মূল্যস্ফীতির জন্য একে দায়ী করেছেন। ব্যাংকিং সেক্টরে তারল্য সঙ্কট এখন এত তীব্র যে, ইতোমধ্যে কয়েকটি ব্যাংক ১২ শতাংশের বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করতে বাধ্য হচ্ছে। দেশ এবং ব্যাংকিং সেক্টরে বিরাজমান অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগেও স্থবিরতা নেমে এসেছে, কয়েকটি ব্যাংক বাধ্য হয়ে সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ বেচে নিচ্ছে। শুধু ব্যাংক নয়, উচ্চ সুদে ব্যক্তি পর্যায়েও সরকারের বিল ও বন্ডে প্রচুর বিনিয়োগ হচ্ছে।  শিল্প খাতে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা এবং সুদের উচ্চ হারের কারণে শেয়ার বাজারে ধস নামছে।  

নোট বা টাকা ছাপানো বন্ধ করার জন্য আওয়ামী লীগ আমলে নামকরা অর্থনীতিবিদদের কড়া পরামর্শ ছিল।  কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক নোট ছাপিয়ে ৬০ হাজার কোটি টাকা সরকারকে দিয়েছে। সরকারের প্রয়োজনে টাকা দেওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য ফরজ। সরকার এই টাকা সংসদে অনুমোদিত বাজেটের ব্যয় নির্বাহের জন্য নিয়ে থাকে।  প্রতিটি মন্ত্রণালয় ঠিকাদারদের প্রাপ্য টাকা চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করে থাকে এবং সরকারের অ্যাকাউন্টে টাকা থাকা, না থাকা নির্বিশেষে সেই চেকের টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক পরিশোধ করে থাকে। সরকারের শতাধিক অ্যাকাউন্ট বাংলাদেশ ব্যাংকে রয়েছে, এই সকল অ্যাকাউন্ট থেকে শুধু টাকা পরিশোধ হয় না, সরকারকে জনগণের প্রদেয় করের টাকা জমাও হয়। সারাদিন যা জমা হয় তার চেয়ে বেশি পরিশোধ হয়ে গেলে তা সরকারের ঋণ, আর পরিশোধের চেয়ে জমা বেশি হলে সরকারের গৃহীত ঋণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিশোধ হয়ে যায়।  এই পদ্ধতির ঋণ নাকচ করা হলে দেশ অচল হয়ে যাবে। এই ক্ষেত্রে একটিই সমাধান এবং তা হচ্ছে ঘাটতি বাজেট পরিহার করা। সরকারের বাজেটে আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য না থাকলে শুধু মুদ্রানীতি দ্বারা সরকারকে ঋণ গ্রহণ করা থেকে বর্তমান গভর্নর বিরত রাখতে পারবেন না। 

প্রধান উপদেষ্টার কথা থেকে প্রতীয়মান হয়, বিগত সরকার যত বেশি খরচ করেছে তত বেশি দুর্নীতিও করেছে। অপরিহার্য প্রয়োজনে সরকারের ঋণ নেওয়া অপরাধ নয়, অপরাধ হচ্ছে গৃহীত ঋণের যথেচ্ছ ব্যবহার। দুর্নীতি লাগাম ছাড়া ছিল বলেই বেনজির আহমেদ, মতিউর রহমানের মতো লোকের সৃষ্টি হয়েছে, মালয়েশিয়া ও দুবাইতে বাংলাদেশিদের সেকেন্ড হোম হয়েছে, কানাডায় বেগম পাড়া গড়ে উঠেছে ইত্যাদি। দুর্নীতির এত ছড়াছড়ি থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের ওবায়দুল কাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের অমর বাণী শোনাতেন, তখন জনগণের হাসি থামাতে কষ্ট হতো।  

তবে দুর্নীতি আর অর্থ পাচার সকল আমলেই হয়েছে। দুর্নীতিবাজ আমলার নিজস্ব কোনো রাজনীতি বা আদর্শ থাকে না, তারা সব সময় সরকারকে সমর্থন করে। শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে। ভারতের নরেন্দ্র মোদি এবং পাকিস্তানের ইমরান খান নির্বাচনী প্রচারে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় এসেছিলেন। পরে ইমরান খান নিজেই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন। ২০২২ সনে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকসেকে গণ-আন্দোলনে দেশ ছেড়ে পালাতে এবং তার বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই পরিবারটি দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক দুঃশাসনের অভিযোগে অভিযুক্ত হলেও এখন আবার ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।  

তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্রে অন্ধ দলপ্রীতি রয়েছে, দলের কোনো কর্মী বা সমর্থক বিশ্বাস করে না যে তাদের শীর্ষ নেতারা দুর্নীতিবাজ। এমন অন্ধ আনুগত্যের জন্যই ফিলিপিন্সের একনায়ক ও দুর্নীতিবাজ ফার্দিনান্দ মার্কোসের ছেলে বোংবং মার্কোস এখন ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট।  অথচ দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ফার্দিনান্দ মার্কোস ও তার স্ত্রী ইমেলদা মার্কোসকে জনরোষে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছিল। ব্রিটিশ আমল থেকে আজ পর্যন্ত কোনো শাসক দুর্নীতি নির্মূল করতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে বলে মনে হয় না। লর্ড ক্লাইভ ঘুষ দিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। ব্রিটিশ আমলে এক অজ্ঞাত লেখকের ‘মিয়াজান দারোগার একরারনামা’ বইটিতে ঘুষ ও দুর্নীতির যে চিত্র আঁকা হয়েছে তা অবিস্মরণীয় এবং চিরকালের। চিরকালের বলেই আওয়ামী লীগের মাঠ ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির কর্মীরা দুর্নীতির মাঠ দখলে মেতে উঠেছে।  

মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পলিসি সুদের হার বৃদ্ধি করে ৯ শতাংশে উন্নীত করার কথা প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে উল্লেখ করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আগামী মাসগুলোতে এই নীতি সুদহার ক্রমান্বয়ে আরও বৃদ্ধি করে ১০ শতাংশ বা তারও বেশি বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন এবং এভাবে সুদহার বৃদ্ধি করে মূল্যস্ফীতিকে তিন-চার শতাংশে নামিয়ে আনার আশাবাদও ব্যক্ত করেছেন। গভর্নরের পরিকল্পনা শুনে মনে হতে পারে, সুদ হার এত বেশি বৃদ্ধি করতে হবে যাতে কেউ আর ঋণের জন্য ব্যাংকের দ্বারস্থ না হয়। সুদহার বাড়িয়ে ঋণকে ব্যয়বহুল করার নীতি ইউরোপ এবং আমেরিকায় গ্রহণ করা হলেও জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমানোর চেষ্টা করা হয়নি। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত নীতি হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করবে এবং তাদের উদ্বৃত্ত ডলার কিনে নেবে। রিজার্ভ রক্ষার অত্যধিক রক্ষণশীল নীতির কারণে আমদানি ব্যাহত হতে পারে, রক্ষণশীল নীতির কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যখন এলসি খুলতে অনীহা দেখাবে, তখন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা ডলারের জন্য ছুটে যাবে বাংলাদেশ ব্যাংকে এবং এতে দুর্নীতির নতুন খাতের উদ্বোধন হবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়লেও মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে; যত বেশি বৈদেশিক ঋণ বা রেমিট্যান্স রিজার্ভে জমা হবে, তত বেশি মুদ্রাস্ফীতি হবে।  

প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে উল্লেখ করেছেন, মূল্যস্ফীতি থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে সুলভ মূল্যে প্রান্তিক মানুষের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ চলমান রাখা হয়েছে। এই সকল কর্মসূচি ‘ফ্যাসিবাদী’ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই চালু করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের গরিবদের বাঁচিয়ে রেখে মূল্যস্ফীতি কমানোর এই কর্মসূচি অন্তর্বর্তী সরকার হুবহু রেখে দিয়েছে। এই খাতে আওয়ামী লীগ সরকার ১ লক্ষ কোটি টাকা ভর্তুকি দিত। ড. ইউনূস যত কথাই বলুন না কেন, অন্তর্বর্তী সরকারকেও ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে, ভর্তুকি পরিহার করলেই জনপ্রিয়তা কমে যাবে।  

সুদহার বাড়ানোর প্রধান উদ্দেশ্য ঋণের জোগান হ্রাস করা। কিন্তু অর্থনীতির পথ কখনো সরল রৈখিক নীতিতে চলে না, প্রতিটি নীতি-পদ্ধতির ভালো-মন্দ দুটি দিক রয়েছে। তাই সুদ হার অতিরিক্ত বৃদ্ধি করে বিনিয়োগ ও ক্রয়ক্ষমতা সংকুচিত করা হলে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও কর্মসংস্থানও সংকুচিত হবে। এতে কর্মহীন লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, শিল্পায়নে স্থবিরতা নামবে, উৎপাদন কমবে, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ভেস্তে যাবে। সুদহার বাড়লে ব্যবসায়ীর মূলধন খরচ বেড়ে যাবে, জিনিসপত্রের দামও বাড়বে।  ব্যাংকে স্বস্তি ফিরে আসার যে গল্প শোনানো হচ্ছে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের অবিবেচনা প্রসূত ঘোষণায় নষ্ট হচ্ছে। ব্যাংকের দেউলিয়ার সংবাদ যখন বাংলাদেশ থেকে প্রচার করা হয় তখন ব্যাংকের প্রতি আমানতকারীদের আস্থা ও বিশ্বাস অটুট রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।  

বাজেট কাটছাঁটের কথা উচ্চারণ করেছেন অর্থ উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টাও। তা সত্ত্বেও অন্তর্বর্তী সরকারকে আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাংক এবং জাইকা থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। দেশকে আওয়ামী লীগ সরকার ঋণে ডুবিয়ে দিয়ে গেছে বলে আগে অনেক কথা হয়েছে, কিন্তু বর্তমান সরকারের ঋণ গ্রহণের বিরুদ্ধে কোনো অর্থনীতিবিদ বক্তব্য দিয়েছেন বলে শোনা যায়নি। আসলে এটা মানতেই হবে যে, সহজ শর্ত ও স্বল্প সুদে ঋণ লাগবেই, বৈদেশিক ঋণ এখনও মাত্রাতিরিক্ত হয়নি, জিডিপির তুলনায় এখনও সহনীয় মাত্রায় আছে; বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদের অভিমতও তাই। 

মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতির প্রধান কারণ সরকারের অতিরিক্ত ঘাটতি বাজেট এবং সীমিত রাজস্ব আদায়। জিডিপির অনুপাতে সরকারের রাজস্ব আহরণ মাত্র ৮ শতাংশ, তা আরও বৃদ্ধি করা সম্ভব না হলে সরকারের ঋণনির্ভরতা ও মূল্যস্ফীতি জোর করে কমানো যাবে না। জিনিসপত্রের দাম কম রাখার অভিপ্রায়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছুর পণ্যের আমদানি শুল্ক বর্তমান সরকার রহিত করেছে; কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি বেনিফিট পেতে হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দুর্নীতি হ্রাস করা জরুরি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব হলেই কেবল দেশ ও জাতি মূল্যস্ফীতি থেকে রক্ষা পাবে। 



Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫