
সাধারণত সমাজে মানুষের চাহিদা ও চাহিদা পূরণের উপাদানসমূহের অপ্রতুলতা থেকে বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য সৃষ্টিলাভ করে। কিন্তু বৈষম্য সৃষ্টির পেছনে এটি একটি সুকৌশল ও পরিকল্পিত যুক্তি মাত্র। বস্তুত পৃথিবীর বৈষম্যমূলক সমাজসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এর জন্য দায়ী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের লোভ-লালসা ও অন্যকে ঠকিয়ে নিজেদের উদর পূর্ণ করার মানসিকতা। সামাজিক স্তরবিন্যাসের উচ্চস্তরে অবস্থানকারী ও এদের আশীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমেই এসব ঘটনা ঘটে থাকে।
আদি থেকে বর্তমান- মানুষ সর্বদাই ব্যক্তিগত ও দলগতভাবে আপন অবস্থান পরিবর্তন করে সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টায় মনোযোগী থেকেছে। তবে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মানুষের এহেন প্রচেষ্টা সর্বদা কণ্টকমুক্ত ছিল না; নানা রকমের বাধা এসে মানুষের সামনে হাজির হয়েছে। এসব বাধার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, ‘পরধন লোভে মত্ত’ নির্লজ্জ স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি-গোষ্ঠীর কবলে পড়ে অপরাপর ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বাধীন সত্তার অকার্যকারিতা; বর্ণগত, লিঙ্গগত, অঞ্চলগত ও উপগোষ্ঠীগত সাম্প্রদায়িকতা; উৎপাদনযন্ত্রের মালিকানা ও অমালিকানাভিত্তিক শোষণ প্রভৃতি। বর্তমানে দৃশ্যত এসব অভিসন্ধিমূলক চেতনা অনেকাংশে দৃশ্যমান নেই, কিন্তু সময়ে সময়ে এগুলো প্রেতাত্মার মতো নানা রূপ ধারণ করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আইনের উপস্থিতিও প্রচুর। কিন্তু যেহেতু বিষয়টি মূলগতভাবে মনস্তাত্ত্বিক, তাই আইনের ব্যবহার বা প্রয়োগ মানুষকে সম্পূর্ণ সুরক্ষা প্রদান করতে পারে না- এর জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হিসেবে বাংলাদেশের নানা ক্ষেত্রে আইনের প্রণয়ন, প্রয়োগ ও ফলাফলের কথা উল্লেখ করা যায়। উল্লেখ করা যায় স্বঘোষিত বিশ্বনেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথাও।
বর্বর যুগের কথা না হয় বাদই দিলাম, আধুনিক সভ্য জগতেও পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী আক্রমণের শিকার হচ্ছে, প্রাণভয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে দেশ-দেশান্তরে; জানমালের নিরাপত্তাহীনতায় ধুঁকে ধুঁকে মরছে; কতজন নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে সম্পদ ও সম্ভ্রম রক্ষার তাগিদে; কথা বলা বা প্রতিবাদ করার সুযোগ পর্যন্ত পাচ্ছে না।
তবে একই সঙ্গে বিবেকের প্রয়াসও ক্রিয়াশীল রয়েছে। সাম্প্রতিক কালের বেশ কয়েক দশক ধরে দেশে দেশে স্বনির্ভরতা আন্দোলন বা আত্ম-উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার নানাবিধ উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়। এহেন উদ্যোগ থেকে অবশ্য বিভিন্ন জাতি বেশ সুফল পেয়েছে, অনেকে আসলেই নিজের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে শক্তভাবে, অন্যান্য অনেকের জন্য অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে কেউ কেউ। আমাদের এশিয়া মহাদেশের কিছু দেশ এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যারা এক সময় নিজেদেরকে রক্ষা করার উপায় অনুসন্ধানের জন্য অন্যের দ্বারে ঠক ঠক করেছে, তারা আজ নানা ক্ষেত্রে রীতিমতো দাতার আসনে বসেছে ।
তবে এর একটি ভয়াবহ অথচ উজ্জীবনাময় পটভূমি রয়েছে। তা হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ বিশ্বযুদ্ধের সীমাহীন রক্তপাত বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মানসলোককে গভীরভাবে আলোড়িত ও আন্দোলিত করে। ঠিক যেন অশোকের মতো; সম্রাট অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের রক্তস্নাত ও শোচনীয় পরিণাম পরিদৃষ্ট হয়ে জীবনে আর যুদ্ধ করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যা হোক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ভয়াবহতা দুটি বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে :
বিশ্ব নেতৃবৃন্দের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং জাতিসংঘেরই প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বিশ্বের প্রায় সকল রাষ্ট্রের সমর্থনসূচক স্বাক্ষর প্রদানের মধ্য দিয়ে ‘মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র’ আত্মপ্রকাশ করে, যা সদস্য রাষ্ট্র বা জাতিসমূহকে আত্মসমীক্ষা ও দায়বদ্ধতার আওতায় নিয়ে আসে।
যুদ্ধ নয় শান্তি- এই মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো স্ব স্ব জাতীয় উন্নয়নে গভীরভাবে মনোনিবেশ করে, যাতে স্বনির্ভরতার বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারে। প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল এশিয়ার দেশ জাপানের মাধ্যমে; আর জাপানের প্রেরণাদাতা ছিলেন বাংলার কৃতী সন্তান আইনবিদ ড. রাধাবিনোদ পাল।
এই দ্বিবিধ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে গোটা বিশ্বে শুরু হয় নবতর চিন্তা-ভাবনা। প্রথমোক্তটিতে অধিক মনোযোগ প্রদান করে সেসব রাষ্ট্র, যারা সমরশক্তি, অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে ততটা মজবুত নয়। আর দ্বিতীয়োক্তটিতে অধিক মনোযোগ প্রদান করে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো, কেননা যুদ্ধে সার্বিক ক্ষতির হিসেব কষলে এর সিংহভাগ তাদের দিকেই যায়। অধিকন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলস্বরূপ সুদীর্ঘকাল থেকে চলে আসা উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ধারা অনেকটা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ায় সমরবাজ রাষ্ট্রগুলো তাদের ভবিষ্যৎ শক্তিমত্তার ধারাবাহিকতা নিয়ে প্রবল চাপ অনুভব করতে থাকে। এত দিন অনগ্রসর জাতি বা রাষ্ট্রগুলোকে শোষণের ফলে বিনা পুঁজিতে যে উপার্জন, তা অনেকটা রুদ্ধ হয়ে পড়ে। শুরু হয় স্বকীয় সম্পদ বা উপাদান এবং যুক্তি-বুদ্ধি খাটিয়ে কীভাবে জাতীয় উন্নয়নের ধারাকে গতিশীল রাখা যায়, এমন এক অভূতপূর্ব ও আধুনিক চিন্তাচেতনা। একই কারণে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জাতিগুলোতে আসে উন্নয়নের এক বিপুল প্রেরণা। জাতীয়তাবোধ ও স্বকীয় প্রশাসনের আওতায় জনমনে সৃষ্টি হয় নবতর আশা-আকাঙ্ক্ষা। পুঁজিবাদী সমাজতন্ত্রী সর্বত্রই জাতীয় উন্নয়নের বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়।
অধ্যাপক মো. আনিসুর রহমান মনে করেন, স্বনির্ভরতা হলো মানসিক ও পার্থিব স্থিতিশক্তির এমন এক মিশ্রণ, যার দ্বারা বহিঃশক্তির কর্তৃত্বকে প্রতিহত করা যায়, এটি নিছক স্বয়ংসম্পূর্ণতা নয়। তিনি চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন যে, স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে দেশে যখন দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল, তখন সবচেয়ে দুস্থ এলাকা রংপুরের কিছু জনগোষ্ঠী আমেরিকা থেকে আসা ও সরকারের দেওয়া ত্রাণসামগ্রী গ্রহণে
অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে সংঘটিত নির্মম রক্তপাতকে আমেরিকা সমর্থন করেছিল, তাই আত্মসম্মানে বলীয়ান এই লোকজন এহেন সাহায্যকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। তাই বলা যায়, স্বনির্ভরতা হলো একটি সামগ্রিক প্রত্যয়, যেখানে বাকি পদগুলো অর্থনীতির গণ্ডিতে আটকা পড়ে গেছে।
স্বনির্ভরতা অর্জন বা প্রতিষ্ঠাকে তিনটি স্তরে বিন্যস্ত করা যেতে পারে; যথা- ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও জাতি। প্রথমত একজন ব্যক্তি তার পরিবারের জন্য নিজ উদ্যোগে স্বনির্ভরতা অর্জনের চেষ্টা করতে পারে। ব্যক্তি যখন তার স্বনির্ভরতা অর্জনে বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তখন সে গোষ্ঠীর দ্বারস্থ হয়। গোষ্ঠীর সম্মিলিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দ্বারা অনেক কিছু সম্ভব হলেও অনেক কিছু বাকি থেকে যায়। তখন গোষ্ঠী দ্বারস্থ হয় জাতি বা রাষ্ট্রের। জাতি বা রাষ্ট্র তার সকল নাগরিকের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু আইন বা বিধি-বিধান চূড়ান্ত করে রেখেছে, যেখানে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সকল ধরনের অধিকার সুরক্ষার নিশ্চয়তা রয়েছে। সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্র এর সকল জনগণকে স্বনির্ভর করে তোলার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখে। যখন একটি রাষ্ট্রের প্রতিটি পরিবার স্বনির্ভর হয়ে ওঠে, তখন সকল ক্ষেত্রেই আসে একটি স্বাচ্ছন্দ্য ও আত্মতৃপ্তির পরিবেশ, যা জাতিকে উন্নয়নের শিখরে আরোহণ করার মসৃণ পথ তৈরি করে দেয়। এভাবে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও জাতি একযোগে তৎপর হলে সকলের অধিকার পূর্ণাঙ্গভাবে নিশ্চিত করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে।
একই সূত্র অবলম্বন করে আন্তর্জাতিকভাবেও অনুরূপ ব্যবস্থা অনুসরণ করা যেতে পারে। তবে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক যা-ই হোক, উদ্দেশ্যে উপনীত হওয়ার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন একটি সর্বজনীন মনো-সামাজিক ক্ষেত্র প্রস্তুত করা, যেখানে মানবকুলের সকল সদস্যের একটি অভিন্ন পরিচয় বিধিবদ্ধ থাকবে। সাম্যবাদের অনন্য পুরোধা ব্যক্তিত্ব আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুলের সমাজ মননে শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সকল মানুষের মর্যাদার অবস্থান কেমন ছিল, তা উল্লেখ করেই লেখাটির সমাপনী টানতে চাই : একের অসম্মান নিখিল মানবজাতির লজ্জা- সকলের অপমান।