
দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে মজার বিষয় হলো কেউ সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতে চায় না কিংবা পারে না। ক্ষমতার বাইরে থাকলে যাকে কালো বলে মাঠ গরম করা হয়েছে, ক্ষমতায় গেলে সে বিষয়গুলোই কীভাবে যেন সাদা হয়ে যায়। দেশে বেশ কয়েকটি কালাকানুন আছে যার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে বছরের পর বছর বিরূপ প্রভাব ভোগ করার পরও ভুক্তভোগীরা এই কালাকানুনের নাগপাশ থেকে আগামীতে মুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টা করার চাইতে নিজেরা আরও প্রবলভাবে এই আইন প্রয়োগে ব্রতী হয়ে পড়ে। সত্যি বলতে কেউই আসলে অতীতকে সামনে রেখে বর্তমানকে সাজাতে চায় না। সবাই নিজেদের পুরো সামর্থ্য দিয়ে বর্তমানকে ভোগ করতে ব্যস্ত থাকতে চায়। এখন কোটি টাকার প্রশ্ন হলো, ছাত্র-জনতার আন্দোলন দেশ ও জাতির সামনে যে সুযোগ সৃষ্টি করেছে তাতে কি আমাদের রাজনীতি সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলার মানসিকতা লাভ করবে?
দেশের ইতিহাস কিন্তু তা বলে না। ইমডেমনিটি নিয়ে হয়তো অনেকেই কথা বলেন; কিন্তু তা থেকে বের হওয়ার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চায় না কেউই। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধের ইনডেমনিটি রহিত করে দেশে তার বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হলেও তার তৈরি করা রক্ষীবাহিনীকে দেওয়া ইনডেমনিটি রহিত করা হয়নি। বরং নতুন করে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে ইনডেমনিটির আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। ২০০৯ সালে ১৪ দলীয় জোট সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাতাদের দায়মুক্তি দেয়। এ দায়মুক্তির আওতায় অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো কুইক রেন্টাল ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্প। অপারেশন ক্লিনহার্ট এবং এরশাদ সরকারের জারিকৃত অধ্যাদেশের ইনডেমনিটিও বহাল আছে। আসলে একটা ইনডেমনিটি বাতিল করেই সারা দেশের ইথার গরম করে ফেলা হয়েছে। কিন্তু শাসনকালে নিজেদের করা কালাকানুন বাতিলের কথা কারও মনেই পড়েনি। সেখানে অন্যদের শাসনামলে প্রবর্তিত কালাকানুনগুলোর কথা মনে থাকার প্রশ্নই আসে না। কারণ এগুলোকে তো নিজের সপক্ষে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক ২০২৪ সালে ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত তরুণদের কর্মকাণ্ডকে এক ধরনের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এই ইনডেমনিটি নিয়ে কথা বলার কোনো সুযোগ এসেছে কিনা জানি না। তবে সময় ও পরিবেশ বিবেচনায় এখনই কিছু বলা হয়তো ঠিক হবে না।
দেশের বিদ্বেষপূর্ণ রাজনীতি আজও প্রতিশোধ আর প্রতিহিংসায় পরিপূর্ণ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতায় খুব হিংস্রভাবে সে প্রতিশোধ আর প্রতিহিংসায় লিপ্ত হয়ে পড়া মানুষদের আচরণে প্রকাশ পেয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলার পরও কিছু মানুষ আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে। সরকারের নীতি-কথায় যে কাজ হবে, তা সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে না। এ পরিস্থিতিতে প্রয়োজন কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ। এটাই এখন দেশের সবচাইতে কঠিন কাজ। কিন্তু দেশে আইনরক্ষার কাজে জনগণের যে সেবকরা নিয়োজিত তারা এখনো এমনভাবে রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্ত হয়ে রয়েছেন যে, তারা নিজের চাকরি-বিধি মানার চাইতে দলের নির্দেশ পালনে শতভাগ নিবেদিত আছে বলে প্রতীয়মান হয়।
এই জনগণের সেবকরাই এক সময়ে ‘জনতার মঞ্চ’ করে পুরস্কৃত হয়ে মনে প্রাণে দলীয় আনুগত্য প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছিল। ব্যক্তির রাজনৈতিক দর্শন স্বাভাবিক হলেও তা সেবকদের জন্য কতটা প্রযোজ্য বর্তমান বাস্তবতায় সেটা নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি। বলাই যায় দলীয় দর্শন ধারণ করে পেশাজীবীরা বিভক্ত হওয়ার ফলেই দেশের আইনের শাসন ভেঙে পড়েছে। ফলত এক মতাদর্শের ব্যক্তিদের সরিয়ে অন্য দলীয় মতাদর্শের ব্যক্তিদের বসিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সফল হলো কিনা বা মেধার মূল্যায়ন হবে কিনা তা বিবেচনার দাবি রাখে। দোষীদের দেশের আইনে বিচার করে কঠোর থেকে কঠোরতর শাস্তি দেওয়া হলে সে দৃষ্টান্ত দেখে সাধারণ মানুষ সেবকদের ব্যাপারে কিছুটা নিশ্চিত হতে পারে।
জনগণের সেবকরা রাজনৈতিক দলের আবেগকে কাজে লাগিয়ে এমনই ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিল যে এক যুগের বেশি সময় ধরে শিক্ষা আইন অনুমোদিত না হয়ে পড়ে রয়েছে। এক যমুনা সেতুর নির্মাণ থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণের উপযুক্ততা সৃষ্টি হয়নি, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিদেশি নির্ভরতা এক শতাংশ কমেনি। ক্ষমতাবান এবং বিত্তবানরা বিদেশ নির্ভর স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নেওয়ায় দেশের স্বাস্থ্যসেবাকে অনিশ্চিত ও অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রাখা হয়েছে। চিকিৎসার মতো প্রতিটা পেশার করুণ অবস্থার বিবরণ লেখা শুরু হলে মহাকাব্য সৃষ্টি হবে। সে তালিকা না হয় বর্ধিত নাই বা করলাম। তবে এটুকু বলা যেতেই পারে দলীয় মদদেই পেশাজীবীরা নিজের দায়দায়িত্ব পালনের কথা ভুলে রাজার অংশ হয়ে উঠেছিল। ফলে সরকারের চাইতে এই দলীয় পেশাজীবীরাই শতভাগ শক্তিতে একের পর এক কালাকানুনের অপপ্রয়োগে নিবেদিত হয়ে পড়েছিল। সাধারণ মানুষ কি বর্তমান বাস্তবতায় আশা করতে পারে পরিবর্তিত বাংলাদেশে আর কোনো কালাকানুনের অপপ্রয়োগ হবে না! বোধকরি এখনও না।
সাধারণ জনগণের ধারণা, ক্ষমতাধর মোসাহেব পেশাজীবীদের কারণেই এখনও দেশের সব কালাকানুন বহাল রাখার পরিবেশ বিরাজমান। সব স্তরের প্রশাসনকে সরকারের পক্ষ থেকে ইনডেমনিটি এমনভাবে দিয়ে দেওয়া হয়েছে যে আইনের দায়, পেশার দায়, দেশ ও জাতির দায় কোনোটাই তাদের পালন করতে হয় না। রাজনীতিও ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার ফলে তা আজ লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। আর কালাকানুন না থাকলে লাভজনক ব্যবসায় সফল হওয়া কঠিন। তাই যেটুকুই সংস্কার হোক না কেন তা দেশের বর্তমান রাজনীতি দিয়ে বাস্তবায়নের আশা করা যাবে কিনা সন্দেহ থেকে যায়। সরকার সংস্কারে উদ্যোগী হবে বলে অঙ্গীকার করেছে। কালাকানুনগুলো সংস্কারেরও ঘোষণা দিয়েছে। আবার ইনডেমনিটি ঘোষণাও করছে। এই বৈপরীত্যের পরিপ্রেক্ষিতে কিন্তু কে যে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে তা দেখার অপেক্ষায় থাকবে সাধারণ মানুষ।