Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

পরিবেশ রক্ষায় পলিথিনের বিকল্প পাট

Icon

গাজী তানজিয়া

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৫২

পরিবেশ রক্ষায় পলিথিনের বিকল্প পাট

অক্টোবর ১ থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে সুপার শপগুলোতে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্বকরণ নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। এবং পরবর্তী সময়ে সর্বত্র এর প্রয়োগ করা হবে এমনটা আশা করা যায়। 

বিএনপি শাসনামলে (২০০১-০৬) পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, যা পরবর্তী সরকারের সময়কালে বলবৎ থাকেনি। আমরা জানি যে পরিবেশ দূষণ কমানো পৃথিবীর সব দেশের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর পরিবেশ দূষণের অন্যতম এক উপাদান হলো পলিথিন। বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১০ লাখেরও বেশি এবং বছরে ৫ লাখ কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। এর মাত্র এক শতাংশ পুনরায় ব্যবহারের জন্য রিসাইক্লিং করা হয়, বাকি ১০ শতাংশ সমুদ্রে ফেলা হয়; যা বিশ্বকে ভয়াবহ এক পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন করে তুলেছে। তাই পলিথিনের ব্যবহার কমানোর জন্য উন্নত বিশ্বের দেশগুলো মরিয়া হয়ে উঠেছে। 

বাংলাদেশেও ম্যানডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট প্রণয়ন করা হয়েছিল, পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যাবহার কমিয়ে পাটের ব্যবহার বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। যার প্রয়োগ দেখা যায়নি সেভাবে। 

পাটের বিকাশ আর বাংলার বিকাশ এক সময় একই অর্থ বহন করত। এখনও আমরা জানি বাংলাদেশের পাট বিশ্বমানের। বাংলাদেশের পাটশিল্পের অভিজ্ঞতা শতবর্ষ পুরনো। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা পাটের জিনকোড আবিষ্কারের কৃতিত্বও দেখিয়েছেন। অথচ সেই বাংলাদেশেই কেন পাট নানা বিড়ম্বনা ও লোকসানের শিকার হয়েছে? বলতে গেলে অন্য যে কোনো শিল্পের তুলনায় পাট শিল্পকে এখানে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অথচ পাটের আঁশ ব্যবহার করে পচনশীল পলিমার ব্যাগ তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানী মোবারক আহমেদ খান। পাটের তৈরি এই ব্যাগ দেখতে পলিথিন ব্যাগের মতো মনে হলেও আসলে তা অনেক বেশি টেকসই ও মজবুত। পাটের সূক্ষ্ম সেলুলোজকে প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি এই ব্যাগ কয়েক মাসের মধ্যে পচে মাটিতে মিশে যায়। যা পরিবেশ দূষণ কমাতে সহায়ক।

ইউরোপে পলিথিন শপিং ব্যাগ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ ও পাটজাত মোড়কের ব্যবহারের বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল এ দেশে। পাটজাত নানাবিধ পণ্য বাদ দিয়েও শুধু ব্যাগ উৎপাদন করে এবং দেশে বিদেশে বাজারজাত করে লোকসানের হাত থেকে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো। অথচ সেই সময়ে, শিল্প হিসেবে পাট যখন আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারত ঠিক তখন লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে বিজেএমসির অন্তর্ভুক্ত ২৬টি পাটকল বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কারণ হিসেবে যদিও বলা হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর আধুনিকায়ন ও রিমডেলিংয়ের জন্য উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে, তথাপিও এ কথার বিশ্বাসযোগ্যতা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। এ ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, দেশে বিদেশে যখন পাটের চাহিদা বেড়ে চলেছে, চামড়া শিল্পের চেয়েও যখন পাট শিল্প এগিয়ে চলেছে, তখন ঠিক ওই সময়ে কোভিড মহামারির সময়ে পাটকলগুলো বন্ধ হওয়ার কারণ কী ছিল? 

এর আগে ২০০৮ সালে ১/১১ সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ৬ জুটমিলের উৎপাদন বন্ধ করে ব্যক্তি খাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তখন পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তান, চায়না, ভিয়েতনামে অনেক নতুন নতুন জুটমিল স্থাপন করা হয়েছে। আমরা জানি বিশ্ববাজারে পাটের ৯২% চাহিদা পূরণ করে ভারত ও বাংলাদেশের পাট। পরিবেশবান্ধব, এ কারণে বিশ্ববাজারে কাঁচামাল হিসেবে বাংলাদেশের পাটের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। অথচ ভারতে জুটমিলের সংখ্যা যেখানে ৯৬টি সেখানে বাংলাদেশে একের পর এক পাটকল কেন বন্ধ হলো! যদিও এর পেছনে লোকসানের অজুহাত দেখানো হয়েছে। তবে পাটকলগুলোর লোকসানের পেছনে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, আধুনিকায়নে গাফিলতি, বাজারজাতকরণে উদ্যোগের অভাব ইত্যাদি কারণ অনেক দিন থেকেই বিরাজমান ছিল। যে কারণে বিজেএমসির অবদান উৎপাদনের ৮ দশমিক ২১ শতাংশে নেমে গিয়েছিল। রপ্তানিতে এ হার কমে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ হয়েছে। এজন্য নানা সময়ে শ্রমিক হয়রানি এবং বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। 

কিন্তু একটা রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের সংকটগুলোকে মোকাবিলার চেষ্টা না করে অর্থনৈতিক সংকটকালে অযৌক্তিকভাবে পাটকলগুলো বন্ধ করে দেওয়া ছিল দেশবিরোধী পদক্ষেপ। অথচ একটু আন্তরিক হলে, শ্রমিকদের দুর্দশার কথা ভাবলে এগুলোকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো। এমনিতেই এ দেশের বেসরকারি শিল্পকারখানাগুলো নানাভাবে শ্রমিক ঠকানোর পাঁয়তারা করে থাকে। সরকারি পাটকলগুলোতে যেখানে একজন শ্রমিক বেতন পান ৮ হাজার ৭০০ টাকা, সেখানে বেসরকারি পাটকলগুলোতে একজন অস্থায়ী শ্রমিক মাসিক মজুরি পান মাত্র ২ হাজার ৭০০ টাকা। 

আর তাই শ্রমিক কর্মচারী পরিষদ কীভাবে প্রযুক্তিগত নবায়নের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করে পাটকলের লোকসান কমানো যায়, তার একটি প্রস্তাব শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কাছে পেশ করেছিল। তারা এও প্রস্তাব করেছিল যে, এই নবায়নের সময় পাটকল চার মাস বন্ধ রাখা অবস্থায় তারা বেতন অর্ধেক নিতে প্রস্তুত। সেই হিসাবে ১০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেই এই পাটকলগুলোকে নবায়ন করে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব ছিল। কিন্তু কার্যত তাদের কথা মানা হয়নি। বরং ১০০০ কোটি টাকা দিয়ে নবায়নের পরিবর্তে বাজেটের পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচ করে বেসরকারিকরণের জন্য প্রস্তুত ছিল ফ্যাসিস্ট সরকার। কিন্তু কেন তাদের এই আগ্রহ? কারণ খুব সহজ। যেখানে শ্রমিক শোষণের কারণে বিভিন্ন সময়ে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানায় নেওয়ার দাবি তোলা হয়, সেখানে লোকসানের ছুতোয় রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলো বিলুপ্ত করে মূলত দুর্বৃত্ত ও লুটেরাদেরই সুবিধা করে দেওয়ার জন্য। আর ছিল দুরভিসন্ধি। পাটকলগুলো অর্থনৈতিক মন্দার ছুতো ধরে আর যদি কখনও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা না যায়, তাহলে পাটশিল্প, পাট উৎপাদন তথা পাটজাত পণ্যের প্রসারে প্রতিবেশী দেশকে এগিয়ে দেওয়ার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। 

তাই এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, বাংলার পাটের প্রসার ও ঐতিহ্য বহাল রাখতে প্রয়োজনে পাট উৎপাদনে ভর্তুকি দিয়ে, কৃষিজাত পণ্যকে ডেভেলপ করে উন্ডাস্ট্রিগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা। দেশে এবং দেশের বাইরে পাটের বিপুল চাহিদাকে কাজে লাগাতে হবে এবং সে জন্য প্রয়োজন হবে সব রকম অনিয়ম ও দুর্নীতিকে হটিয়ে পাটকলগুলোর টেকসই উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করা। পাটকলগুলোকে কৃত্রিম লোকসানের ভাগী করার পেছনের শক্তিকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে পাটের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনা এখনও সম্ভব। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫