Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

ফেলুদার ছোটোবেলার ঢাকা এবং কিছু প্রশ্ন

Icon

আফসান চৌধুরী

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:০৯

ফেলুদার ছোটোবেলার ঢাকা এবং কিছু প্রশ্ন

সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা কাহিনী অনেকে পড়েছে, মানে আমার প্রজন্মের মানুষ- যারা বই পড়ুয়া ডিজিটাল যুগের আগে জন্মেছে। পরের প্রজন্মের কেউ কেউ সিনেমা দেখেছে- কিন্তু বই পড়ে কিনা জানা নাই। তবে ফেলুদা এখন সিনেমার নায়ক, গল্পের নয় বেশির ভাগ মানুষের কাছে। যদিও আমাদের কাছে তিনি বইয়ের পাতা থেকে উঠে আশা মানুষ, যাকে বলে লেখক। লেখকের পুত্র ছবির দুনিয়ায় এসেছেন। অতএব ধরা গেলো এই লেখাটা বেশির ভাগ ৪০ ঊর্ধ্ব মানুষের জন্য। সে যাই হোক।

বলি ফেলুদা, ইস ফেলুদা! কিন্তু কজন তাদের মাঝে মনে রাখেন তার জন্ম, যার ১০ বছর পর্যন্ত বসবাস আমাদের এই ঢাকা শহরেই? বা একটু খোলসা করে বললে আসলে ফেলুদা ঢাকারই ছেলে!

দুই

ফেলুদা নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে, হয়। আমাদের দেশে তেমন নয়, তবে কলকাতায় বা ভারতের অনেক স্থানেই। উইকিপিডিয়াতে লেখা জীবনী অনুসারে জানা গেল, তার বাবা জয়কৃষ্ণ মিত্র ছিলেন ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক, পড়াতেন অঙ্ক আর সংস্কৃত। বেশ কঠিন সাবজেক্ট দুইটাই, কিন্তু নাম ডাক ছিল মাস্টার হিসেবে। তার পূর্বপুরুষ মুন্সীগঞ্জের সোনাদীঘি গ্রামের বাসিন্দা। মজাটা হলো তার বাবার বড় ভাই ছিলেন ময়মনসিংহ জেলার এক জমিদারের এস্টেটের ম্যানেজার । ফেলুদার জন্ম যদি ১৯৩৭/৩৮ হয় আর তিনি পিতৃহারা হন ৯ বছর বয়সে, তবে সেটা ১৯৪৬/৪৭ সালের দিকে। মানে ঠিক যখন পাকিস্তান-ইন্ডিয়া হচ্ছে। একবার কল্পনা করা যাক দেশের তখন কী অবস্থা। একই সাথে পিতৃবিয়োগ, দেশ ত্যাগ। এর পর তারা- মানে ফেলুদা ও তার মা- কলকাতায় গিয়ে এক ভাড়া বাসায় ওঠেন। শেষে ২১, রজনী সেন রোডে গিয়ে ওঠেন যেখানে থাকতেন ফেলুদার চাচা, তার সঙ্গী তপসের বাবা, যেখানে কাটলো তার বেশির ভাগ জীবন।

তিন

যারা ফেলুদা’র জীবন নিয়ে গবেষণা করেছেন তাদের কাছে এই বিষয়টা একটু অদ্ভুত লাগে- তার অতীত নিয়ে নীরবতা। ফেলুদা অসাধারণ মেধাবী, কিন্তু হঠাৎ করে যেন সবার সামনে কলকাতায় বড় হয়ে উপস্থিত। কেবল ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ বইতে পরিবার নিয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যায়, বাকি সব নীরব। এই নীরবতার মধ্যে তার মাকে নিয়ে কিছু না বলাটা সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন জাগায়।  বাঙালি ছেলে, এমনিতেই একটু মা -কাতর হয়। কিন্তু ফেলুদা নীরব, প্রায় কোনো আলাপ নাই ওনাকে নিয়ে। কেন? নাই তার ছোটবেলার কথা। বড় তো হয়েছেন ঢাকায়, তাহলে ঢাকার কথা নেই কেন? 

আমাকে বিষয়টা বেশ ভাবায়। ইদানিং সুকুমার রায়- সত্যজিতের বাবাকে নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে এটা আরো লেগেছে। পূর্ব বঙ্গের সাথে যেন জোর করে একটা দূরত্ব, যখন এতো শেকড় এখানে। কলোনিয়াল ইতিহাসের আমরা সবাই ভিকটিম, এটা কি তাই? এটা কি এক প্রচণ্ড অভিমান থেকে লেখা, যেখানে গোটা ইতিহাসই শত্রু বনে যায়, তাই ফায়ার তাকে?

চার

চিন্তা করা যাক তার মায়ের অবস্থা। স্বামী সদ্য মারা গেছেন, এক ছেলে, সে নাবালক, অমন সময় রাজনীতি ভীষণ অস্থির চারদিকে, কখনো সহিংস্র, তার মধ্যে হঠাৎ ঘর ভিটা ছেড়ে চলে যেতে হবে অন্য দেশে। চাইলে তার স্বামী কলকাতায় কাজ করতে পারতেন, কিন্তু করেননি, ঢাকাকে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ঢাকা ছেড়ে তাকে শরণার্থী হতে হলো কলকাতায়। ভাড়া বাসায় ওঠেন, কী এমন রোজগার ছিল সংসার চালাবার জন্য? দয়া দাক্ষিণ্য নিতে হয়েছিল? শেষে যখন স্বামীর ভাইয়ের বাসায় উঠলেন, সেটা কত সুখকর না জানালেও জানা। একসাথে কতগুলা কষ্ট তাকে পোহাতে হয়েছিল বোঝাই যায়। তিনি অসহায় বৃহৎ রাজনীতির কাছে, তাই করার কিছু নেই। ছেলেকে বড় করেন। কেবল কখন, কবে, কীভাবে মারা গেলেন তার উল্লেখ পাইনি ফেলুদার কথায়। 

ফেলুদাকে তার বাবা-মা নয় চাচা বড় করেছেন,  অতি ভালো মানুষ। কিন্তু কে না চায় পিতা-মাতার ছায়ায় বড় হতে?

পাঁচ

ফেলুদার গল্পে কোনো নারী চরিত্র নেই, এটা অনেকেই বলেছেন। একমাত্র যাকে পাওয়া যায় তিনি হচ্ছেন তোপসের মা বা তার চাচী। কিন্তু মা নেই কেন, নারী প্রেম তো পরের কথা। তাই ভেবেছি কী হতে পারে তার নারীসঙ্গ বাদ দেবার কারণ? তার জীবন শুধু নয়, তার মন জগতে তাদের না রেখে? কিন্তু এটা তো সম্ভব নয়। তাহলে কি এটাই ঠিক যে যার জন্য দেশ ত্যাগ? কলকাতার দেশহীন জীবন ছিল বড় কষ্টের স্মৃতি, তাই ইচ্ছা করে এড়িয়ে গেছেন তার কৈশোরে বড় হওয়া বিষয়টা। মায়ের কষ্ট দেখতে পেতেন সকল নারীর চোখে, তাই দূরে থেকেছেন? বলতে চাননি রাষ্ট্রিক রাজনীতি কীভাবে প্রভাব ফেলে সাধারণ মানুষের সাধারণ জীবনের ওপর। এটা এক ধরণের অস্বীকার, এক ধরনের মুখ সরিয়ে নেয়া সংসার, অতীত, কৈশোর, সব কিছু থেকে। কেবল একটাই বাস্তবতা, ফেলুদা। দুরন্ত, দুর্দান্ত ফেলুদা এক অতীতহীন, রহস্যভেদকারী সম্রাট? 

ছয় 

চাই আর না চাই আমাদের সাহিত্যেও ইতিহাস বসবাস করে। কেবল বলতে নয়, না বলাতেও। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫