
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের শততম দিন পার হতে চলেছে। যাদের মরণপণ উদ্যোগে এই অভ্যুত্থান সফল হলো, রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ শুরু হলো তারা কী পেলেন- প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। অনেকে মজা করে বলেন, যুবারা আলাদীনের চেরাগের ‘দৈত্য’ যে হাঁক শুনে হাজির হয়। নির্দেশমতো কাজ করে আবার ফিরে যায়; তার আবার চাওয়া-পাওয়া কী? সন্দেহ নেই এটি ভুল বিশ্লেষণ এবং তা থেকে উপনীত সমাধান।
এদিকে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, আগামী দুই বছরে সরকারি খাতে পাঁচ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। গত ১ নভেম্বর রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জাতীয় যুব দিবস ২০২৪ উদযাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। দেশের অর্থনীতির জন্য এই জনসংখ্যাগত লভ্যাংশের (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে আসিফ বলেন, মানব সম্পদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশের প্রতিনিধিত্ব করে তরুণরা। তারুণ্যকে জীবনের সেরা সময় উল্লেখ করে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মাধ্যমে চাকরিপ্রার্থী যুবকদের কর্মসংস্থানের জন্য উপযুক্ত প্রার্থী হিসেবে প্রস্তুত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
কিন্তু এই প্রক্রিয়া ছোট নয়। এটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ। তাই তাৎক্ষণিক উদ্যোগ নেওয়াও জরুরি। এ ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ অর্থ পিছিয়ে পড়া। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সময় স্বল্পতা প্রতিষ্ঠিত সত্য।
জনশুমারির তথ্য বলছে, দেশে এখন জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ। জনসংখ্যার বয়সভিত্তিক বিভাজন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ। ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সীরা ৯ শতাংশ। ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীরা মোট জনসংখ্যার ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। সাধারণত ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের তরুণ-যুব জনগোষ্ঠী ধরা হয়।
তরুণ জনগোষ্ঠী সংখ্যায় বিশাল হলেও তাদের কতটা ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ২০১৬ সালের শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য বলছে, দেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারের হার বেশি। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১০ শতাংশ। অন্যদিকে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৮ দশমিক ৭ শতাংশ।
বিবিএসের জরিপে বলা হয়েছে, বেকার জনগোষ্ঠী মূলত তারাই, যারা বিগত সাত দিন সময়ে এক ঘণ্টাও কোনো কাজ করেননি, কিন্তু কাজ করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন এবং গত ৩০ দিনে বেতন বা মজুরি অথবা মুনাফার বিনিময়ে কোনো না কোনো কাজ খুঁজেছেন।
জরিপে দেখা গেছে, দেশের যুব কর্মশক্তি আগের তুলনায় বেশি সংখ্যায় কাজের বাইরে চলে গেছে। অর্থাৎ ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। গত বছরের জুন মাস শেষে যুব কর্মশক্তির মধ্যে দুই কোটি ৭১ লাখ ২০ হাজার জন কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এক বছর পর এই সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে দুই কোটি ৫৩ লাখ ৪০ হাজারে।
যুব কর্মশক্তির মধ্যে কাজে নিয়োজিত পুরুষ ও নারী উভয়ের সংখ্যাই কমেছে। বর্তমানে এক কোটি ২৭ লাখ ৭০ হাজার তরুণ এবং এক কোটি ২৫ লাখ ৭০ হাজার তরুণী কাজে নিয়োজিত আছেন। এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে কাজে নিয়োজিত তরুণ-তরুণীদের সংখ্যা প্রায় সমান।
বেকার জনগোষ্ঠীর হিসাব দিয়ে জরিপে বলা হয়েছে, পুরুষদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা বেশি। এক বছর আগের তুলনায় গত জুনে বেকারের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৮ লাখ ৫০ হাজার, যা গত বছরের জুনে ছিল ১৬ লাখ ৭০ হাজার। নারীদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা বরং কমেছে। গত বছরের জুনে আট লাখ ৩০ হাজার নারী বেকার ছিলেন। চলতি জুনে এ সংখ্যা হয়েছে সাত লাখ ৯০ হাজার জন।
নারীদের মধ্যে বেকারত্বের হারও কমেছে। গত বছরের জুনে ৩ দশমিক ৩২ শতাংশ নারী বেকার ছিলেন। চলতি বছরের জুনে এই হার কমে হয়েছে ৩ দশমিক ২৬ শতাংশ। বিপরীতে পুরুষদের মধ্যে বেকারত্ব বেড়ে চলতি জুনে হয়েছে ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ, যা গত বছরের জুনে ছিল ৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ। গত বছরের জুনে বেকারত্বের হার ছিল ৩ দশমিক ৪১ শতাংশ।
শ্রমশক্তির বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা গত বছরের জুনে ছিল চার কোটি ৭৩ লাখ ২০ হাজার, যা চলতি বছরের জুনে এসে দাঁড়িয়েছে চার কোটি ৯৫ লাখ ১০ হাজার জনে। অর্থাৎ শ্রমশক্তির বাইরে থাকা জনগোষ্ঠী বেড়েছে। বিবিএস বলছে, যারা কর্মে নিয়োজিত নন অথবা বেকার হিসেবেও বিবেচিত নন, তারাই মূলত শ্রমশক্তির বাইরের জনগোষ্ঠী। যেমন- ছাত্র, অসুস্থ, বয়স্ক, কাজ করতে অক্ষম, অবসরপ্রাপ্ত এবং কর্মে নিয়োজিত নন বা নিয়োজিত হতে অনিচ্ছুক এমন গৃহিণীরা এর অন্তর্ভুক্ত।
অবশ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, মাধ্যমিকে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী এখনো ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে আছে। এর মধ্যে ইংরেজিতে বেশি খারাপ। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৬১ শতাংশ শিক্ষার্থীর ইংরেজিতে অবস্থা খারাপ। একই শ্রেণিতে গণিতে ৪৩ শতাংশের খারাপ বা গড়পড়তা অবস্থা।
দেশে উচ্চশিক্ষার মান নিয়েও বড় প্রশ্ন আছে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী পড়ছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক জরিপে উঠে এসেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার থাকছেন।
২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান। ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী এখনো অন্য কোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর বা কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করছেন কিংবা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ৩ শতাংশ স্ব-উদ্যোগে কিছু করছে।
যুব প্রশিক্ষণের দায়িত্ব যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের হলেও আমাদের দেশে এ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প পরিচালনা করছে অর্থ বিভাগ। যুব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হবে যত কষ্টই হোক এই দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেওয়া এবং প্রশিক্ষণকে বাজার চাহিদা অনুযায়ী বিন্যাস করা। শুধু তা-ই নয়, ঢাকা শহরের কেন্দ্রে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাপনা গ্রহণও জরুরি বিবেচ্য বিষয়। নারীদের চাকরির বাজারে আনার সুযোগ বাড়াতে অন্তত ৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ প্রয়োজন। এ ছাড়া অন্তত নিম্নবর্ণিত ৫টি ক্ষেত্রে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি মর্মে অনুমিত হয়।
১. অবিলম্বে যুবদের দক্ষতা উন্নয়নে পরিকল্পিত প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করা
২. যুবদের আত্ম-কর্মসংস্থানে আর্থিক ও প্রশাসনিক সহায়তার উদ্যোগ গ্রহণ
৩. যুবদের কর্মসংস্থানে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বেসরকারি খাতকে প্রণোদনা প্রদান
৪. সকল শ্রেণির সরকারি চাকরিতে নারীর জন্য ন্যূনতম ৫ শতাংশ ও পারিবারিক পেশাধারীর জন্য ন্যূনতম ৩ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ
৫. খণ্ডকালীন শিক্ষাদানের জন্য যুবদের নিয়ে সারা দেশে ‘ন্যাশনাল সার্ভিস’ চালু অভ্যুত্থানের শততম দিনটি যুবদের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠুক।