Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

মওলানা ভাসানীর ধর্ম

Icon

গাজী তানজিয়া

প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫০

মওলানা ভাসানীর ধর্ম

বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে পতিত ফ্যাসিস্ট যে ইস্যুকে উপজীব্য করে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করে যাচ্ছে তা হলো ধর্ম। পৃথিবীতে আজ-অবধি ধর্মকে কেন্দ্র করে যে উন্মত্ত তৎপরতার প্রসার ঘটেছে, তার গোড়াতে রয়েছে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির কুটিল হাত।

ধর্ম এমন এক আদিম বিশ্বাস, যে বিশ্বাসে প্ররোচিত করার কৌশল নির্ধারণ করে রাজনৈতিকভাবে পুঁজিবাজারের নীতিনির্ধারণী শাসকশ্রেণি। যার ওপর ভর করে সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের প্রসার ঘটে দিকে দিকে। এর বিপরীতে রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত কিছু ব্যক্তি বিশ্বজুড়ে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে শুধু মানুষের কল্যাণে, মজলুমের পরিত্রাণের প্রয়োজনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, নিপীড়ন, শোষণের প্রতিবাদে নিজেকে নিযুক্ত রেখেছেন সব ধরনের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও চাহিদাকে গুরুত্ব না দিয়েই। আমরা সৌভাগ্যবান যে আমাদের দেশে এমন একজন নেতা ছিলেন; মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ধর্মের মতো একটা মৌলকে তিনি কেবল ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও পালনের বিষয় করে রেখেছেন। ভক্ত অনুসারীদের কারো ওপর তা চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।

মওলানা ভাসানী যে শ্রেণি-স্বার্থে রাজনীতি করেছেন, সে ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার লেশ ও রেশ কোনোটিই থাকার অবকাশ নেই। কৃষক, শ্রমিক, ভূমিহীন, দিনমজুর, কামার, কুমার, জেলে, মাঝি, তাঁতি যাদের পক্ষে সাম্প্রদায়িক আচরণ সম্ভব নয়; বেঁচে থাকাটাই যাদের একমাত্র যুদ্ধ, ধর্ম তাদের কাছে নিতান্ত সংস্কার মাত্র। আর তাদের যিনি নেতা, তিনি তো পরীক্ষিত, ত্যাগী। তার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। আম জনতার কল্যাণে উৎসর্গীকৃত নেতৃত্বই অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির মূলমন্ত্র হওয়ার কথা। মওলানা ভাসানী ছিলেন তেমনই একজন নেতা। 

ঔপনিবেশিক আমলে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। সেসব সংগঠনের মধ্যে ছিল বিপ্লবী অনুশীলন দল, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, স্বরাজ দল এবং মুসলিম লীগ। তিনি বরাবর অসাম্প্রদায়িক সংগঠনেই থাকতে চেয়েছেন, কিন্তু একসময়ে বাধ্য হয়ে মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯৪০-এর দশকে তিনি আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। ওই সময়ে আসাম বিধানসভারও সদস্য ছিলেন তিনি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে গঠন করেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, যা পরে আওয়ামী লীগ হয়। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার প্রশ্নে আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখের সঙ্গে মতপার্থক্য হলে তিনি স্বেচ্ছায় বেরিয়ে গিয়ে গঠন করেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, সংক্ষেপে ‘ন্যাপ’।

ব্যক্তিজীবনে মওলানা ভাসানীর মুসলিম সুফি সাধক ও দার্শনিকদের প্রতি ছিল গভীর ভক্তি ও শ্রদ্ধা এবং একই সঙ্গে অমুসলমান মহাপুরুষ যেমন- চৈতন্যদেব, রামকৃষ্ণ পরমহংস, স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি ছিল অসামান্য শ্রদ্ধা। তিনি ভক্তদের সঙ্গে তাদের কথা আলোচনা করতেন।

তিনি এতটাই ধর্মকর্মে ব্রতী ছিলেন যে সাধারণ মানুষ তাকে পীর মনে করত। তবে তার মধ্যে কোনো ছুতমার্গের ব্যাপার ছিল না। তিনি নির্দ্বিধায় অমুসলিম বাড়িতে পানাহার করতেন। এ বিষয়ে আজ এই নিবন্ধে তার কিছু ব্যক্তিগত আচরণের উল্লেখ করা প্রয়োজন। ১৯৪৭ সালে তিনি একবার গিয়েছিলেন টাঙ্গাইলের জমিদার গোপেশ্বর সাহা রায়চৌধুরীর বাড়িতে। বলাবাহুল্য যে, জমিদার গোপেশ্বর রায় প্রজাবৎসল ছিলেন। তারা গরিব-দুঃখীদের সাহায্য ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করছিলেন। এর মধ্যে মাগরিবের আজান হলে তিনি গোপেশ্বর রায়চৌধুরীর কাছে নামাজের জায়গা চাইলেন। গোপেশ্বর বাবু হেসে বললেন, ‘হিন্দুবাড়িতে নামাজ পড়লে নামাজ হবে কি মওলানা সাহেব?’ মওলানা জবাব দিলেন, ‘আমরা জানি আল্লাহ সব জায়গায় বিরাজমান। তবে কি তিনি হিন্দু বাড়িতে থাকেন না?’ মওলানার জবাব শুনে জমিদার অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, ‘হুজুর আপনার মতো উদার মনের মানুষ যদি সবাই হতেন, তাহলে কেউ সাম্প্রদায়িকতার আগুনে জ্বলত না।’ 

১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হয় সীমাহীন রক্তের পথ বেয়ে। স্বাধীনতার পরও দাঙ্গা-হাঙ্গামা অব্যাহত ছিল। তা ছাড়া সে বছর ঈদ ও পূজা প্রায় কাছাকাছি সময়ে হওয়ায় নেতারা সহিংসতার আশঙ্কা করেন। যাতে দাঙ্গা না হয় সে জন্য কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের হিন্দু-মুসলমান নেতারা পূর্ব বাংলার বিভিন্ন এলাকা সফর করেছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন কংগ্রেস নেতা কিরণশংকর রায়, লীগ নেতা মওলানা ভাসানী, হাবিবুল্লাহ বাহার প্রমুখ। নেতাদের সঙ্গে একদল সাংবাদিকও থাকতেন। সেবার কলকাতা দৈনিক যুগান্তরের রিপোর্টার অমিতাভ চৌধুরী ছিলেন সে দলে। মওলানা ভাসানী তখন শান্তিপূর্ণভাবে যাতে পূজা হতে পারে সে জন্য হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ঘুরছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজন মওলানা। কিন্তু তিনি জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের সমর্থক ছিলেন না। ছিলেন বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের পক্ষে। পাকিস্তান শুধু মুসলমানের আবাসভূমি হবে- এ নীতির তিনি ছিলেন ঘোরবিরোধী। 

হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, বাঙালি, আদিবাসী সবার দেশ হবে পূর্ব বাংলা; এই ছিল তার প্রত্যয়। সে জন্য সিলেটকে পাকিস্তানভুক্ত করার জন্য তিনি হিন্দু বাঙালিদেরও ভোট দিতে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান কোনো ইসলামি রাষ্ট্র বা ধর্মরাষ্ট্র হবে না। পাকিস্তান হবে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।’ পাকিস্তান থেকে সে সময়ে দলে দলে হিন্দুরা ভারতে চলে যাচ্ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার থেকে মুসলমানরা আসছিলেন পাকিস্তানে। এই প্রবণতা তিনি রোধ করার জন্য প্রচার চালাচ্ছিলেন। পূর্ববাংলা থেকে হিন্দুদের চলে যাওয়া তার একেবারেই কাম্য ছিল না। এমতাবস্থায় তিনি রিপোর্টার অমিতাভ চৌধুরীর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘পূর্ব বাংলা থেকে হিন্দুরা চলে গেলে বাঙালি কালচারটা নষ্ট হয়ে যাবে। ’

সভ্যতার ক্রমপর্যায়ে মানুষকে নিপীড়নের অন্যতম মাধ্যম হলো ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার। রাষ্ট্রব্যবস্থার সূচনাপর্ব থেকেই দল গঠনের হাতিয়ার হিসেবে ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়গত পরিচয়কে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষিত এবং মানবিক গুণসম্পন্ন ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতা কখনো কাউকে ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য প্ররোচিত করেন না। মওলানা ভাসানী আজীবন ধর্মান্তরের বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলতেন, ‘আমার শিষ্যদের মধ্যে হিন্দু আছে, মুসলমানও আছে। আমার অনেক শিষ্যই ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য আমার কাছে এসেছে। আমি ধর্মান্তর পছন্দ করি না। অনেক মুসলমান নেতা আমাকে ধর্মান্তরের জন্য পরামর্শ দিতেন। আমি রাজি হইনি। আমি তাদের বলতাম, পৃথিবীতে কোনো ধর্ম খারাপ না। ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বারো বছরে যদি আমি চাইতাম তবে লাখ লাখ আদিবাসী ও হিন্দুকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করতে পারতাম। আসামকে পূর্ববাংলার মতোই মুসলমান মেজরিটি প্রভিন্স বানাতে পারতাম। কিন্তু জীবনে একজন হিন্দু বা অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীকে আমি এই পরামর্শ দিইনি। আমি আমার হিন্দু শিষ্যদের ঠিকমতো তাদের ধর্ম-কর্ম করার পরামর্শ দিতাম।’

মওলানা ভাসানীর মতে, ‘দুনিয়ায় মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত শোষক আর শোষিত, জালেম আর মজলুম। ’১৯৬৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূত মি. ফ্লাড সন্তোষে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার একপর্যায়ে তাকে সেইন্ট সম্বোধন করলে মওলানা বলেন, ‘আমি সেইন্ট নই। আমি শোষিতের পক্ষে এবং অত্যাচারীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করি। যে সাধুতা বা স্পিরিচুয়্যালিটি থাকলে কেউ মানুষ ছেড়ে আকাশে বিচরণ করে, সে আধ্যাত্মিকতা আমার নয়।’ 

তার শেষ দিনগুলোয় এক দিন তিনি বলেন, ‘এখানে কত বাতি জ্বলবে, কত লোক আসবে। সাবধান, কে কী বিশ্বাস করে আর করে না, জিজ্ঞেস করবে না। আরো বলেন, হাজার বছর আগে এক দরবেশ শায়ক আবুল হাসান খেরকানির মাজারে যা লেখা আছে, সেই আদর্শই এখানে পালন করবে।’ ফার্সিতে লেখা সেই বাণীর অনুবাদ তার মাজার প্রাঙ্গণে লেখা, ‘আমার দরগায় যে-ই আসবে তাকে রুটি দাও। তার বিশ্বাস-আচার কি তা জিজ্ঞেস করবে না। কারণ আমার প্রভুর কাছে যার জীবনের মূল্য আছে, তার তুলনায় আমার রুটির মূল্য অত্যন্ত নগণ্য ও তুচ্ছ।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫