Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

জিতল ট্রাম্প কিন্তু হারল কে

Icon

মযহারুল ইসলাম বাবলা

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৮

জিতল ট্রাম্প কিন্তু হারল কে

ভোট প্রদানের প্রতীকী ছবি

ডোনাল্ড ট্রাম্প ধনকুবের ব্যবসায়ী এবং অপেশাদার রাজনীতিক। যিনি রিপাবলিকান দলের ওপর চরম কর্তৃত্বে দ্বিতীয় দফায় নিজের মনোনয়ন নিশ্চিত করেছিলেন। নির্বাচনী মাঠে এবার সংযত কথাবার্তা বলেছেন। অতীতের ন্যায় হঠকারী বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন। এর আগে তাকে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল রেপিস্ট, রেসিস্ট, সেক্সিস্ট বলে।

তিনি নারীদের সম্পর্কে চরম অবমাননাকর উক্তি করেছিলেন। বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে সামনে নিয়ে এসেছেন। মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে গর্হিত বক্তব্যে তার চরম সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। আমেরিকায় বসবাসরত মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের বিতাড়ন করার পাশাপাশি ঘৃণিত  মন্তব্য ও বক্তব্য দিতেও অতীতে দ্বিধা করেননি। অথচ তিনি বিশাল ব্যবধানে জয়ী হয়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। নির্বাচনী প্রচারণায় দেওয়া বক্তব্যগুলো যদি নিতান্ত ভোটের রাজনৈতিক কৌশল হয়ে থাকে, তবে বলা যায় সে কৌশল প্রয়োগে তিনি সফল হয়েছেন। 

ট্রাম্পের দ্বিতীয় বিজয়ে অনেকেই হতাশ হয়েছেন। কিন্তু আমেরিকার যেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন না কেন তাতে দেশটির নীতির হেরফের হয় না। আমেরিকার জনগণ অর্থাৎ শ্বেতাঙ্গরা নিজেদের দেশকে বিশ্বের একক আধিপত্যবাদী আসনে দেখতে চায়। বিশ্ব আমেরিকার হুকুমে ওঠবস করবে, করজোড়ে হুকুম পালন করবে। আধিপত্যবাদী শাসকরূপে তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সে কারণেই বেছে নিয়েছে। অতীতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরেছিলেন ওই আধিপত্য বিস্তারে অক্ষম প্রমাণে। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর তেহরানস্থ মার্কিন দূতাবাসের প্রায় অর্ধশত মার্কিন নাগরিককে ইরানি ছাত্ররা জিম্মি করেছিল। জিম্মি উদ্ধারের মিশন পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে যায়। ইরানকে বশে আনতে ক্রমাগত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিল আমেরিকা। আর সে দায়ে জিমি কার্টার দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। সেই শ্বেতাঙ্গ মার্কিনি জনগণের আধিপত্যবাদী আকাঙ্ক্ষা পূরণে সক্ষম হবেন বলেই ট্রাম্পকে নির্বাচিত করেছে। ধনকুবের ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার হারলেও তৃতীয় দফা নির্বাচনে বিজয় লাভ করেছেন। 

বারাক ওবামা বর্ণবাদী আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। সেটা অবশ্যই নিজ যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তায়। তাই বলে কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্টের শাসনামলে কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকার ও সমতার সুযোগ নিশ্চিত হয়েছিল, সেটা বলার উপায় নেই। রাষ্ট্রযন্ত্র যথানিয়মে কার্যকর ছিল ও আছে। রাষ্ট্রের মৌলিক নীতির ন্যূনতম পরিবর্তনও ঘটেনি। ওবামার সাফল্যমূলক স্বাস্থ্যবিমা আইনটি প্রথমবার নির্বাচিত হওয়ার আগেই ট্রাম্প বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিল। বিশ্ব জলবায়ু নিয়ে আমেরিকার অবস্থানের কঠোর সমালোচনার পাশাপাশি ক্ষমতায় গেলে ট্রাম্প আমেরিকার বর্তমান অবস্থান থেকে সরে দাঁড়াবারও ঘোষণা দিয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সব হঠকারী-বিতর্কিত বক্তব্যকে শ্বেতাঙ্গ সংখ্যাগরিষ্ঠ আমেরিকানরা নিশ্চয় পছন্দ করেছে। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ছড়ি হাতে বিশ্ব শাসনের যোগ্য প্রেসিডেন্ট হিসেবেই বর্ণবাদী, সাম্প্রদায়িক, আধিপত্যবাদী শ্বেতাঙ্গ ভোটাররা নির্বিচারে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করেছেন। 

আমেরিকানদের পৃথক একজাতি রূপে চিহ্নিত করা যাবে না। আমেরিকার সাদা চামড়ার সংখ্যাগরিষ্ঠরা আদিতে ইউরোপীয় বিভিন্ন জাতিসত্তার এবং ইউরোপ প্রত্যাগত। এ ছাড়া দাস হিসেবে আফ্রিকা থেকে জোরপূর্বক ধরে আনা আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ এবং নগণ্যসংখ্যক আদি আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ানদের সমন্বয়ে আজকের আমেরিকা। ইউরোপীয় বিভিন্ন জাতিসত্তার শ্বেতাঙ্গরাই আমেরিকার মোট জনসমষ্টির বেশির ভাগ। আমেরিকার ১২ জন পৃথক জাতির পিতা। তারা বিভক্ত আমেরিকাকে যুক্তরাষ্ট্রীয়করণ করে এক রাষ্ট্রাধীনে এনে দেশটিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত করেছিল। তবে শত শত বছরেও তাদের জাতিগত সমস্যা রয়ে গেছে। সে কারণে শ্বেতাঙ্গরাও একজাতি হতে পারেনি। তাদের জাতি পরিচয়ে আমেরিকান বলা হয় সত্য। তবে ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকানরাই ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পেতে খোদ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম এবং যুদ্ধ পর্যন্ত করেছে। 

বর্তমান আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ মানুষেরা সকলেই আদি ইউরোপীয় অর্থাৎ কলম্বাসের সঙ্গী দাগি ঘৃণিত অপরাধীদের উত্তরসূরি। এরা আদি আমেরিকানদের নিষ্ঠুরভাবে শোষণ-হত্যায় নিজেদের হাত রাঙিয়ে ছিল। আফ্রিকা থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের জোরপূর্বক ধরে এনে দাসরূপে কৃষি, শিল্প উৎপাদনে শ্রম শোষণ করে নিজেদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করেছিল। আজকে তাদের মজবুত অর্থনীতির মূলে যুগ-যুগান্তরের দাসভিত্তিক শ্রমশোষণ, যেটি স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ান ও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের রক্তে-ঘামে তারা অর্জন করেছে। অর্জিত ও লুণ্ঠিত অর্থনৈতিক দাপটে বিশ্বজুড়ে আধিপত্য কায়েম করেছে। 

কৃষ্ণাঙ্গরা আমেরিকার পূর্ণ নাগরিক সত্য, তবে তাদের নাগরিক মর্যাদা সাদাদের অনুরূপ আগেও ছিল না। আইনে থাকলেও বাস্তবে আজও নেই। অতীতে বাসের সর্বপেছনে কৃষ্ণাঙ্গদের বসার জায়গা নির্ধারিত ছিল। তবে শ্বেতাঙ্গরা চাইলে সে আসনও কৃষ্ণাঙ্গরা ছেড়ে দিতে আইনগত বাধ্য ছিল। কালোদের নিন্মমানের পৃথক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আবাসিক এলাকা, পাবলিক টয়লেট, দোকান-ব্যাংকে পৃথক লাইন, সিনেমা হলে পৃথক বসার ব্যবস্থা। ভোট প্রদানের আইনগত অধিকার থাকলেও জোরপূর্বক সে অধিকার প্রয়োগ করতে দেওয়া হতো না। বাড়িভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রেও এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করা হতো। ১৯৬৫-তে সেলমায় কালোদের ভোটাধিকার আন্দোলনে সাদা পুলিশ নৃশংস হামলা চালায়। এই ঘটনা ‘রক্তাক্ত রবিবার’ নামে খ্যাত। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ এপ্রিল সিভিল রাইট অ্যাক্টকে প্রেসিডেন্ট জনসন আইনে পরিণত করেন। এই আইনে জন্ম, বর্ণ, গোত্র, ধর্মের বিভাজনে সকল প্রকার বৈষম্যকে অপরাধ হিসেবে ঘোষিত হয়। কিন্তু বাস্তবতা তথৈবচ। ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতেছেন। হেরেছেন কমলা হ্যারিস। খুবই সত্য কথা। কিন্তু সেটি শেষ কথা নয়। ট্রাম্পের জয়ে কি হারবে না সভ্যতা, শিষ্টাচার, ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবতা ও বিশ্বব্যবস্থা। জয়ী ট্রাম্প বিশ্বজুড়ে আধিপত্য বিস্তারে তৎপর হয়ে উঠলে বিশ্বে শান্তি-স্থিতি বিনষ্ট হবে। ইরান, ইউক্রেন, ফিলিস্তিনসহ বৃহৎ যুদ্ধের সম্ভাবনাকেও নাকচ করে দেওয়া যাবে না। আমেরিকান শ্বেতাঙ্গদের কাছে নিজের মুখরক্ষায় বেফাঁস বক্তব্যের ন্যায় বেফাঁস সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিশ্বব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়! সমূহ বিপদের ঝুঁকি তো রয়েছেই। ডোনাল্ড ট্রাম্প কী করে, গোটা বিশ্বের মনোযোগ এখন সেদিকেই।   

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫