Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

রাষ্ট্র না বোঝার কারণে যত বিপত্তি

Icon

রইসউদ্দিন আরিফ

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৫৫

রাষ্ট্র না বোঝার কারণে যত বিপত্তি

আধুনিক রাষ্ট্রের সংজ্ঞা যদি হয় স্বাধীন গণতান্ত্রিক, তাহলে দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় আমরা এখনো রাষ্ট্রের সংজ্ঞা এবং এ সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো ধারণা অর্জন করতে পারিনি। রাষ্ট্র কখন ও কীভাবে গঠন করতে হয়, সেই ধারণাও আমাদের পরিষ্কার নয়। এ জন্যই দেশ স্বাধীন হওয়ার তেপ্পান্ন বছর পরও বাংলাদেশে আমরা কোনো আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। আধুনিক রাষ্ট্র সম্পর্কে যদি কোনো পরিষ্কার ধারণাই না থাকে, তাহলে আপনি রাষ্ট্র গঠন করবেন কীভাবে? 

পরাধীন বা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের দিন গত হয়ে গেছে অনেক আগেই। বর্তমান যুগের রাষ্ট্র মানেই স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে সকল মানুষ হলো সেই রাষ্ট্রের নাগরিক। সেই রাষ্ট্রে সকল নাগরিকের অধিকার ও মর্যাদা সমান। 

এ জন্য এই রাষ্ট্রের আরেক নাম ‘নাগরিক রাষ্ট্র’। সেই রাষ্ট্রের মধ্যে নাগরিকদের জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষার পরিচয় থাকে বটে, কিন্তু নাগরিক রাষ্ট্রে সে পরিচয় গৌণ বা প্রান্তিক হয়ে যায়। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের বলে- তুমি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, বাঙালি, অবাঙালি, নৃগোষ্ঠী যা-ই হও না কেন, আমার কাছে তোমার প্রধান পরিচয়, তুমি নাগরিক। 

এই রাষ্ট্রে নাগরিকদের জাতি-ধর্ম-ভাষা-বর্ণের ভিত্তিতে কোনো অগ্রাধিকার বা বিশেষ অধিকার বিলুপ্ত হয়ে যায়-হোক না সে সংখ্যাগুরু জাতি, ধর্মাবলম্বী বা ভাষাভাষির নাগরিক। 

দুই 

এমন একটি রাষ্ট্র স্রেফে ঘোষণা দিয়ে বা ঘোষণাপত্র প্রচার করে তৈরি হয় না। স্বাধীন দেশের ঘোষণাপত্র, রাষ্ট্রের একটি প্রাথমিক ধারণা মাত্র, সেটি রাষ্ট্র নয়। রাষ্ট্র গঠন করতে হয়। রাষ্ট্র গঠন হয় গঠনতন্ত্র বা সংবিধান তৈরির মাধ্যমে। গঠনতন্ত্র তৈরির আগে কোনো রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকে না, থাকে শুধু দেশ। যেমন- বাংলাদেশ, স্বাধীন বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র আগে নয়, গঠনতন্ত্র বা সংবিধান আগে। অর্থাৎ রাষ্ট্র গঠনতন্ত্র তৈরি করে না, বরং গঠনতন্ত্র তৈরি করে রাষ্ট্র।

কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটেছে ঠিক তার উল্টোটা। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই (১৯৭২ থেকেই) এখানে প্রথমে হাজির হয়েছে রাষ্ট্র (’৭২-এর আগেই তৈরি হয়ে থাকা রাষ্ট্র), পরে সেই রাষ্ট্রের দ্বারা তৈরি হয়েছে গঠনতন্ত্র বা সংবিধান (’৭২-এর সংবিধান)। আমাদের রাষ্ট্র গঠনের এই উল্টো ব্যাপারটি বোঝার জন্য এখানে একটুখানি, পেছনের তেতো ইতিহাস ঘাঁটতে হয় (যে ইতিহাস এত দিন নিষিদ্ধ ছিল, এখন নিশ্চয়ই তা ঘাঁটা যায় এবং তা ঘাঁটা জরুরিও)। সে ইতিহাস ঘাঁটলে আগে থেকেই তৈরি হওয়া রাষ্ট্রের ‘মাহাত্ম্য’টাও আমরা বুঝতে পারব। সেই ইতিহাস এখন বলি।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়, সেটি কোনো রাষ্ট্রের সরকার হিসেবে গঠিত হয়নি। সেটি গঠিত হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুসারে ‘দেশে’র, অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার 

হিসেবে, রাষ্ট্রের সরকার হিসেবে নয়। সেই প্রবাসী সরকার রাষ্ট্রের সরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ১৬ ডিসেম্বরের অব্যবহিত পরে- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে আসার এক মাস আগে। সেটিই হলো বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্র এবং সে রাষ্ট্র কিন্তু গঠিত হয়েছিল যথাযথ নিয়ম অনুসারেই। না, সেটি কথিত মুজিবনগরে ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুসারে গঠিত হয়নি। সেই রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল একটি খুদে গঠনতন্ত্র তথা বিধিবিধান অনুসারে। সেই বিধিবিধানে লেখা হয়েছিল ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি কেমন হবে, কীভাবে চলবে; সেই রাষ্ট্রকাঠামোটি কী রকম হবে, তার প্রশাসনিক কাঠামোটি কী রকম হবে, প্রশাসন পরিচালনায় কারা কারা থাকবে- এসব বিধান। তাতে আরো লেখা হয়েছিল, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষায় কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, বাণিজ্যনীতি কী হবে, বৈদেশিক নীতি কী রকম হবে এবং তা কীভাবে পরিচালিত হবে―এসব বিধান। ১৬ ডিসেম্বরের পরপরই রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল সেসব বিধানের ওপর ভিত্তি করেই। তবে সেটি ছিল একটি অঘোষিত বিধান, যা তৈরি হয়েছিল গোপনে, ষড়যন্ত্রমূলকভাবে। 

সেই বিধান অনুসারেই ১৬ ডিসেম্বরের পরপরই গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্র, যা পরিচালিত হচ্ছিল বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত। গোপন ষড়যন্ত্রের কথাটি এখন খোলাখুলি বলি। ষড়যন্ত্রমূলক যে গোপন বিধান অনুসারে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল এবং এক মাস তার কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল, সেটি হলো ’৭১-এর অক্টোবরে দিল্লিতে বসে ভারত সরকার ও প্রবাসী সরকারের মধ্যে গোপনে স্বাক্ষরিত ‘৭ দফা সনদ’। এই সাত দফার মধ্যেই ছিল রাষ্ট্র গঠনের বিধিবিধান। বলাবাহুল্য, ওই গোপন ৭ দফা সনদের ভিত্তিতে যে রাষ্ট্রটি গঠিত হয়েছিল, সেটি ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি রাষ্ট্রবিরোধী রাষ্ট্র, যা গঠিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার আগেই। (দেখুন : হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সাক্ষাৎকার : সূত্র : মাসুদুল হক : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ‘র’ এবং সিআইএ, এবং ডা. কালিদাস বৈদ্য : বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব, পৃষ্ঠা-১৬৮)। 

আলোচনার মাঝখানে একটি বিষয় এখানে তুলে ধরা জরুরি। অতীতের ইতিহাস―বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নির্মাণে দিকনির্দেশনা প্রদান করে। রাষ্ট্র এবং আরো অনেক কিছু বোঝার জন্য অতীতের ইতিহাস ঘাঁটতে হয় এ জন্যই। কিন্তু সে ইতিহাস একপেশেভাবে অথবা আধাআধি ঘাঁটলে কোনো কিছু নির্মাণ করা যায় না। 

আবার অতীতের সব ইতিহাস শুধু প্রকাশ্যেই তৈরি হয়নি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক ইতিহাস তৈরি হয়েছে গোপন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। এ জন্য গোপন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তৈরি ইতিহাস খুঁজে বের করার প্রচেষ্টাকে ‘ষড়যন্ত্রের পেছনে দৌড়ানো’ কিংবা ‘ষড়যন্ত্র খোঁজার বাতিক’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার কোনোই অবকাশ নেই। তা হলে ইতিহাসকেই এড়িয়ে যাওয়া হয়। 

ষড়যন্ত্রকারীরা গোপনে তৈরি ইতিহাস মাটিচাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা করে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপরে বহু নির্ধারক ইতিহাস তৈরি হয়েছে গোপনে, ষড়যন্ত্রমূলকভাবে। সেই ইতিহাস খোঁজার প্রচেষ্টাকে ‘ষড়যন্ত্র খোঁজার বাতিক’ বলে কটাক্ষ করে, আমাদের দেশের একশ্রেণির পণ্ডিত বুদ্ধিজীবীরা সেই ইতিহাস ধামাচাপা দেওয়ারই চেষ্টা করেছেন, তা সচেতনভাবেই হোক কিংবা অবচেতনভাবেই হোক। গোপনে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তৈরি ইতিহাসকে মাটি খুঁড়ে টেনে বের করে প্রকাশ্যে জনসমক্ষে আনাই হলো প্রকৃত ইতিহাস ঘাঁটা। 

যাই হোক, শেখ মুজিব দেশে ফিরে আসার আগমুহূর্ত পর্যন্ত রাষ্ট্রের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল ওই ষড়যন্ত্রমূলক গোপন সনদের ভিত্তিতেই। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রশাসন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ডিপি ধরসহ অনেক ভারতীয় কর্মকর্তাদের নিয়োগ এবং দেশ পাকিস্তানের দখলদারি থেকে পুরোপুরি মুক্ত হওয়ার পরও এমনকি অস্ত্রশস্ত্রসহ ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা সদস্য ভারতে স্থানান্তরিত হওয়ার পরও বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রায় ছয় ডিভিশন ভারতীয় সেনা মোতায়েন রাখা হয়। 

তিন. 

তারপর কী হলো? শেখ মুজিব দেশে ফিরে আসার পর এসব জেনে এবং স্বচক্ষে দেখে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিনি তাজউদ্দীনের হাত থেকে রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে প্রথমেই যে কাজটি করলেন সেটি হলো রাষ্ট্রের প্রশাসন থেকে ডিপি ধরসহ ভারতীয় কর্মকর্তাদের অপসারণ করে তাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করলেন। দ্বিতীয়ত, মাত্র দেড় মাসের মাথায় বঙ্গবন্ধু জরুরি ভিত্তিতে ভারত সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ওপর অতি কৌশলে আকস্মিক চাপ প্রয়োগ করে ১৭ মার্চে দেশের ভূখণ্ড থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার করালেন। এভাবে তিনি দেশকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন করলেন।

তবে ওই মুহূর্তে অবশ্যই করণীয় ছিল, অক্টোবরে দিল্লিতে বসে তৈরি ৭ দফা গোপন সনদের ভিত্তিতে গঠিত রাষ্ট্রটি ভেঙে দেওয়া এবং সেই সঙ্গে ৭ দফা গোপন সনদ বাতিল ঘোষণা করা। তারপর অস্থায়ী অথবা অন্তর্বর্তী জাতীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে একটি সংবিধান কউন্সিল গঠন করে, নতুন করে রাষ্ট্র গঠনের জন্য সংবিধান তৈরি করা। কিন্তু শেখ মুজিব যে ঐতিহাসিক ভুলটি করলেন সেটি হলো ওই রাষ্ট্রবিরোধী রাষ্ট্রটি ভেঙে না দিয়ে, তা বহাল রেখেই ’৭২-এর সংবিধান তৈরি করলেন। এভাবে তিনি গঠনতন্ত্র বা সংবিধান তৈরির আগেই ওই রাষ্ট্রবিরোধী রাষ্ট্রের পাটাতনে দাঁড়িয়েই সংবিধান তৈরি করে উল্টো কাজটি করলেন। রাষ্ট্র গঠনের কাজে ভয়াবহ রকমের নেতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। 

তারপর আরো যে ভয়াবহ ব্যাপারটি ঘটল, সেটি হলো দিল্লিতে বসে তৈরি বিধান (৭ দফা সনদ) অনুসারে গঠিত রাষ্ট্রবিরোধী ‘রাষ্ট্রের’ মধ্যে ’৭২-এর সংবিধান ঢুকে গিয়ে যে এক কিম্ভূত রাষ্ট্রের জন্ম হলো, সেটি হলো বহু জাতি, বহু ধর্ম ও বহু ভাষার দেশে তৈরি হলো ‘বাঙালি জাতির রাষ্ট্র (বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র)। আধুনিক নাগরিক রাষ্ট্রের গোড়াটি কাটা হয়ে গেল রাষ্ট্রের জন্মলগ্নেই। আবার দারুণ বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করা গেল, ‘কাঁঠালের আমসত্ত্বে’র মতো বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের সংবিধানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। এভাবে ’৭২-এ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু হলো, রাষ্ট্র না বুঝেই। 

চার. 

তারপর ’৭৫-এ আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের প্রায় চার বছরের শাসনের পতনের পর জেনারেল জিয়ার শাসনামলের বাংলাদেশে আমরা দেখলাম, পূর্বেকার কিম্ভূত রাষ্ট্রটিকে বহাল রেখেই সংবিধানের কাটাকুটির মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তার বিপরীতে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে’র নামে প্রচ্ছন্নভাবে মুসলিম জাতীয়তাবাদের আরেক রাষ্ট্রবিধ্বংসী মহড়া। 

তারপর জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনামলে পূর্বেকার ধর্মনিরপেক্ষ, বাঙালি জাতীয়তাবাদী, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রে আরেক কিম্ভূত ‘মাল’ তৈরি হলো ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’, যার অর্থ দাঁড়ায় ‘সরকারী ইসলাম’। বিরাট বড় ‘ইসলামপ্রেমী’ এই ভণ্ড রাষ্ট্রনায়কটি কলমের এক খোঁচায় ইসলামকে বানিয়ে ফেললেন সরকারি ইসলাম। এতে দেশের বুজোর্গিয়ান আলেম সমাজ খুব খুশি হলো (হায়, নবীর ইসলামের এলেমদার সমাজ!)। বলাবাহুল্য, এরশাদের ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ দেশবাসীকে উপহার দিয়েছিল ভয়ংকর এক স্বৈরশাসন। 

এর ফলে একদিকে শেখ মুজিবের বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং জেনারেল জিয়ার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের অবস্থা হলো ‘ত্রাহী মধুসূদন’, অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা বলল, ‘ছেড়ে দে বাবা, কেঁদে বাঁচি’। এরশাদ-পরবর্তী বিএনপির শাসনামলেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল তবিয়তে থাকল। বাংলাদেশে প্রায় ৩৫টি বছর রাষ্ট্র ও সংবিধান নিয়ে এই যে ‘দুনিয়ার বাইর’ স্বেচ্ছাচারী অপকর্মগুলো ঘটল, সেটিরও একমাত্র কারণ হলো রাষ্ট্র না বোঝা। 

অবশেষে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রায় ২০ বছরের শাসনামলে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে সংবিধানের বহু কাটাছিঁড়া হয়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা শক্তভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়ে মহা জয়জয়কার হয়েছে। গণতন্ত্রের অনেক কাড়া-নাকাড়া বাজানো হয়েছে। কিন্তু সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম (সরকারি ইসলাম) ঠিক বহাল তবিয়তেই আছে। বলতেই হয়, ফ্যাসিবাদী এই শক্তিটির রাজনৈতিক ভণ্ডামি এরশাদের ভণ্ডামিকেও হার মানিয়েছে। তার পর কী হলো? 

পাঁচ. 

আজকের ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর একটি অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসীন হলো। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় বসল, আগে থেকেই বহাল থাকা সেই কিম্ভূত রাষ্ট্র ও সংবিধানের অধীনেই, যা গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার পরিপ্রেক্ষিতে স্ববিরোধী। আগে থেকেই বহাল থাকা রাষ্ট্রের অধীনে শপথ গ্রহণ করে ক্ষমতায় বসার ফলে, রাষ্ট্রগঠনের আগে সংবিধান তৈরির যে মৌলিক কর্তব্য, সেটি পালন করার সুযোগ অন্তর্বর্তী সরকারের থাকল না। এই সরকারের এখন বিদ্যমান সংবিধানের কিছু কাটাছিঁড়া করে জোড়াতালি দেওয়া ছাড়া আপাতদৃষ্টিতে আর কিছু করার সুযোগ নেই। রাষ্ট্রকাঠামোর ক্ষেত্রেও সেই একই চরিত্রের আমলাদের এদিক-সেদিক করে নিয়োগ-বদলি ছাড়া আর কিছু করার সুযোগ তাদের নেই। 

এর ফলে ২০২৪ সালে এসে ’৭২-এর ঐতিহাসিক ভুলের শুধু পুনরাবৃত্তিই ঘটল না। উপরন্তু ’৭২-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তার পূর্বেকার রাষ্ট্রবিরোধী রাষ্ট্র ভেঙে না দিলেও অন্তত তিনি একটি নতুন সংবিধান (’৭২-এর সংবিধান) দিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থা হলো, সেই রকম একটি নতুন সংবিধান দেওয়ার কোনো সুযোগ তাদের নেই। নতুন রাষ্ট্রকাঠামো তৈরিরও কোনো সুযোগ তাদের নেই। ফলে রাষ্ট্র গঠনে ৫৩ বছর ধরে হওয়া যে ভুল, সেই ভুলই থেকে গেল। অথচ এই ভুল এড়ানোর জন্য কমিউনিস্ট বিপ্লবী হওয়ার প্রয়োজন ছিল না, গণতন্ত্রী হওয়াই যথেষ্ট। ৫৩ বছর পরও ওই একই ভুলের পরিণামে আমরা আলবৎ এখনো বসবাস করছি বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের খিচুড়ির মধ্যে। 

তবে এ ক্ষেত্রে সময় এবং সুযোগ মনে হয় এখনো পুরোপুরি ফুরিয়ে যায়নি। অন্তর্বর্তী সরকার যদি জুলাই-আগস্টের বিপ্লবী চেতনাকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করতে পারে, তাহলে প্রত্যাশা করা যায় দেশ ও জনগণ হয়তো এই জগাখিচুড়ি থেকে উদ্ধার পেতে পারে। রাষ্ট্রের মূল সংকট মোচন হবে না, আরেকটি রণনৈতিক ‘নীরব’ বিপ্লব ছাড়া।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫