
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ১০০ দিন পার করেছে। দেড়শো বছর আগের বহুল আলোচিত প্যারিস কমিউনের সরকার টিকে ছিল মাত্র একাত্তর দিন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার তার চেয়ে ৩০ দিন বেশি পার করেছে। প্যারিস কমিউনের ৭১ দিন টিকে থাকার পর প্রতিবিপ্লবীদের দখলে চলে যাওয়া প্রমাণ করে না যে, প্যারিস কমিউনের সংগ্রাম ব্যর্থ ছিল। প্যারিস কমিউন আজও বিশ্বের ইতিহাসে শ্রমিক ও সাধারণ জনগণের সংগ্রাম হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। বরং চক্রান্তকারী প্রতিবিপ্লবীরাই ইতিহাসে ঘৃণ্য। ফরাসি বিপ্লব ও প্যারিস কমিউন দুই ক্ষেত্রেই দেখা গেছে বাইরের শক্তির বিপ্লবকে নস্যাৎ করার চেষ্টাসহ নানা ষড়যন্ত্র এবং বিপ্লবীদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি প্রতিবিপ্লবীদের সাহায্য করেছিল বিপ্লবীদের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ১০০ দিন পার করার পরও সে কথাটা খুব মনোযোগ দিয়ে মাথায় রাখা দরকার। কারণ এরই মধ্যে এই সরকার নানাভাবে সমালোচিত হচ্ছে।
বর্তমান সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ক্ষমতায় বসেছেন কীভাবে- এটা জানার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তিনি ছাড়া আর কেউ সরকারের প্রধান হলে সকল আন্দোলনকারী কি তখন একমত হতেন? আর একটি নাম কি বলা যাবে এই মুহূর্তে, যাকে এই পদে বসালে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে তা মেনে নিতেন?
মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতির উদ্দেশে যে তিনটি ভাষণ দিয়েছেন, আমার ধারণা ততটা গঠনমূলক বক্তব্য এর আগে এ দেশের মানুষ অন্য সরকারপ্রধানদের কাছ থেকে শোনেননি। মুহাম্মদ ইউনূস তার বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেছেন, ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবিক রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেছেন। তিনি ক্ষমতায় বসে প্রথমেই আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়া আনার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তার সরকার সে ব্যাপারে ব্যর্থ হয়েছে। এর কারণগুলো যে মানুষ কমবেশি জানে না, তা নয়। আগের সরকার গত ১৫ বছরের শাসনে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে এমনভাবে দলীয়করণ করে গেছে, সেখানে রাতারাতি আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা কঠিন। সেখানে আরো আছে একটি বৃহৎ রাষ্ট্রের এই সরকারকে ব্যর্থ করে দেওয়ার চেষ্টা। সরকারের দুই মাস পার হওয়ার পর যখন এ ব্যাপারে প্রথম আলোর সম্পাদক প্রশ্ন করেন, তিনি স্বীকার করেন তার সরকার ব্যর্থ হয়েছে। সরকারপ্রধান হিসেবে এটাই মুহাম্মদ ইউনূসের গুণ, তিনি আস্ফালন না করে ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়েছেন।
কিছু প্রতিষ্ঠান এবং একটি রাষ্ট্রের গণমাধ্যম ৫ আগস্ট থেকে ৮ আগস্টে ঘটে যাওয়া বহু ঘটনার দায় বর্তমান ইউনূস সরকারের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এসব ঘটনার দায় ইউনূস সরকার নেবে কেন? ইউনূস সরকার ক্ষমতায় বসেছে ৮ আগস্ট রাতে। ফলে তার আগের দায় নিতে হবে তখন যারা ক্ষমতায় ছিলেন বা তৎকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনাকে। রাষ্ট্রকে এভাবে অরক্ষিত রেখে তিনি পালিয়ে যেতে পারেন না, এর জন্য অবশ্যই তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। যারা শেখ হাসিনার এই দায়িত্বহীনতাকে অপরাধ মনে করে না, কিছুতেই তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বা বাংলাদেশের জনগণের বন্ধু হতে পারে না। আর যদি শেখ হাসিনা নিয়মতান্ত্রিকভাবে পদত্যাগ করে চলে যান, তাহলে যার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন, তাকে ৫ আগস্ট থেকে ৮ আগস্টের দায়ভার নিতে হবে।
মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না বলে রাষ্ট্র পরিচালনার দক্ষতা রাখেন না, এটা চিন্তা করারও কারণ নেই। তিনি ভালো করেই জানেন, সরকারের কাছে জনগণের চাহিদাগুলো অর্জন করা তার সরকারের জন্য কতটা কঠিন। মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার সরকারকে একসঙ্গে দুটো দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। একটি ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতিবিপ্লব ঠোকানো, অপরটি জনগণের আস্থা অর্জন করা। প্রথমটির কারণে দ্বিতীয় অর্জন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
মুহাম্মদ ইউনূসকে যখন আন্দোলনকারীরা ক্ষমতায় বসিয়েছেন, বৃহত্তর স্বার্থেই এই সময়ে সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য সকলকে দৃঢ়তার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রচারণা দ্বারা বিভ্রান্ত হলে চলবে না। বিগত আন্দোলনে ছাত্র-জনতার সঙ্গে বিরাট এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে সামরিক বাহিনী। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী বহুকাল ধরে বিতর্কিত ছিল, এইবার প্রথম তারা সর্বস্তরের মানুষের আস্থা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা একটি অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সামরিক বাহিনী তাদের ওপর জনগণের এই আস্থা হারাতে চাইবে না বলেই আমার বিশ্বাস। সামরিক বাহিনী ভবিষ্যতে আর জনবিচ্ছিন্ন না হয়ে জনগণের অংশ হয়ে উঠলেই সেটা হবে ঐতিহাসিক ঘটনা।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকার এরই মধ্যে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণেই এই সমালোচনাকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। ১০০ দিনে এই সরকারের অর্জনও কম নয়, যা চট করে ধরা পড়ছে না। বর্তমান সরকার লুটপাটেও যুক্ত নয়। বরং বহু ব্যয় কমিয়ে এনেছে। স্মরণ রাখতে হবে, স্বাভাবিকভাবেই প্রতিপক্ষ এবং সেই সঙ্গে তাদের দোসর বিদেশি একটি রাষ্ট্রের কাছে প্রথম থেকেই এই সরকার গ্রহণযোগ্য ছিল না। কিন্তু বর্তমানে ইউনূস সরকার প্রশ্নবিদ্ধ জুলাইয়ের আন্দোলনের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন তাদের কাছেও। এর প্রধান কারণ সরকারের ব্যর্থতা নয়, যতটা ষড়যন্ত্রকারীদের প্রচার এবং কতিপয় উপদেষ্টার হঠকারী কথাবার্তা ও কার্য। প্রথমেই ইলিশ মাছ রপ্তানি নিয়ে কথাবার্তা বলে প্রশ্ন সৃষ্টি করলেন একজন উপদেষ্টা। দ্বিতীয় আরেকজন উপদেষ্টা সেন্ট মার্টিন দ্বীপ নিয়ে নানা রকম বিতর্কিত কথা বলে চলেছেন। বুঝতে হবে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়ার আগে ও পরে বলতে চেষ্টা করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হাসিনা সরকার সেন্ট মার্টিন দ্বীপ হস্তান্তর করতে চায়নি বলেই যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছে। বর্তমান এক উপদেষ্টা বারবার এমন সব কথা বলেই চলেছেন এই দ্বীপটিকে নিয়ে, যাতে মানুষের মনে হতেই পারে দ্বীপটিকে এই সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করতে চায়।
সবচেয়ে বেশি বিতর্ক তৈরি করেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। প্রথম যিনি এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন, তিনি শিল্পকলা একাডেমিতে এমন সব লোকদের বসিয়েছেন, যারা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের লক্ষ্যের বিরোধী এবং বিগত হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগী। বিগত হাসিনা সরকারের আমলে তার সবচেয়ে অন্ধ প্রচারক ছিলেন শিল্পকলা বা নাট্যাঙ্গনের লোকরা। কিছু ব্যতিক্রম বাদে এরা হাসিনা সরকারের জুলাইয়ের হত্যাযজ্ঞের পক্ষে ছিলেন। পরবর্তী সময়ে হাসিনা সরকারের হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে সমালোচনা করা দূরে থাক, একটা অনুশোচনা পর্যন্ত করেনি। বরং বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেই চলেছে। শিল্পকলা একাডেমিতে সে সব লোককেই এখন প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়েছে, যারা হাসিনা সরকারের সবচেয়ে বিশ্বাসভাজন, বর্তমান সরকারকে উৎখাত করতে যারা সদাসচেষ্ট। কিছুদিন আগে ‘শিল্পকলা একাডেমিতে নাটক বন্ধ করার নাটকটা’ সেই পরিকল্পনারই অংশ। সেই ঘটনার ভেতর দিয়ে হাসিনার দালালরা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে বিতর্কিত করার সুযোগ নিয়েছে মাত্র।
দুর্ভাগ্যের কথা এই যে, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে পরে যাকে আনা হয়েছে, সে প্রথম দিন থেকেই বিতর্কিত হয়ে আছে। বর্তমান সংস্কৃতি উপদেষ্টাও হাসিনার পক্ষের শক্তিকে শিল্পকলার অঙ্গনে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য কাজ করছে, যার ভেতর দিয়ে আন্দোলনরত মানুষের ঐক্যে ফাটল ধরছে। সরকারপ্রধানকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে এদিকটায় লক্ষ রাখতে হবে। হাসিনার পক্ষের শক্তিকে বিভিন্ন জায়গায় বসতে দেওয়া মানেই ছাত্র-জনতার সংগ্রাম এবং জুলাই-আগস্টের শহীদদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। যারা হাসিনার হত্যাকাণ্ডের পক্ষে কথা বলেছে, লুটপাটকে সমর্থন দিয়েছে, তাদের শিল্পচর্চা কখনোই জনগণের কাজে আসবে না। প্রচার-প্রচারণার জোরে এদের অনেকেই বড় বড় তারকা হতে পারে, কিন্তু কিছুতেই তাদের আর শিল্পকলা বা সাহিত্যের জগতে প্রভাব বিস্তার করতে দেওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে, প্রশ্নটা হলো মতাদর্শগত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াই। শিল্পকলা, নাটক বা সাহিত্যকে কীভাবে গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, মানবিক রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে বা আরো বৃহত্তর স্বার্থে কাজে লাগানো যায় তা মনে হচ্ছে এই সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আদৌ বুঝতে পারছেন না।
বর্তমান সরকার সম্পর্কে মানুষের মনে এত প্রশ্ন, এত দ্বিধাদ্বন্দ্ব তার প্রধান কারণ এই সরকার ভালো বা মন্দ যাই করুক, জনগণ তা সঠিকভাবে জানতে পারছে না। সরকারকে এই জনবিচ্ছিন্নতা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে হবে। সরকার যখন গঠিত হয়, তখন যুবমানসকে আরো বেশি করে এই সরকারের আশপাশে আনুষ্ঠানিকভাবে রাখা দরকার ছিল। যুবমানসের প্রতিনিধি হিসেবে সরকার বাংলাদেশের সব জেলা, বিভাগ থেকে বা অন্যান্য কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে যুবমানসের ১০০ থেকে ১২০ জন প্রতিনিধিকে নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন সভা গঠন করতে পারতেন বলে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি। মুহাম্মদ ইউনূস নিজে যখন যুবসমাজকে রাষ্ট্র গঠনের বিরাট শক্তি বলে মনে করেন, তখন সরকারে যুব সমাজের অংশগ্রহণ বেশি থাকা দরকার ছিল। কিন্তু তার সরকারে যুবসমাজের অংশগ্রহণ অনেক কম।
ফলে উপদেষ্টা হিসেবে নয়, উপদেষ্টা হিসেবে অভিজ্ঞ বা বয়স্করা আছেন, থাকুন। কিন্তু একটি পর্যবেক্ষণ বা মূল্যায়ন সভা বা পরিষদ গঠন করে চিন্তাশীল, গঠনমূলক যুবমানসকে সরকারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া দরকার। প্রতি মাসের শেষ চার দিন এই সভা বসবে এবং তিন দিন এই সভার সদস্যরা বর্তমান সরকারের কাজের মূল্যায়ন করবে। চতুর্থ দিনে সরকার এই সভার কাছে জবাবদিহিমূলক বক্তব্য রাখবে। তাহলে আর সরকার জনবিচ্ছিন্ন হবে না। এই সভা বা পরিষদের মধ্য দিয়ে জনগণের কাছে সরকারের সকল কর্মকাণ্ড প্রতিফলিত হবে, বিভিন্ন গুজবে তখন জনগণ মাথা ঘামাবে না।