
ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে গেলেন। এখন আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা গ্রহণটা বাকি কেবল। এতে অনেকেই হতাশ হয়েছেন, কিন্তু কেউই আশ্চর্য হননি। কেননা ২০১৬-এর তুলনায় এবারকার জয়ে আশ্চর্যের কিছু ছিলো না। এর কারণ ট্রাম্প ৪৫তম প্রেসিডেন্টও ছিলেন আর এবার তার প্রতিদ্বন্দ্বী আগেরবারের চেয়ে অনেক দুর্বল। ২০১৬ সালে তাকে শক্তিশালী প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিলো আর গণমাধ্যমের বড় অংশটাই সেবার তাকে পাত্তা দেয়নি। হিলারির জয়কে সবাই প্রায় নিশ্চিত ধরে নিয়েছিলো।
প্রথমত সেই অভিজ্ঞতা আর দ্বিতীয়ত প্রার্থী হিসেবে হিলারির তুলনায় কমলা হ্যারিসের দুর্বলতা ইত্যাদি কারণে সবাই ধরে নিয়েছিলো এবার একটা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। কিন্তু তাও হলো না, সহজেই জিতে গেলেন ট্রাস্প। ব্যাপারটা যুক্তরাষ্ট্রের ও বিশ্বরাজনীতির জন্য খারাপ হলো মনে করা সত্ত্বেও সবাই স্বাভাবিক ধরে নিয়েছেন। নির্বাচিত ট্রাম্পকে মেনে নিয়েছেন সকলে। এটাই গণতন্ত্রের নিয়ম। কিন্তু ক্ষমতাসীন ট্রাম্পকেও সবাই মানবেন কিনা কিংবা আমেরিকায় তার বিরুদ্ধে আন্দোলন-বিক্ষোভ শুরু হবে কিনা সেটাই প্রশ্ন।
যুক্তরাষ্ট্রে দুজন রাজনৈতিক নেতা মানুষের একটি ক্ষুধা আঁচ করতে পেরেছেন। তারা হলেন প্রথমত বার্নি স্যান্ডার্স ও দ্বিতীয়ত ডোনাল্ড ট্রাম্প। অবশ্য তারকাতুল্য কংগ্রেসওম্যান আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাশিয়ো-কোর্তেজের কথা এখানে বাদ রাখছি যেহেতু তিনি কখনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হননি। শুধু আমেরিকা কেন, দুনিয়া জুড়ে এখন বিস্তৃত সেই ক্ষুধার নাম পরিবর্তনের ইচ্ছা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশের মানুষই আজকাল এই ক্ষুধায় কাতর। আকস্মিক সব রাজনৈতিক পরিবর্তনে তা স্পষ্ট হচ্ছে। এই পরিবর্তনের ধারাতে স্যান্ডার্সই ছিলেন ট্রাম্পের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু ডেমোক্র্যাটদের প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্ব স্যান্ডার্সকে বাদ দিতেই প্রথমবার দাঁড় করায় হিলারি ক্লিনটনকে আর দ্বিতীয়বার জো বাইডেনকে। প্রথমবারের ফল তারা পায় হিলারির পরাজয়ে। দ্বিতীয়বার ট্রাম্পকে ঠেকাতে স্যান্ডার্স ও তার অনুসারীরাও জানপ্রাণ দিয়ে নির্বাচনী যুদ্ধে নামেন ও কোনোমতে বাইডেনের জয় নিশ্চিত করেন। কিন্তু ইসরায়েলি গণহত্যায় বাইডেনের প্রত্যক্ষ সমর্থন ও রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিশ্বের অস্থিতিশীলতা তৈরিতে তার ভূমিকা যুক্তরাষ্ট্রের মানুষকে আবার পরিবর্তনের জন্য তৃষ্ণার্ত করে তোলে। বাইডেনের শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতার জন্য ডেমোক্র্যাট নেতৃত্ব বাইডেনকে প্রার্থীতা থেকে সরিয়ে দেয়। কিন্তু তারা বাইডেন পলিসি থেকে একচুল সরতে নারাজ। সেই পলিসি অব্যাহত রাখতেই তড়িঘড়ি করে অনভিজ্ঞ ও কম যোগ্যতাসম্পন্ন কমলা হ্যারিসকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী দাঁড় করিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছিলো। কিন্তু নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসতে থাকে ট্রাম্পের তুলনায় কমলার অজনপ্রিয়তাও ততই স্পষ্ট হয়।
এই নির্বাচনী ফলাফলে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে প্যালেস্টাইনে ৪৪ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা যার দুই তৃতীয়াংশই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। ট্রাম্প-কমলা প্রতিযোগিতায় হত্যাযজ্ঞের এই প্রভাব আগেই অনেকে ধারণা করেছিলেন। বৎসরাধিক কাল ধরে এই হত্যাযজ্ঞে আহতের সংখ্যা প্রায় ১ লাখের বেশি। ব্রিটিশ জার্নাল ল্যান্সেটের হিসাব অনুযায়ী প্রকৃত হত্যা আরও অনেক বেশি। আর এই গণহত্যা বন্ধে বাইডেন-কমলা জুটির কোনো ভূমিকাই দেখা গেল না। বরং তারা যুদ্ধাপরাধী নেতানিয়াহুকে হত্যার অবাধ লাইসেন্স দিয়ে দেন। এমনকি গ্রিন পার্টির নেত্রী ইহুদি বংশোদ্ভূত জিল স্টেইন পর্যন্ত যে নৈতিকতা ও মানবিকতার পরিচয় দেন, তার ছিটেফাঁটাও দেখাতে পারেননি কমলা। স্টেইন প্রেসিডেন্ট হলে প্রথম দিন কী করবেন এ প্রশ্নে তার স্পষ্ট জবাব হলো, তিনি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে একটা ফোন করে প্যালেস্টাইনে অবিলম্বে হামলা বন্ধ করতে বলবেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য এখানেই শেষ জানিয়ে দিবেন। জিল তাই আমেরিকায় মুসলমানদের অনেক ভোট পেয়ে যান, যদিও তার জেতার সম্ভাবনা ছিলো শূন্যেরও কম। বাইডেন-কমলার প্রতি ক্ষুব্ধ অনেক মানুষের ভোট ট্রাম্পের ঝুলিতেও পড়ে। দেখা যাচ্ছে, গাজায় গণহত্যা ও এর অপরিবর্তনীয় অবস্থা ট্রাম্পের মত এক অসংস্কৃতিবান দুর্নীতিবাজ স্বৈরতান্ত্রিক ধনীকে এবার নির্বাচনে জিততে অনেকখানি সহায়তা করেছে।
ট্রাম্প মানুষকে ধোঁকা দেয়ার শিল্পে এক ওস্তাদ। সবচেয়ে বেশি শান্তির কথা বলেন তিনি, বড়াই করে বলেন যে তার আমলে পৃথিবীতে কোনো বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি। কিন্তু অনেক আন্তর্জাতিক সংকট তৈরির কৃতিত্ব তারই। এর মধ্যে উল্লেখ করা যায়:
১। ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ফিলিস্তিনিদের আকাঙ্ক্ষা পায়ে দলে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা
২। যে ইরান পারমাণবিক চুক্তি ছিলো বারাক ওবামার এক অনন্য অর্জন ২০১৮ সালের মে মাসে ট্রাম্পের ঘোষণায় তা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসা
৩। ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি ট্রাম্পের নির্দেশে ইরানি সামরিক নেতা কাসেম সুলেমানিকে হত্যা, ইত্যাদি।
এছাড়াও ২০১৭ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসা উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক ঐক্যে ফাটল তৈরি করে। দেশের ভিতরে তার অসংখ্য অপকর্মের মাঝে সবচেয়ে কুখ্যাত হলো ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটনে ক্যাপিটল প্রাসাদে কংগ্রেস অধিবেশনে আক্রমণ করে বাইডেনের ক্ষমতায় আরোহণকে বানচাল করার চেষ্টা। এতসব অপকর্মের হোতাকেও যে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ, যাদের মাঝে অনেক প্রান্তিক নির্যাতিত মানুষও রয়েছেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করলো তাতে তাকে ধোঁকাবাজির গুরু বলা যায়। এবারও তিনি জিতেছেন শান্তির দূত হিসেবে। পথটা খুলে দিয়েছে অবশ্য বাইডেন-কমলা চক্রেরই ভণ্ডামি, ব্যর্থতা ও নিষ্ঠুরতা।
ট্রাম্প জিতে যাবার কিছু কারণ বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের রাজনীতিতেও বিদ্যমান আছে যেখানে একইরূপ ঘটনাই ঘটছে। সেটা হলো শ্রমজীবী মানুষকে পক্ষে টানতে পারা ও না পারার প্রশ্ন। গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্নরা এখানেই ব্যর্থ হচ্ছেন। তারা নির্বাচনী কৌশলকে আরও চৌকষ করতে মন দিচ্ছেন। হিলারির ও কমলার নির্বাচনী কৌশলের চেয়ে চৌকষ নির্বাচনী কৌশলতো আর পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। কিন্তু ডানপন্থীরা মনোযোগ দিচ্ছে নির্বাচনী বার্তার ওপর, নিছক চৌকষ কৌশলের ওপর নয়। সবদেশেই তারা পরিবর্তনের কথা বলছে, যেখানে তারা ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তা ইত্যাদিকে যথেচ্ছ ব্যবহার করছে। অন্যদিকে প্রগতিশীলরা তার বিপরীতে সাধারণ মানুষ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক অবিশ্বাসকেও কাজে লাগাচ্ছে ডানপন্থী শক্তিগুলো। ফলে ডানপন্থী উত্থানসমূহে বহু অরাজনৈতিক ব্যক্তিও নেতৃত্বের ভূমিকায় আসছে আর্থিক, ধর্মাদর্শ ও অন্যান্য ক্ষমতাবলে। প্রচলিত রাজনৈতিক চর্চার সংকীর্ণতা ও আদর্শহীনতাই দেশে দেশে মানুষের মনে রাজনৈতিক বিদ্বেষ তৈরি করেছে। এজন্য রাজনীতিকরা নিজেরাই মূল দায়ী। বিশ্বের এই বর্তমান ঝোঁকও ট্রাম্পের মত স্বৈরতান্ত্রিক বর্ণবাদী ব্যক্তিদের ক্ষমতারোহণে সহায়তা করছে, যাকে ট্রাম্পিয়ান বলা যায়। ট্রাম্পপন্থীরা এই ঝোঁকের সহজ সুফল ভোগ করছেন।
ট্রাম্পিয়ান শান্তি মিশন পৃথিবীতে কী দুঃখদুর্দশা বয়ে আনবে তা এখনও নিশ্চিত নয়। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ ও গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা বন্ধে কিংবা চলমান রাখতে তিনি কী পদক্ষেপ নিবেন তাও অনিশ্চিত। বেশি সম্ভাবনা হলো তার পদক্ষেপসমূহ হবে একপক্ষীয় ও নতুন বৈশ্বিক সংকটের স্রষ্টা। যা সমাধানের দায় পড়বে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প-পরবর্তী প্রশাসনের ও বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের ওপর।
লেখক: সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি