
করোনাভাইরাসের আক্রমণে সারা দুনিয়া বিপর্যস্ত। দেশে দেশে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, মানুষ মারা যাচ্ছে, খাদ্যাভাবে আছে খেটে খাওয়া কোটি কোটি সাধারণ মানুষ, কলকারখানা, ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ, মানুষের চলাচল বন্ধ, ঘরে বসে মাথা খুঁটছে লাখ লাখ মানুষ, চাকুরি হারাচ্ছে কত জন ইয়ত্তা নাই, মাথার ওপর ভাঙ্গা আকাশ নিয়ে দিনাতিপাত করছে তাবৎ দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষজন।
মানুষ মরে যাচ্ছে একা, সৎকারের জন্য নাই উপযুক্ত ব্যবস্থা, করোনা আক্রান্ত অসুস্থ বয়স্কজনকে রাস্তায় ফেলে যাচ্ছে অনেকে, আক্রান্ত মানুষদের ঠাঁই দিচ্ছে না অনেকে, মানুষের সমাজ পুরোটাই আক্রান্ত, মানবতাও সংকটের মুখে। অবস্থা যখন এমন বিপর্যস্ত সেই সময়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়াচ্ছে, বিভিন্ন কোম্পানি ব্যবসা আর মুনাফায় মেতে উঠেছে মানুষের জানের ওপর।
এ মধ্যে করোনাভাইরাসের মতোই সারা দুনিয়ায় ফেক নিউজের রমরমা অবস্থা। ভুল ইনফরমেশন দিয়ে সারা দুনিয়ার সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে ফেক মিডিয়া নিউজ। করোনা মহামারির মতন ইনফরমেশনও মহামারির মতো হাজির হয়েছে। কেবল ফেক মিডিয়াই নয়, এর মধ্যে রয়েছে কিছু মেইনস্ট্রিম মিডিয়াও, বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা, যারা বিভিন্ন কোম্পানির অর্থায়নে ভুল তথ্য, ভুল গবেষণার তথ্য উপাদি মুনাফার জন্য হাজির করছে জনগণের সামনে। এটা কেবল বাংলাদেশে নয়, সারা দুনিয়ার সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সকল শ্রেণি পেশার মানুষই সেই ভুল তথ্যের শিকার; আর এর ফলে এদের কেউবা বিভ্রান্ত, কেউ কেউ চরম আতঙ্কিত, কেউবা ভয়ে বেছে নিচ্ছে আত্মহননের পথ।
সারা দুনিয়ায় বিভিন্ন শহর লকডাউন, কোথাও কোথাও সারাদেশের লকডাউন চলছে, করোনাভাইরাসকে মোকাবেলা করার জন্য। কিন্তু এই লকডাউনের মধ্যে সম্প্রতি দেখা যায়, কিছু অসাধু কোম্পানি মুনাফার খাতিরে অনৈতিক ব্যবসায় নেমে পড়ছে। যেমন, তামাক কোম্পানিগুলো উঠে পড়ে লেগেছে তাদের বিপণন কৌশলকে আরো জোরদার করতে, আরো কাজে লাগাতে, মানুষের দোরগড়ায় পৌঁছে দিতে তাদের সেবা। বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশেও তামাক কোম্পানিগুলো উঠে পড়ে লেগেছে তাদের বাজারকে আরো বেগবান করতে। বিশেষ করে, বাংলাদেশে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি তাদের সকল শক্তি কাজে লাগিয়ে চেষ্টা করছে কিভাবে মানুষকে, বিশেষ করে, এদেশের তরুণদের তামাক পণ্যের নতুন ভোক্তা তৈরি করা যায়। এবং এই কারণে, নানা কৌশলে তারা অব্যাহত রেখেছে তাদের উৎপাদন, বিপণন ও বিজ্ঞাপন।
আমরা জানি, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো- বাংলাদেশে (বিএটি-বি) রয়েছে সরকারের প্রায় দশ শতাংশ শেয়ার এবং পরিচালনা কমিটিতেও রয়েছে সরকারের উচ্চপদস্থ আমলা। অনেকে মনে করেন, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি নীতিনির্ধারণী মহলে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা রাখে এবং অনেক সময় সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ তাদের পক্ষে নিয়ে যায়। জনমানসের এমন ধারণা আমলে না নেয়ার তেমন কোনো কারণ নাই। অনেক সময় বিএটি বলে যে, তারা সর্বোচ্চ করদাতা এবং এই কারণেই কোম্পানিটিকে কেউ কেউ নানা সুযোগসুবিধা দিতেও কুণ্ঠা করেন না। এটা সত্য যে, কোম্পানিটি সরকারকে বিশাল অংকের কর দেয়, কিন্তু, আমাদের এ-ও মনে রাখতে হবে যে, কোম্পানিটি যে পরিমাণ কর দেয়, তারও বেশি ভোগান্তি দেয় জনগণকে, কেননা, এই তামাক কোম্পানিটি জনস্বাস্থ্যের জন্য বিরাট হুমকি।
সম্প্রতি আমরা লক্ষ করেছি, দেশের শিল্প উন্নয়নে অবদানের জন্য চলতি বছর শিল্প ক্যাটাগরিতে রাষ্ট্রপতি পুরস্কারের ভূষিত করা হয়েছে ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো-বাংলাদেশকে (বিএটি-বি)। গত ১৫ মার্চ ২০২০ শিল্প মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়। দেশের শিল্প উন্নয়নে অবদানের জন্য ওই কোম্পানিকে পুরস্কারের তালিকায় প্রথম পুরস্কার প্রাপ্ত হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি এমন একটি তামাক কোম্পানিকে পুরস্কার দেয়া জনস্বার্থ পরিপন্থি বলেই মনে করে জনগণ। উল্লেখ্য, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে এই পুরস্কার ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার বিরোধিতা হিসাবে দেখা যায়।
উল্লেখ্য, দেশে প্রায় দেড় মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে। এবং তামাক সেবনজনিত রোগে প্রতিবছর গড়ে ১ লাখ ৬০ হাজার মৃত্যুবরণ করে।অর্থাৎ তামাকপণ্য সেবনের কারণে প্রতিদিন ৩৪৫ জন মারা যায়। এর মধ্যে পুরুষ ২৬ শতাংশ এবং নারী ১০ শতাংশ। অন্য এক গবেষণা অনুসারে, বাংলাদেশে ৬৭ শতাংশ মৃত্যুর ঘটনা সংক্রামক রোগের কারণে ঘটে। গবেষকরা জানিয়েছেন, কমপক্ষে ৫০ শতাংশ মানুষ তামাক-সংক্রান্ত রোগের কারণে অকাল মৃত্যুবরণ করে। তামাক সম্পর্কিত অসুস্থতার কারণে হারানো উৎপাদনশীলতা এবং সরাসরি স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় থেকে তামাক ব্যবহারের মোট অর্থনৈতিক ব্যয় হলো ১৫৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার (অর্থাৎ বাংলাদেশের জিডিপির ১ দশমিক ৪ শতাংশ)। এই পরিসংখ্যান আমলে নিলে দেখা যায়, যে পরিমাণ কর দেয় কোম্পানিটি তারও অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে দেশকে, অর্থনৈতিকভাবে।
এছাড়াও, তামাকজনিত স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১৫টি দেশের মধ্যে অন্যতম। তামাকজাত দ্রব্যের বড় লক্ষ শিক্ষার্থী যাদের ৫২ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী ফুটপাত থেকে বিড়ি-সিগারেট কিনে থাকে। ৩ শতাংশ শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে নমুনা দেয়া হয় এবং ৯ শতাংশ শিক্ষার্থীকে তামাক ব্র্যান্ডের লোগোসহ প্রচারমূলক পণ্য দেয়া হয়, যা আইন বিরোধী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোবাকো কন্ট্রোল (এফটিটিসি)- এর ৫ দশমিক ৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সরকার জনস্বাস্থ্যরক্ষার জন্য এফটিটিসি বাস্তবায়নে দায়বদ্ধ। জনস্বাস্থ্যরক্ষায় তামাকজাত পণ্য ও কোম্পানিগুলোকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করতেও বলা হয়েছে সরকারকে।
সম্প্রতি, দেশের বিভিন্ন জেলা যখন লকডাউন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী আদেশে যখন সারাদেশের কলকারখানাসহ সকল সরককারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ, এবং শ্রমিক-কর্মচারিরা সাধারণ ছুটিতে, ঠিক সেই সময় বিএটি তাদের তামাক শ্রমিকদের কাজ করতে আদেশ দিচ্ছে। অবাক লাগে, একটা তামাক কোম্পানি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশকে আমলে না নিয়ে কোন সাহসে এমন আদেশ দিয়ে সাধারণ শ্রমিকদের ঠেলে দিচ্ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মুখে, মৃত্যুর ঝুঁকিতে! খেয়াল রাখা দরকার, জীবনের চেয়ে আইন বেশি মূল্যবান নয়। কৌশল হিসেবে কোম্পানিটি ১৯৫৬ সালের আইনকে ব্যবহার করে প্রশাসনকে প্রভাবান্বিত করে নোটিশ জারি করেছে যেন তামাক কোম্পানির শ্রমিকরা তাদের কাজ চালু রাখে!
প্রথমেই উল্লেখ করেছিলাম যে, তামাক কোম্পানিগুলো নানা ছলকালার আশ্রয় নেয় তাদের ব্যবসাকে চাঙ্গা রাখতে।এর মধ্যে অন্যতম হলো, বিভিন্ন ফেক মিডিয়া ও কোম্পানির স্বার্থরক্ষার কাজে নিয়োজিত কিছু গবেষণা সংস্থা। করোনাভাইরাসে সংক্রমণ ও মৃত্যুর মহামারীর কালেও থেমে নেই কোম্পানির প্রচারণা। সম্প্রতি, বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় সংবাদে প্রকাশ যে, সিগারেট করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি কমায়!
ডেইলি মেলে এই সংবাদটি পরিবেশনের পর বাংলাদেশের মিডিয়াতেও প্রকাশিত হয়। তারা এমনকিছু তথ্য উপাত্ত হাজির করে যেসব অনুমান নির্ভর ও অবৈজ্ঞানিক। কিন্তু মূলধারার মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি পুনরুৎপাদনের কারণে অনেক তরুণ ধূমপানের প্রতি আসক্ত হয়ে যেতে পারে। যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি, বিশেষ করে, করোনা সংক্রমণের শঙ্কা বেড়ে যায়। যেহেতু, ধূমপান ফুসফুস আক্রান্ত করে, এবং করোনাভাইরাসটি মূলত ফুসফুসকেই আক্রান্ত করে, ফলে অনুমেয় যে, ধূমপান, হোক বিড়ি সিগারেট মাধ্যমে বা হুক্কা ও ভেপসের মাধ্যমে, তা অত্যন্ত ক্ষতিকর, এমনকি মৃত্যু ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয় অধূমপায়ীদের চেয়ে অনেক বেশি হারে।
জনগণ মনে করে, তামাক কোম্পানির, বিশেষ করে, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির এমন আগ্রাসী নীতি জনস্বাস্থ্যকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে ফেলতে পারে। কোম্পানিটির উচিৎ জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে ছলাকলা কৌশলের পরিবর্তে ন্যায্য-ব্যবসায় মনোযোগ দেয়া।
তামাকজাত পণ্যকে তারা বাজারজাত করে বেড়াচ্ছে, পণ্য উৎপাদন করছে শ্রমিকদের কাজে লাগিয়ে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে।
লেখক: কবি, গবেষক, মানবাধিকার কর্মী।