
গ্রামবাংলায় একটা প্রবাদ চালু আছে, যুদ্ধের পর সেপাই হাজির। ১৯৭১ সালের মুক্তিসংগ্রাম থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলন সর্বত্রই গভীরে গেলে দেখা যায়, যুদ্ধের পর হাজির হওয়া সেপাইদের ভিড়ে প্রকৃত আন্দোলনকারীরা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। সব কৃতিত্বের দাবি নিয়ে এমন সব মানুষ সামনে দাঁড়িয়ে আছে, এমনভাবে ইতিহাসের বর্ণনা দিয়েছে বা দিচ্ছে, যেখানে সাধারণ মানুষের পক্ষে বিশ্বাস করা ভিন্ন অন্য কোনো উপায় থাকে না। এহেন সেপাইরা প্রবন্ধ লেখেন, বই লেখেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বক্তৃতা করেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সোচ্চার থাকেন। তাদের আবার সবার দলীয় মতাদর্শ অনুযায়ী সিন্ডিকেট আছে। একজনের পক্ষে অন্যদের ঝাঁপিয়ে পড়া, লাফালাফি করা দেখেই এই সিন্ডিকেটগুলো চেনা যায়। পতিত অংশীজন হিসেবে আন্দোলন-সংগ্রামের বিরাট অংশ অবহেলিত রয়ে গেছে সব সময়। যেমন একাত্তরে, তেমনি চব্বিশে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বৈষম্যবিরোধী সংস্কারের কথা উঠে এসেছে। সরকারের প্রায় চার মাস অতিক্রান্ত হয়েছে, সংস্কারের জন্য বেশ কয়েকটি কমিটি করা হয়েছে, সেগুলো কাজও শুরু করেছে। আশা করা যায়, সংস্কারের প্রতিবেদন অতীতের ধারাবাহিকতার বাইরে এসে সর্বসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। আগামী দু-তিন মাস দেশবাসী অপেক্ষায় থাকবে কেমন সংস্কারের প্রস্তাব আসে এবং সেই প্রস্তাবে সাধারণ মানুষ কীভাবে উপকৃত হন তা দেখার জন্য। তারা জানতে চায় কীভাবে বিভিন্ন বৈষম্য থেকে বের হয়ে আসবে গণমানুষ। পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে জনগণ সন্দিহান থেকেই যাচ্ছে ৫৩ বছরে সাধারণ মানুষের মাথার ওপর সর্বত্র যত জঞ্জাল চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তার মুক্তিপথ সংস্কার প্রস্তাবে থাকবে কি না! কারণ আমরা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাপনাকে পাশ কাটিয়ে লাঠিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাপনায় দিনে দিনে শক্তিধর হয়ে উঠেছি। জ্ঞান আমাদের কাছে একান্তই অগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সে কারণেই দেড় যুগ ধরে অনেক আবেদন-নিবেদনের পরও শিক্ষা আইন অনুমোদন করানো সম্ভব হয়নি। ফলে পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে ঘরপোড়া সাধারণ মানুষের সিঁদূরে মেঘে ভয়টা থেকেই যাচ্ছে।
আসলে ক্ষমতাবর্তী মানুষগুলোর ক্ষমতার মোহ এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে রাষ্ট্র মেরামতের ফলে সাধারণ জনগণ যদি সামান্যতম সুবিধা পেয়ে যায়, সেই ভয়ে তারা অস্থির হয়ে উঠেছে। কেউ সংস্কারের জন্য একবার সরকারকে সময় দিতে চায়, তো পরদিন সংস্কার করবে রাজনৈতিক দল বলে- যুদ্ধ ঘোষণা করে আরেক দল। বলে, এই সরকারের দায়িত্ব শুধু অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন করা। কিছু মানুষকে তো এমন কথাও বলতে শোনা যাচ্ছে যে, আমরা তো ইচ্ছা করলে নিজেরাই ক্ষমতায় বসে যেতে পারতাম। বর্তমান সরকারকে সুযোগ দিয়েছি সেটা তাদের সৌভাগ্য। পতিত সরকার গত ১৫ বছর যাদের লাঠির আগায় বসিয়ে নাচিয়ে বেড়িয়েছে, তাদের মধ্যে কত সেপাই যে আজ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্বৈরাচার পতনের পর গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে মাঠ গরম করছে, তার হিসাব রাখা কঠিন। সেপাইদের একেকজন কে কীভাবে এসব আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তার বর্ণনা দিয়ে চলেছেন। সাধারণ মানুষ একভাবে দেখেছে আর এখন একভাবে বর্ণনা শুনে চলেছে। এহেন ডামাডোলের মধ্যে আবার দেখা যাচ্ছে পতিত সরকারের এজেন্টরাও বসে নেই। তাদের অনেক নেতাকর্মী-সমর্থক রাজনৈতিক আদর্শ পরিবর্তনের উদ্যোগী হয়েছে, সনদ সংগ্রহ করছে, মুখোশ পরিবর্তন করছে।
একজন পেশাজীবী হিসেবে নিজ সংগঠনকে কীভাবে রাজনৈতিক দলের অংশ হতে দেখেছি তা চিন্তা করতে না চাইলেও অস্বীকার করতে পারি না। সংগঠনের এক প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা ছাত্র অবস্থায় ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, পরে তিনি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পেশাজীবী সংগঠন প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত হন। ২৩ মার্চ একজনকে সঙ্গী করে সাইকেল চালিয়ে গিয়ে সাদা কাগজে হাতে লিখে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুকে হস্তান্তর করে আসেন। তবে এই সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত জানিয়ে এসে নিজে কিন্তু পরবর্তী ৯ মাস পাকিস্তানি সরকারের খেদমতে নিয়োজিত হয়ে পড়েন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করলে তিনি যেহেতু সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুকে হস্তান্তর করেছিলেন, তার বুনিয়াদে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। শুধু তা-ই নয়, গেট ঝাঁকিয়ে একটা দশতলা ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়ার দর্শনে বিশ্বাসী এক মন্ত্রীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও নির্দেশের মধ্য দিয়ে সে ব্যক্তি সারা দেশের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ বিজয়ী সংসদ সদস্যদের সমর্থন আদায় করেন এবং এসব সংসদ সদস্য ও নেতাকর্মী সর্বশক্তি প্রয়োগের মধ্য দিয়ে ওই সংগঠনের নির্বাচন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ভুয়া বীর মুক্তিযোদ্ধার প্যানেলের বিজয় নিশ্চিত করে। ওই ভুয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা একবার যখন রাজনীতিকে ব্যবহার করে ক্ষমতাসীন হয়েছেন, তারপর আর তা থেকে বের হতে পারেননি। এক নব্য ইতিহাসবিদ আবার এহেন মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নিয়ে ইতিহাস প্রকাশ করে চলেছেন। প্রবীণরা কী জানে তা মূল্যহীন, ইতিহাসবিদই শ্রেষ্ঠ কারণ সিন্ডিকেট। এখন যদি দেখি ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে ধ্বংসাত্মক বর্ণনা করে কঠোর হাতে দমনের পরামর্শ প্রদানকারী ব্যক্তি প্রধান উপদেষ্টাকে স্বর্ণপদক দিয়ে সংবর্ধনা দেওয়ার কথা বলেন, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের অনুকম্পা ভিক্ষা করে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের ব্যবহার করে তখন আশঙ্কা জাগে।
বল প্রয়োগে নির্বাচন করতে না দেওয়া নির্বাচন কর্মকর্তা যখন সংগঠন পরিচালনার দায়িত্ব পেতে মরিয়া হয়, তখন মনে হয় পেশাজীবীদের রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্তি করা ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ সময়ের দাবি। পলাতক সব পেশাজীবী নেতাদের আইনের আওতায় এনে বিচার হওয়া প্রয়োজন। যুদ্ধের পর সেপাই হাজির করা ইতিহাসবিদদেরও বিচার হওয়া প্রয়োজন, কারণ এরাই সবচেয়ে নিকৃষ্ট জ্ঞানপাপী।
অনেকের কাছে মনে হতে পারে- এসব ছোট ছোট বিষয়ের দিকে নজর গেলে বড় সংস্কার বিঘ্নিত হতে পারে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, এই সাদাকে সাদা বলতে না পারা মানুষগুলোর মোসাহেবীই স্বৈরাচার সৃষ্টি করে। নিজেরা নিজেদের পরিমণ্ডলে স্বৈরাচার হয় এবং বৃহত্তর পরিমণ্ডলে স্বৈরাচার সৃষ্টিতে মদদ দানকারী হিসেবে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে রাখে। তাই আইনি বিচার শুরু করলে তা এখান থেকে শুরু করাই প্রত্যাশিত। আনুমানিক এক কোটি মানুষের নামে স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে মামলা করে খুব যে একটা উপকার হচ্ছে তা সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে না। বরং প্রকৃত অন্যায়কারীদের বিচারের আওতায় আনা সময়ের দাবি। মনে রাখা দরকার, এই মোসাহেবকারীরা রং-রূপ পরিবর্তনে সময় নেয় না। যুদ্ধের পর সেপাইয়ের মতো হাজির হয়ে নিজেদের মতো করে ইতিহাস প্রচারে নিবেদিত হবে পুনরাবৃত্তভাবেই। তার লক্ষণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখনই স্পষ্ট, তাই ভবিষ্যৎ বিষয়ে সাবধান হওয়া প্রয়োজন এখনই।