
ফরাসি বিপ্লবের পর সেখানকার সব বিশ্ববিদ্যালয় নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। বলা হয়েছিল, সবার আগে দরকার সবাইকে সাক্ষর করে তোলা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাদানের আগে সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষার বিকাশ ঘটাতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা বলতে মনে করা হতো, শিশু যেন মাতৃভাষায় শুদ্ধভাবে লিখতে, পড়তে শেখে এবং সহজে অঙ্ক করতে পারে।
ফরাসি বিপ্লবের পর যখন শিশুর সাক্ষরতা নিয়ে রুশোর মতো মনীষীরা এসব ভাবছেন, প্রাথমিক শিক্ষাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছেন, বাংলায় তার ১০০ বছরের বেশি আগে সব শিশুর সাক্ষরতা দানের সুযোগ দেওয়ার জন্য গড়ে উঠেছিল পাঠশালা। সরকারি প্রচেষ্টায় নয়, সাধারণ জনগণের চেষ্টায়। বাংলা পাশ্চাত্যের বহু আগেই শিশুদের সাক্ষরতা দানের জন্য চমৎকার এবং বাস্তবসম্মত এক প্রাথমিক শিক্ষাধারার প্রবর্তন করেছিল। কিন্তু সেই বাংলাদেশকে এখন প্রাথমিক শিক্ষার জন্য বিদেশের বহু কিছু অনুকরণ করার কথা ভাবতে হয়। যদি বাংলার পাঠশালা শিক্ষাব্যবস্থাকে ইংরেজ শাসনে ধ্বংস না করা হতো, বিগত ২০০ বছরে তা ব্যাপক আকার নিয়ে সব মানুষের দোরগোড়ায় প্রাথমিক শিক্ষাকে পৌঁছে দিত। বাংলার লাখ লাখ শিশুকে নিরক্ষর হয়ে বাস করতে হতো না।
বাংলার ‘পাঠশালা’ ছিল একটি বিশেষ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষাক্রমের ভেতর অন্তর্ভুক্ত ছিল পড়া, লেখা, গণিত, পত্রলিখন, সংস্কৃত, ব্যাকরণ এবং জমিদারি ও মহাজনী হিসাবরক্ষণ। জমিদারি বা কৃষিসংক্রান্ত হিসাবরক্ষণে শেখানো হতো জমির মাপজোক ও রাজস্বের হিসাব। মহাজনী বা বাণিজ্যিক হিসাবরক্ষণে পড়ানো হতো সুদকষা এবং কী করে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করা যায়। পাঠশালায় সাধারণত সতেরো শতকে মুদ্রিত গ্রন্থ ব্যবহারের সুযোগ ছিল না। এমনকি হস্তলিখিত গ্রন্থও খুব কম ব্যবহার করা হতো। শিক্ষক মুখেমুখেই ছাত্রদের পাঠদান করতেন। সঠিকভাবে বলতে গেলে, প্রথমে অক্ষর পরিচয়, পরে বানান, তারপর অঙ্ক শেখা- এই হচ্ছে মোটামুটি পাঠশালার শিক্ষাসূচি। সব পাঠশালায় শিশুরা ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত সংখ্যা ও নামতা মুখস্থ করত। শেষে কলাপাতায় যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ এবং ওজনের নিয়ম ইত্যাদি শিখতে হতো। বড় ছেলেরা সাধারণ চিঠিপত্র ও দলিল বা চুক্তিপত্র লিখতে শিখত। পাঠশালার শিক্ষা কার্যক্রমে অঙ্কশাস্ত্রে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো। সব পাঠশালার গুরুই জমিদারি ও মহাজনী হিসাব শিক্ষাদানে সক্ষম ছিলেন না। যিনি যা সুচারুরূপে জানতেন, তাই শেখাতেন। বর্ধমান জেলার ৬০৯টি পাঠশালায় জমিদারি বা মহাজনি হিসাবপদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া হতো।
পর্যটক ইভস লিখেছেন, ‘যদিও শিশুদের লেখাপড়া শেখার অনেক বিদ্যালয় ছিল, তবে তাতে মাতৃভাষার বেশি আর কিছু শেখানো হতো না।’ উইলিয়াম ওয়ার্ড ১৮০৩ সালে লিখেছেন, বাংলার প্রায় সব বড় গ্রামেই সাধারণ বিদ্যালয় ছিল। খড়-ছাওয়া মাটির ঘরে অথবা ছায়াযুক্ত গাছের তলায় এসব পাঠশালা বসত এবং দরিদ্র জনগণের শিক্ষার বাস্তব প্রয়োজন এই পাঠশালা বহুকাল ধরে মিটিয়ে আসছিল। তিনি আরো জানাচ্ছেন যে গ্রামের এই বিদ্যালয়গুলোতে পার্থিব শিক্ষা দেওয়া হতো। পাঁচ বছর বয়সেই শিশুরা পাঠশালায় যেত। এরা একই সঙ্গে লিখতে ও পড়তে শিখত। এই পদ্ধতি ছিল দারুণ।
বিভিন্ন তথ্যে দেখা যাচ্ছে, উনিশ শতকের প্রথম দিকেও পাঠশালা শিক্ষাই ছিল বাংলা ভাষায় সাক্ষরতা লাভের ভিত্তি। সব বর্ণের ও ধর্মের শিশুরাই পাঠশালায় পড়তে আসত। পাঠশালায় ভর্তির কোনো নির্ধারিত সময়সূচি থাকত না। বছরের যেকোনো সময় ছাত্ররা পাঠশালায় যোগদান করতে পারত। কোনো বার্ষিক পরীক্ষার প্রচলন ছিল না। গুরু যখন মনে করতেন যে ছাত্র এক স্তরের শিক্ষা লাভ করেছে, তখন তিনি সেই ছাত্রকে ওপরের স্তরে উন্নীত করতেন। কাগজে-কলমে ছাত্রের উপস্থিতি সংরক্ষণ করার বালাই ছিল না। বসার জন্য ছাত্র নিজেই নিয়ে আসত মাদুর বা ছালা, মাঝখানে গুরু বসতেন একটু উঁচু টুলের ওপর। ছাত্ররা বসত তাকে ঘিরে চারদিকে। পাঠশালার কোনো নির্দিষ্ট বর্ষসূচিও ছিল না। ফলে সুবিধামতো পাঠশালা বন্ধ বা খোলা রাখা যেত। ফসল কাটার সময় কিংবা বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় পাঠশালা বন্ধ রাখা হতো। পাঠশালা দিনে দুই বেলা বসত- ভোর থেকে ১০টা পর্যন্ত আবার বেলা ৩টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। সকাল ১০টা থেকে ৩টা পর্যন্ত বিরতির সময় ছাত্ররা নিজ নিজ বাড়িতে গিয়ে স্নানাহার সম্পন্ন করতে পারত এবং বাড়ির কিছু কাজও করতে পারত। যেমন কৃষিকাজে ব্যস্ত বাবার খাবার পৌঁছে দেওয়া, গরু-হাঁস-মুরগির পরিচর্যা করা ইত্যাদি।
বাংলা পাঠশালা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা। পাঠশালা গড়ে উঠেছিল সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার ফলে এবং একটি গ্রামীণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে। সমাজের সব শ্রেণি থেকেই এখানে ছাত্র আসত এবং তা এই প্রতিষ্ঠানের জনপ্রিয়তার কথাই প্রমাণ করে। পাঠশালার গুরুরা অধিকাংশই ছিলেন কায়স্থ, তবে অন্যান্য উচ্চ বা নি¤œবর্ণের শিক্ষকও ছিলেন। বাংলার পাঠশালার প্রাথমিক একটি সাফল্য সে জাতপাতের বিচার করেনিÑদীর্ঘদিনের জাতপাতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করেই সে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলল কীভাবে, সেটাও বিচার্য। বাস্তবক্ষেত্রে অত্যন্ত গরিব ঘরের ছেলেকে বিনা বেতনে পাঠশালায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হতো এবং সাংবাদিক এ্যাডাম এই বিষয়টির খুব প্রশংসা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, বাংলায় তখন এক লাখ পাঠশালা ছিল।
বাংলার পাঠশালা শিক্ষাব্যবস্থা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, কোনো দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ড নয়। পাঠক্রম খুবই সহজ-সরল। ফরাসি বিপ্লবের মনীষীরা প্রাথমিক শিক্ষা বলতে তাই বুঝতেন। রুশো প্রাথমিক শিক্ষা বলতে এর চেয়ে বেশি কিছু শিশুর ওপর চাপিয়ে দিতে চাননি। তারা মনে করতেন, প্রাথমিক শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শিশুকে বয়স্ক মানুষ মনে করা ঠিক নয়। শিশুকে পণ্ডিত বানানোর চেষ্টা একটা ভুল পদক্ষেপ, শিশুকে তার শিশুবেলা উপভোগ করতে দিতে হবে। শিশুর ওপর অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। কিন্তু ব্রিটিশশাসিত বাংলা হেঁটেছিল সম্পূর্ণ উল্টো পথে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের ওপর বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দিতে চাইলেন। তিনি প্রকাশক ছিলেন, বই বিক্রি হলেই তার লাভ। তিনি ইংরেজদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বই এবং পাঠ্যক্রমের ভারে প্রাথমিক বিদ্যালয়কে বানিয়ে তুলতে চাইলেন পণ্ডিত বানানোর আখড়া। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ঈশ্বরচন্দ্রের পাঠক্রম ছিল বিশাল ও ব্যাপক।
ফরাসি বিপ্লবের পর রুশো ও তার ভাবশিষ্যরা শিক্ষাজগতে নিয়ে এলেন নতুন যুগ, যার নাম ‘শিক্ষায় শিশুকেন্দ্রিকতা’। রুশো বলছেন, পূর্বকালে শিশুদের বয়স্কদের ক্ষুদ্র সংস্করণ বলে মনে করা হতো এবং শিক্ষার ব্যাপারে বয়স্কদের চিন্তা-ভাবনা শিশুদের ওপর বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া হতো। যদিও বাংলার পাঠশালা শিক্ষাব্যবস্থা তেমনটি ছিল না। শাসকদের চিন্তার অনুসারী বিদ্যাসাগর বরং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের জন্য বয়স্কদের পাঠক্রম রচনা করেছিলেন। ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার ফলে নতুন নতুন বই লিখে তা ছাপিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিক্রি করার জন্য পাঠক্রম বাড়ানো দরকার ছিল, যা পড়ানোর মতো শিক্ষক তখন পাঠশালায় ছিল না। শিশুদের মা-বাবা তা শিশুদের পড়াতে পারতেন না। ফলে বাংলার শিক্ষাধারায় ধনীদের জন্য ‘গৃহশিক্ষক’ নামে নতুন একটি পেশার সৃষ্টি হলো। নানা বিধি-বিধানে দরিদ্র শিশুরা পাঠশালা থেকে ঝরে পড়তে থাকল। ইংরেজরা পাঠশালার সহজ-সরল শিক্ষাব্যবস্থার জায়গায় বহু নিয়ম-কানুন জুড়ে দিয়ে সেখানে শিক্ষকদের জায়গায় আমলাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলেন। শিক্ষকরা স্বাধীনভাবে পাঠদানের অধিকার হারিয়ে ফেললেন।
পাঠশালা গ্রামের সাধারণ মানুষকে তার বাস্তব প্রয়োজনের দিক বিবেচনা করে শিক্ষা দিতে চেয়েছিল- যে শিক্ষা ছিল সর্বসাধারণের জন্য। কিন্তু ইংরেজদের শিক্ষাদানের লক্ষ্যই ছিল তাদের সেবা করার জন্য কিছু করণিক তৈরি করা। স্বভাবতই বাংলার পাঠশালার শিক্ষাচিন্তা আর ইংরেজদের প্রবর্তিত সামগ্রিক বা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাচিন্তা কখনই এক হতে পারে না। পাঠশালা তার কিছু দায়িত্ব সুন্দরভাবেই পালন করে যাচ্ছিল। বাংলার সমাজের সাধারণ মানুষের জন্য তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল।
পাঠশালা শিক্ষার মধ্যে কৃত্রিমতার জায়গা ছিল না। যদি পাঠশালার নিজের মতো করে বিকশিত হওয়ার সুযোগ থাকত শেষ পর্যন্ত কী চেহারা পেত, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কিন্তু ইংরেজরা সেই শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আঘাত হানে। বাংলার ভদ্রলোকরা নিজেদের চিন্তার বা বিশ্বাস পাঠ্যক্রমের নামে শিশুদের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়। পাশ্চাত্যে একদা পাঠের অর্থ না বুঝেই শিশুকে বহুকিছু শিখতে হতো- শব্দগুলোর অর্থ না বুঝেই মুখস্থ করতে হতো। রুশো শিশুর প্রতি এই ধরনের শিক্ষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন।
বিদ্যাসাগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পণ্ডিত বানিয়ে তুলতে গিয়ে মাধ্যমিক বা উচ্চ বিদ্যালয়ের সঙ্গে যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের পার্থক্য রয়েছে তা বুঝতে চাইলেন না। রুশো বলেছিলেন, শিশুকে পরিণত বয়স্ক মানুষ হিসেবে দেখার আগে তাকে ‘শিশু’ হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। তিনি মনে করতেন, শিশুর মনকে অকালে উপযুক্ত সময়ের আগেই বয়স্কজনোচিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তিনি এ ধরনের কৃত্রিম শিক্ষা প্রণালির বিরোধিতা করেছিলেন। রুশোর মতে, শিক্ষা বলতে বোঝায় শিশুমনকে বিমূর্ত এবং আগে থেকেই তৈরি করা ‘সত্য’ দিয়ে পূর্ণ করা নয়। যদি জোর করে শিশুর ওপর কিছু ধারণা চাপিয়ে দেওয়া হয়, শিশু স্বভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারবে না। ইংরেজদের প্রবর্তিত প্রাথমিক শিক্ষায় কিন্তু ছোট ছোট শিশুদের মগজে ইতিহাস ও ধর্ম সম্পর্কে নানা মনগড়া চিন্তা-ভাবনা ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, যা পরবর্তী সময়ে বাংলায় সাম্প্রদায়িক মানসিকতার সূত্রপাত ঘটায়।
বিদ্যাসাগরসহ তৎকালের ভদ্রলোকরা ইংরেজদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে একথাও বলেছিলেন, শিক্ষা সবার জন্য নয়। শিক্ষা লাভ করবে শুধু ধনীরা, যাদের শিক্ষা লাভের যথেষ্ট সামর্থ্য, সময় ও অবসর রয়েছে। বাংলা বা ভারত তারপর স্বাধীনতা লাভ করেও প্রাথমিক শিক্ষা কী হবে, সে বিষয়ে আর স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেনি, বারবার শিক্ষা কমিশন গঠন করে কিছুই লাভ হয়নি।
সত্যিকার অর্থে প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য কমিশন গঠনের আদৌ প্রয়োজন নেই। বাংলার পাঠশালা এবং রুশোর চিন্তা-ভাবনার দিকে তাকালেই হয়। বর্তমানেও শিক্ষার প্রাথমিক স্তরের পাঠক্রমে গুরুত্ব পাওয়া উচিত খুবই সরল বিষয় : মাতৃভাষায় লিখতে শেখা, পড়তে শেখা; সেই সঙ্গে প্রাথমিক গণিত সম্পর্কে ধারণা লাভ। বাংলাদেশে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সময়কালকে ধরতে হবে প্রাথমিক শিক্ষা হিসেবে। চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত হবে প্রাথমিক শিক্ষার প্রথম পর্ব। পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার দ্বিতীয় পর্ব। প্রথম পর্বের লক্ষ্য হবে শিশুর নিরক্ষরতা দূর করার পদক্ষেপ। শিশুরা এ সময় সাবলীলভাবে
মাতৃভাষায় নির্ভুলভাবে লিখতে-পড়তে শিখবে। এ জন্য বর্ণশিক্ষার পাশাপাশি শিশুসাহিত্য তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। বিদ্যালয়ে আর শিখবে তারা সহজ অঙ্ক। দ্বিতীয় পর্বে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হোক আরো সাহিত্যের বই, ভূগোল ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান সম্পর্কে কিছু ধারণা লাভ করার গ্রন্থ এবং একটি বিদেশি ভাষা শিক্ষার সুযোগ। বিদ্যালয়ে প্রতিদিন শিশুরা সবার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে জাতীয় সংগীত ও প্রয়োজনে অন্যান্য সংগীত গাইবে এবং বিদ্যালয়ের মাঠে বিভিন্ন খেলাধুলায় অংশ নেবে।
যখন একজন ব্যক্তি মাতৃভাষায় লিখতে-পড়তে শিখবে, তখন তার জন্য ভবিষ্যতের জ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত হবে যদি সে পরে আর বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ নাও পায়। বাংলাদেশের আরজ আলী মাতব্বর তার বড় একটি উদাহরণ। বড় উদাহরণ উনিশ শতকে রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারীসহ বহু নারী। আরজ আলী মাতব্বর কেবল বাংলা ভাষায় বই পড়তে পারতেন, ভিন্ন কোনো ভাষা জানা ছিল না। বাংলা বই পাঠ করে করেই তিনি বিরাট সব জিজ্ঞাসার জবাব দিয়ে গেছেন। উনিশ শতকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দিদি-বৌদিরা বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ পাননি। ঘরে বসে অক্ষরজ্ঞান শিখেই তারা কবি-সাহিত্যিক হিসেবে বিরাট পরিচিতি লাভ করেছিলেন এবং স্বর্ণকুমারী ‘ভারতী’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। পাঠশালার জ্ঞান নিয়েই বাংলার বটতলার সাহিত্য প্রাণ পেয়েছিল, যার পাঠক সংখ্যা ছিল অসংখ্য। ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় খুব ভালোভাবে মাতৃভাষায় ‘লেখাপড়া’ শিক্ষা দিতে পারাটাই বিরাট ব্যাপার।