Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম সনদের ঠিকানা, তারিখ ইত্যাদি

Icon

আফসান চৌধুরী

প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১৭

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম সনদের ঠিকানা, তারিখ ইত্যাদি

বাংলাদেশের জন্মের ঐতিহাসিক সূত্র একাধিক। যেমন সামাজিক সূত্র হতে পারে ১৭৬০-এর ফকির সন্ন্যাসী আন্দোলন, যাতে গতর খাটে সাধারণ নির্যাতিত কৃষক সমাজ, আর নেতৃত্ব দেয় মধ্যম শ্রেণি। যাদের রুজি ছিল কৃষকের অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল, ধর্মীয় খাজনা আদায়। ইংরেজ এতে হাত দিলে প্রতিরোধ ঘটে। কৃষক যোগ দেয়, কারণ তার এই শাসনামলে কষ্ট বেড়েছিল কয়েক গুণ। তাই দুই শ্রেণির যৌথ প্রচেষ্টায় শুরু হয় প্রতিরোধ, বিদ্রোহ। এই ধারা একসময় রাষ্ট্রিক রাজনীতিতে রূপান্তরিত হয় একশ বছরে। এভাবে সমাজের কাছ থেকে রাষ্ট্র ভাবনার উৎস ঘটে। আমাদের ইতিহাস আলাদা নয়। ১৭৬০, ১৮১১, ১৮৫৭, ১৯০৫ বা ১৯৭১ সবই গ্রথিত সামাজিক উৎসে কৃষকের ও সাধারণ মানুষের প্রতিরোধের ঠিকানায়।

দুই

আজ যে অঞ্চল নিয়ে বাংলাদেশ, তার প্রথম চিত্র পাওয়া যায় ১৯০৫ সালের ‘বঙ্গ ভঙ্গ’ বা পূর্ববঙ্গের প্রাতিষ্ঠানিক প্রকাশের পর। এটি ছিল বঙ্গের প্রান্তিক অঞ্চল, কেন্দ্র ছিল কলকাতা।  

ইংরেজদের তিনটি উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গ ভঙ্গের। ১. উঠতি এলিট শ্রেণি- পূর্ববঙ্গভিত্তিক শিক্ষিত মুসলমান গোষ্ঠীকে অধিক সুযোগ দেওয়া। ২. কলকাতাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠিত হিন্দু এলিট শ্রেণি, যারা ছিল শক্তিশালী তাদের দমানো। পূর্ববঙ্গের জঙ্গি কৃষকসমাজ যারা আবার ছিল প্রায় সবাই মুসলমান, তাদের কিছুটা সুবিধা দিয়ে সামলানো। ইংরেজ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় ‘স্বদেশি আন্দোলনের’ চাপে, কিন্তু কেন্দ্রীয় বঙ্গীয় কলকাতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কাল শেষ হয়। সর্বভারতীয় রাজনীতি চালু হয়। আর পূর্ববঙ্গ উপরাষ্ট্রিক চরিত্র অর্জন করে। সেখান থেকেই  আজকের বাংলাদেশ, পূর্ব পাকিস্তান নামক স্টেশন পার হয়।

তিন

কেন্দ্রীয় কংগ্রেস ও কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ বঙ্গভঙ্গের পর থেকেই সক্রিয় হয়ে ওঠে। এর ভিত্তিতেই ১৯৩৭ সালে প্রথম নির্বাচন হয়, যার ভিত্তিতে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টি যৌথ সরকার গঠন করে বাংলায়। ফজলুল হক তার প্রধান হয়। কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ লাহোর সভায় আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেয় ১৯৪০ সালে। এটাই প্রথম রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব এবং এটাই সূত্র। বাংলায় পরবর্তী রাজনীতি ছিল এই প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে। আজকের বাংলাদেশ এই প্রস্তাবের ধারাবাহিকতার সৃষ্টি, ১৯৪০ থেকে ১৯৭১ হয়ে। 

চার

১৯৪০ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত নানা ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘটে এই ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে। ‘ইস্ট পাকিস্তান রেনেসাঁস সোসাইটি’ নামে একটি সংগঠন চালু হয়, যেটা প্রচার চালায় এর পক্ষে। এর ভিত্তিতেই ১৯৪৬ সালের নির্বাচন হয়, যাতে সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় মুসলিম লীগ পায় বিশাল সাফল্য।

পাঁচ

কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ ১৯৪৬ সালে দিল্লিতে নির্বাচন-উত্তর এক সভায় একাধিক পাকিস্তানের সংশোধন করে একক পাকিস্তান প্রস্তাব পাস করে। জিন্নাহ নয়া প্রস্তাব করতে বাধ্য হয়, কারণ মূল প্রস্তাব ছিল একাধিক (২) সার্বভৌম দেশের। এই একক প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম। দুই পাকিস্তানের বদলে এক পাকিস্তান প্রস্তাব উপস্থিত করে একই দলের সহরাওয়ার্দী। এই সভা থেকে ফিরে এসে আবুল হাশিম ‘যৗথ বাংলা’ আন্দোলন শুরু  করেন। বঙ্গীয় কংগ্রেস ও বঙ্গীয় মুসলিম লিগ একসঙ্গে যুক্ত হয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করে ও আগায়। অদ্ভুত হচ্ছে বাঙালির জন্য আলাদা রাষ্ট্র আন্দোলনে সমর্থন দেয় জিন্নাহ, যার কর্মের প্রতিক্রিয়া ছিল এই আন্দোলন। মানে জিন্নাহ বাঙালি জাতীয়বাদী বনে যায় একক পাকিস্তান ভুলে। সোহরাওয়ার্দী যথারীতি এক পাকিস্তান প্রস্তাব পেছনে ফেলে, যৌথ বাংলা আন্দোলনে যুক্ত হয়। এসব ঘটে, কারণ জিন্নাহর প্রধান শত্রু নেহেরু বা কেন্দ্রীয় কংগ্রেস ছিল ‘যৌথ’ বাংলার বিরোধী।

ছয়

কিন্তু যৌথ বাংলা রাষ্ট্র গঠনের রাজনীতির কোনো ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা ছিল না বাংলায়। তা ছাড়া উত্তর ভারতের রাজনীতি যেমন এর বিরোধী ছিল, তেমনি কলকাতাকেন্দ্রিক এলিট সমাজ ছিল বিরোধী। সমাজে কোনো রাষ্ট্র অর্জনের জন্য যৌথ ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা ছিল না। যেমন- এক পাকিস্তানের কোনো আকাঙ্ক্ষাও ছিল না জনমনে বা বঙ্গীয় মুসলিম লীগের রাজনীতিতে। কেউই যা চায়নি। এটাই ১৯৪৭-এর বাস্তবতা।

সাত 

১৯৪৭ সালে বঙ্গীয় কংগ্রেস বঙ্গ ভঙ্গের প্রস্তাব ইংরেজরা মেনে নেয়। যৌথ বাংলা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর বঙ্গীয় মুসলিম লীগের একদল তরুণ কর্মী পাকিস্তান-ইন্ডিয়া বলয়ের বাইরে গিয়ে একটি  আলাদা রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশে ‘ইনার গ্রুপ’ নামের একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। এর নেতা ছিল সিলেটের মোয়াজ্জেম আহমেদ চৌধুরী। তার সঙ্গে যুক্ত হন আরো কয়েকজন নেতাকর্মী। প্রথম সভা হয় কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি মোর্শেদের বাসায়। এরা সক্রিয় ছিল ১৯৭১ পর্যন্ত। এদের মাধ্যমেই শেখ মুজিব ইন্ডিয়া যায় ১৯৬৩ সালে ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আলোচনা করতে, যা ব্যর্থ হয়। ‘ইনার গ্রুপের’ বেশির ভাগ সদস্য ছিল আবুল হাশিমের সমর্থক।  

১৯৪৭-এর পর লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন অনেকে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের সংগঠনের এই নাম ছিল। এমনকি ১৯৫৪ সালের  ১১ দফা ও  ১৯৬৬- এর  ৬ দফায় লাহোর প্রস্তাবের উল্লেখ স্পষ্ট।

আট

অর্থাৎ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আদি সূত্র লাহোর প্রস্তাব, সেটা এগিয়ে নিয়ে যায় আবুল হাশিম বাংলার রাজনীতিতে। ১৯৪৬ সালে সেটা ভণ্ডুল হওয়ার পর যৌথ বাংলা আন্দোলন করেন তিনি। সেটা ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই স্বাধীনতার প্রচেষ্টাগুলো শুরু, যার ধারাবাহিকতা চলেছে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। ১৯৪৯ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ হিসেবে নয়া জন্ম নেয়। এই অঞ্চলে কখনোই একক পাকিস্তানের অংশ হওয়ার রাজনীতি ছিল না, পূর্ব পাকিস্তান তাই ছিল জোর স্বাধীন দেশের পূর্বক প্রসব বিঘ্নিত রাষ্ট্র। অতএব ধারাবাহিকতার ভিত্তিতে দেখলে লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন করাটা ছিল অবধারিত, কিন্তু সময় লাগে সাত বছরের বদলে ৩১ বছর। এটাই বাংলাদেশের জন্ম সনদ বৃত্তান্ত।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫