
বর্তমানে অনেকেই ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান। ছবি: সংগৃহীত
তিন চাকার রিকশা বা রিক্সা যা জাপানি ভাষায় জিন-রিকি-শ বা মানব শক্তির বাহন হিসেবে ১৯০০ সালের দিকে প্রথম ব্যবহৃত হয়। পরবর্তীতে ১৯১৯ সালে মায়ানমার থেকে চট্রগ্রামে এবং ১৯৩৮ সালে কলকাতা থেকে প্রথম ঢাকায় আসে। সময়ের পরিক্রমায় এই রিকশা দরিদ্র মানুষের আয়ের অন্যতম উৎস হয়ে উঠে।
যদিও স্বল্প দূরত্বে সব শ্রেণিপেশার মানুষের কাছেই রিকশা বেশ প্রিয় বাহন। আধুনিক সময়ে বিদ্যুৎ এবং বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির উন্নতির ফলে মানুষচালিত এ বাহনে যুক্ত হয়েছে মোটর, রিচার্জেবল ব্যাটারি। মানবশক্তির পরিবর্তে বিদ্যুৎশক্তি ব্যবহার করার ফলে এসব রিকশাকে এখন ‘অটোরিকশা’ বলা হচ্ছে। বিদ্যুৎচালিত বলে অটোরিকশা ১৪ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৭০ বছর পর্যন্ত যেকোনো বয়সের মানুষ এটি চালাতে সক্ষম। আর এখানেই সমস্যার শুরু।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ১৮.৭। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ দারিদ্র্যের সংজ্ঞা অনুযায়ী, দৈনিক ২.১৫ ডলারের কম আয় করা মানুষ দরিদ্র বলে গণ্য হবেন। টাকার হিসাবে দারিদ্র্যসীমা পার করতে হলে দিনে আয় করতে হবে কমপক্ষে ২৫৭ টাকা। বিবিএসের হিসাব অনুসারে দেশে মোট বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৮২ হাজার। তার মধ্যে সাড়ে ২১ লাখই তরুণ-তরুণী। বেকারদের ৮৩ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর। অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্র হিসাবে ফুটপাতে দোকান দেওয়া থেকে শুরু করে ফেরি করে পণ্য বিক্রিতে যুক্ত সবাই সাধারণভাবে তরুণ যার উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই পুরুষ। সারাদেশে বেকার তরুণ সমাজের কাছে সহজে আয়ের উৎস হিসাবে ভাড়ায়চালিত বাহন সবসময় জনপ্রিয় ছিল। পাঠক লক্ষ্য করে দেখবেন-বাস, ট্রাক, টেম্পু, উবার, পাঠাও ইত্যাদি সকল বাহনের চালক তরুণ। এই চালকদের অনেকে ধারদেনা করে কিংবা এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বা শেষ কোনো অবলম্বন বিক্রি করে অটোরিকশা কেনে। এই বাহনের কোনো লাইসেন্স বা চালানোর লাইসেন্স লাগেনা বলে কেনার পর থেকেই শুরু হয় টাকা আয়। এই টাকা খুব দ্রুত আসে বলে রাস্তায় অসম প্রতিযোগিতা চলে। স্বেচ্ছাচারিতা চরমে গিয়ে পৌঁছায়। বর্তমানে বাংলাদেশের এমন কোনো সড়ক-রাস্তা নাই, যেখানে আপনি অটোরিকশা পাবেন না। এমন কি দ্বীপাঞ্চলেও।
জনপ্রিয়তা ছাড়া এই রকমের একটা বাহন কোনোভাবেই এভাবে পুরো দেশে ছড়াতে পারে না। জনপ্রিয়তার প্রথম কারণ, বিকল্প কর্মসংস্থান। এই অটোরিকশা ঘিরে গড়ে উঠেছে উৎপাদক, আমদানিকারক, ডিলার, পার্টসের দোকান, গ্যারেজ, বডি বানানোর ওয়ার্কশপ, মেরামতের দোকান ইত্যাদি। এসব এক একটি প্রতিষ্ঠানে ন্যূনতম ১০ জনের কর্মসংস্থান হয়। উৎপাদক, সংযোজক, চালক আর মেরামত মিলিয়ে গত দশ বছরে দারিদ্র সীমার কাছাকাছি থাকা মানুষদের অংশগ্রহণে এক বিরাট স্থানীয় অর্থনীতি তৈরি হয়েছে। সাধারণভাবে বলা যায় এই খাতে ৬০ থেকে ৭০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। মডেল ভেদে একটা নতুন অটোরিকশার দাম, ইজিবাইক ১৫০,০০০ টাকা, অটোভ্যান গাড়ি ৬০,০০০ টাকা খাদ্য গাড়ি ৬০,০০০ টাকা, মডিফাইড রিকশা ৮৭,০০০ টাকা, মহেন্দ্রা আলফা ১৯৫,০০০ টাকা, স্টাইলিশ অটোরিকশা ৭৫,০০০ টাকা। এই টাকা যোগাড় করে একজন বেকার তরুণ দৈনিক আয়ের একটা পথ তৈরি করে। অনেকে আবার এরকম বিশটা অটোরিকশা কিনে গ্যারেজ পরিচালনা করে। এক্ষেত্রে একজন চালক দৈনিক ৩৫০ টাকা জমা দিয়ে এক চার্জে দিনে আট ঘন্টার জন্যে একটা অটোরিকশা নিয়ে রাস্তায় বের হন। এক চার্জে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ভ্রমণ করা যায়। এমনও চালক রয়েছেন যিনি দিনে ১২০০ টাকা ভাড়া পেয়েছেন। একজন বেকার তরুণের কাছে এটা অনেক টাকা। বিশেষ করে যখন টাকা আয়, তার কাজের গতির উপর নির্ভর করে।
যাত্রীদের কাছে এই অটোরিকশার জনপ্রিয়তার বড় কারণ- মানবিকতা। যে ব্যক্তি শরীরের জোরে রিকশা চালায় তার জন্যে কষ্ট লাগে। অনেক সময় বয়স্ক লোক রিক্সা চালায়। রিক্সায় দুইজন বা ক্ষেত্র বিশেষে চার জনও উঠে। মালও পরিবহন করে। রাস্তা খারাপ হলে তারা নেমে, হাতে টেনে নিয়ে যায়। এই সব ঘটনা সাধারণের কাছে অমানবিক মনে হয়। অটোরিকশায় এই সব থাকে না। এছাড়াও স্বল্প দূরত্বে (১-৫ কিলোমিটার) ভাড়া তুলনামূলকভাবে কম এবং অল্প সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো যায়। কিছু অটোরিকশার পেছনে দুইটা সিট থাকে, তার মানে যাত্রী সংখ্যা তিনজনের যায়গায় ছয়জন নেয়া যায়। এতে ভাড়া আরও কম পড়ে। মাল পরিবহনের ক্ষেত্রে চারশ কেজি থেকে ছয়শ কেজি পর্যন্ত নেয়া যায়। একটা ট্রাকের তুলনায় অটোরিকশায় মাল টানার ভাড়া কম পড়ে। অটো-রিক্সার গতি সর্বোচ্চ ৪৬ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা, সচরাচর দেখা যায়। অনেক যাত্রী এই গতি উপভোগ করেন। কম সময়ে ঝুঁকি নিয়ে অনেকেই গন্তব্যে তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে চায়। যদিও এই গতির কারণেই দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। এমনকি মৃত্যুও হয়।
অনিয়ন্ত্রিত সব কিছুই খারাপ। বাহন মাত্রই লাইসেন্স প্লেট থাকতে হবে, ফিটনেস থাকতে হবে, চালকের চালানোর লাইসেন্স থাকতে হবে। রিকশা গরিবের আয়ের বাহন ছিল বলেই এই সব ছিল না। বিশেষ করে রিকশার গতি কম ছিল, বিনিয়োগ কম ছিল। কিন্তু অটোরিকশা সে রকম বাহন না। অটোরিকশার ব্যাটারির পরিবেশ গত ঝুঁকি আছে। এই ব্যাটারি প্রতিদিন চার্জ করা হয়, তাই লাইফ টাইম কম। সাধারণভাবে এক বছর। এরপর নতুন কিনতে হয়। ভাল মানের পদ্ধতি ব্যবহার করে পুরাতন ব্যাটারির ৮০% পর্যন্ত পুনঃব্যবহার করা যায় । কিন্তু এই অটোরিকশার সংখ্যা বাংলাদেশে আনুমানিক চল্লিশ লক্ষ (চার মিলিয়ন)। এই সংখ্যক ব্যাটারি পুনঃব্যবহার করার জন্যে যথেষ্ট পরিমানে ভালমানের কারখানা নাই। যার ফলে এই পুরাতন ব্যাটারির একটা বড় অংশ পরিবেশের সাথে মিশে যাচ্ছে। একটি অটোরিকশাতে সাধারণ ত পাঁচটি করে ১২ ভোল্টের ব্যাটারি থাকে। সাধারণ হিসাবে পাঁচটি ১২ ভোল্টের ব্যাটারির ধারণক্ষমতা ৩ কিলোওয়াট। একটি অটোরিকশা একবার চার্জ দিতে ৩-৫ কিলোওয়াট বৈদ্যুতিক লোড প্রয়োজন হয়, আর ৮-১০ ঘন্টা চার্জ দিতে ১০ কিলোওয়াট-ঘন্টা বা ১০ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়। এই পরিমাণ বিদ্যুৎ শহরের ফ্ল্যাট বাসায় থাকা একটি পরিবারের একদিনের বিদ্যুৎ খরচের সমান। একটা আবাসিক বিল্ডিং তৈরি করতে তিন বছর সময় লাগে। দুই কোটি টাকা খরচ হয়। তার পর সেখানে মানুষ থাকতে পারে। তখন ৩-৫ কিলোওয়াট বৈদ্যুতিক লোড এর ১০ টার মত ফ্ল্যাট বাসা তৈরি হয়। আর একটা অটোরিকশা আজকে কিনে চালালে, রাতেই এই পরিমাণ বৈদ্যুতিক লোড প্রয়োজন হয়। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এই চার্জের বেশির ভাগই অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে করা হয়। সহজেই বুঝা যায় ৪০ লাখ অটোরিকশা আমাদের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উপর কত বড় বৈদ্যুতিক লোড তৈরি করছে। বিশেষ করে যখন এই দেশে এখনও বিদ্যুৎ এ ভর্তুকি দিতে হয়।
জাতিসংঘের পরিবেশ প্রোগ্রাম, উন্নয়নশীল, নিম্ন আয় এবং মধ্যম আয়ের দেশে, দুই এবং তিন চাকার বৈদ্যুতিক বাহনের ব্যাপক ব্যবহারে সহযোগিতা করে আসছে। তাদের মতে ২০২২ সালে দুই এবং তিন চাকার বৈদ্যুতিক বাহনের বাজার মূল্য ছিল ১৪.৩ বিলিয়ন ডলার যা ২০৩০ সাল নাগাদ ৪১.১ বিলিয়ন ডলারে উন্নিত হবে। এই খাত একই সাথে উন্নয়নশীল, নিম্ন আয় এবং মধ্যম আয়ের দেশের মানুষের আর্থ সামাজিক জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। তাহলে এর টেকসই সমাধান কি হতে পারে?
প্রথমত, গবেষণাভিত্তিক যাত্রী বান্ধব অটোরিকশা ডিজাইন এবং বাজারজাত করতে হবে। সময়ের সাথে ফিটনেস বিহীন অটোরিকশা ক্রমান্বয়ে রাস্তা থেকে তুলে নিতে হবে। এরই মধ্যে দেশের প্রথম ৩ চাকার 'মেড ইন বাংলাদেশ' অটো রিক্সা আগামী ২০২৫ নাগাদ বাজারে আনার ঘোষণা দিয়েছে ‘রানার’। এই রকমের উদ্যোগে যাত্রী নিরাপত্তা এবং সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। তবে জাতীয় বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার উপর লোড কমাতে হলে সৌর শক্তি ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে অটো-রিক্সার ছাদে সৌর বিদ্যুৎ প্যানেল লাগানো যেতে পারে। এরকম একটা বৈদ্যুতিক তিন চাকার বাহনে ৪০০ ওয়াটের সৌর বিদ্যুৎ প্যানেল ব্যবহার করে দেখা গেছে যে দিনের বেলা সূর্যের আলো ব্যবহার করে এর ব্যাটারি ২০% চার্জ করতে পারে। একই সাথে পেট্রোল পাম্পের আদলে নীতিমালা করে রাস্তার পাশে অটোরিকশা চার্জিং স্টেশন এর অনুমোদন দেয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে অটোরিকশা চার্জিং স্টেশনকে তার মোট বৈদ্যুতিক চাহিদার একটা অংশ বিকল্প উৎস থেকে আহরণের শর্ত দেয়া যেতে পারে।
সবাইকে নিয়ে চলতে হবে। সড়ক যেমন শুধু ব্যক্তিগত গাড়ির জন্যে নয়, তেমনি ভাড়ায় চালিত গাড়ির জন্যেও নয়। সহানুভূতি আর সমন্বয় এর মাধ্যমে মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করতে হবে। বেকারত্বের ভিড়ে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা মানুষদের রাষ্ট্রীয়ভাবে নীতিগত সহায়তা দিতে হবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, পদার্থ বিভাগ, বিএসএমআর মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, ঢাকা