Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

আমাদের বিজয়ের দলিল ভারতের হাতে কেন

Icon

রইসউদ্দিন আরিফ

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৫৪

আমাদের বিজয়ের দলিল ভারতের হাতে কেন

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনীর ঢাকায় আত্মসমর্পণের অর্থ হলো, ঢাকার কাছে আত্মসমর্পণ, দিল্লির কাছে নয়। অথচ রেসকোর্স ময়দানে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের যে দলিলটি স্বাক্ষরিত হলো, তাতে স্বাক্ষর করলেন পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল নিয়াজি এবং ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল অরোরা। যাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ এবং এই আত্মসমর্পণের দলিল, তাদের কোনো নাম-নিশানা সেই দলিলে নেই। 

ভারতের দাবি অনুযায়ী, ভারতীয় লে. জেনারেল অরোরা দলিলে স্বাক্ষর করেছেন বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই যৌথ বাহিনী গঠিত হয়েছিল, পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর চূড়ান্ত হামলা পারিচালনার জন্য। বলা বাহুল্য, সেই যৌথ বাহিনীর মধ্যে মূল বাহিনী ছিল জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীর নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী। কারণ পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধটা ছিল বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার যুদ্ধ। আর ভারতীয় বাহিনী ছিল, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যকারী মিত্রবাহিনী। 

সে হিসেবে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করার কথা মূল বাহিনীর (মুক্তিবাহিনীর) সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর। কিন্তু আত্মসমর্পণের দিন জেনারেল ওসমানীকে পরিকল্পিতভাবে ঢাকার বাইরে রেখে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন ভারতীয় বাহিনীর লে. জেনারেল অরোরা। এটি ছিল একটি পূর্ব পরিকল্পিত প্রতারণামূলক কাজ। এর ফলে আত্মসমর্পণের দলিলের ‘মালিক’ হয়ে যায় ভারত এবং তেপ্পান্ন বছর যাবৎ সেই দলিলটি রয়েছে ভারতের হাতে। এই প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় তখন আত্মসমর্পণের দলিলটি নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন ওঠে। কোনো কোনো মহলে ক্ষোভেরও প্রকাশ ঘটে। এমনকি এর বিরুদ্ধে, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে বিপ্লবী সিরাজ সিকদার ও তার দল ১৬ ডিসেম্বরকে ‘পরাধীনতার কালো দিবস’ ঘোষণা দিয়ে দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছিল। মনে হয় একমাত্র তিনিই এর ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা সম্যক উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। 

বলা বাহুল্য, ওই আত্মসমর্পণের দলিলটি হলো বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের দলিল। কোনো দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত শত্রু বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল, (অর্থাৎ বিজয়ী দেশটির সার্বভৌমত্বের দলিল) মিত্রবাহিনীর মালিকানায় চলে যাওয়া এবং অর্ধশতাব্দী যাবৎ সেই দলিল মিত্রবাহিনীর দেশটির হাতে কুক্ষিগত থাকার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। এই নজিরবিহীন ঘটনার পর, সেই স্বাধীন দেশটি আর স্বাধীন-সার্বভৌম থাকে না, ওই মিত্রবাহিনীর দেশের অধীন অথবা নিয়ন্ত্রিত দেশ হয়ে যায়। তেপান্ন বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা সেই কথাই প্রমাণ করে।

দুই 

ভারত যদি মনে করে থাকে, আমাদের বিজয়টি তারাই এনে দিয়েছেন এবং আমাদের একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়ে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন- তাহলে তো আমাদের সার্বভৌমত্বের দলিলটিও ৫৩ বছর আগেই আমাদের হাতে তুলে দিয়ে আরো বড় মহানুভবতার পরাকাষ্ঠা দেখাতে পারতেন। কারণ স্বাধীনতার যুদ্ধটা তো তাদের (ভারতের) ছিল না, ছিল আমাদের (বাংলাদেশের), যার জন্য দেশের লাখ লাখ মানুষ যুদ্ধ করে জীবন উৎসর্গ করেছে। দিল্লি সেটি করলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা কতই না মধুর বন্ধুত্বপূর্ণ হতো। 

কিন্তু না, অত বড় মহানুভবতা ভারত দেখাতে পারেনি। বরং ভারত আমাদের সার্বভৌমত্বের সনদ আত্মসমর্পণের দলিলটি নিজেদের হাতে রেখে, আমাদের জিম্মি করে, ৫৩ বছর ধরে বাংলাদেশের ওপর আধিপত্যবাদী ও আগ্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। 

কয়েক দিন আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য না করে, ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়কে শুধু ভারতের বিজয় বলে দাবি করে যে আস্ফালন করেছেন, সেটি আত্মসমর্পণের দলিলটি ভারতের হাতে থাকার কারণেই। এভাবে যতদিন দলিলটি ভারতের হাতে থাকবে, ততদিন আমাদের সার্বভৌমত্ব ভারতের কাছে জিম্মি হয়ে থাকবে। 

তিন

এখন আমাদের নিজেদের গ্লানি, হীনম্মন্যতা, কাপুরুষতা ও ব্যর্থতার কথাও বলব। বাংলাদেশে ৫৩ বছর শুধু ভারতের তাঁবেদাররাই দেশ শাসন করেননি। ‘ভারতবিরোধী’ স্লোগান দিয়ে অনেক রাজনৈতিক দল এবং অনেক সামরিক গোষ্ঠীও একাধিকবার দেশ শাসন করেছেন। তাদের সঙ্গে অনেক সুশীল, বুদ্ধিজীবীরাও ছিলেন। প্রশ্ন রাখতে চাই, তারা বুকে হাত দিয়ে বলুন, ক্ষমতায় থেকে অথবা ক্ষমতার বাইরে থেকে তারা আজ পর্যন্ত (আমাদের সার্বভৌমত্বের দলিলটি ভারতের হাতে কেন?)- এই প্রশ্নটি কখনো দিল্লিকে করতে পেরেছেন কি? 

আজকে নরেন্দ্র মোদির আস্ফালন ছাড়াও ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং যে প্রকাশ্যে বাংলাদেশে সশস্ত্র আগ্রাসনের হুমকি দেন, উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা যে সীমান্ত ঘেরাওয়ের হুমকি দেয়, সেটিও ওই আত্মসমর্পণের দলিলের জোরেই। সে ক্ষেত্রে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের অথবা পরবর্তী যেকোনো সরকারের কর্তাব্যক্তিদের, ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠীর প্রকাশ্য হুমকির জবাবে মিনমিনে প্রতিক্রিয়া জানালে চিড়া ভিজবে না। কোনো পাল্টা হুমকি দিলেও চিড়া ভিজবে না। তার জন্য দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শক্তিশালী কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে আত্মসমর্পণের দলিল ভারতের কাছ থেকে ফেরত আনতে হবে। 

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের, বিশেষ করে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোর জনগণ নিঃস্বার্থভাবে যে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন, তার জন্য বাংলাদেশের মানুষ তাদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ। কিন্তু দিল্লির শাসকগোষ্ঠী আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে, তার মূল্য আমাদের পরিশোধ করতে হয়েছে ও হচ্ছে সার্বভৌমত্বের বিনিময়ে। আমাদের অস্তিত্বের বিনিময়ে তৈরি হওয়া এই কালো অধ্যায় চিরতরে মুছে ফেলতে হবে। তারপর ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হবে সমতার ভিত্তিতে সুস্থ প্রতিবেশীসুলভ ও আন্তরিক বন্ধুত্বপূর্ণ। আমাদের কখনোই এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, ভারতের জনগণ অবশ্যই আমাদের বন্ধু। কারণ তারাও আমাদের মতো শোষিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত। কেবল আমাদের সবার সম্মিলিত সংগ্রামের মধ্য দিয়েই একদিন বাস্তবায়িত হবে মুক্ত ভারত, মুক্ত বাংলাদেশ, মুক্ত উপমহাদেশ। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫